TET Scam: Manik Bhattacharya’s arrest in Tet scam and all controversies related to him dgtl
Manik Bhattacharya
দলের লোক হলে ছেলেমেয়েদের চাকরি হবে, রাখঢাক না করে প্রকাশ্যেই বলতেন তৃণমূলের মানিক!
প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলার তদন্তে নেমে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি তথা পলাশিপাড়ার বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্যকে গ্রেফতার করল ইডি।
নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতাশেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২২ ১৩:০১
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২৬
প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলার তদন্তে নেমে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান তথা পলাশিপাড়ার বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্যকে গ্রেফতার করল ইডি। সোমবার রাতে টানা জেরার পর তদন্তে অসহযোগিতার অভিযোগ এনে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু কে এই মানিক? কী ভাবেই বা রাজনৈতিক উত্থান? কী করেই বা তিনি জড়িয়ে পড়লেন কোটি কোটি টাকার এই দুর্নীতি মামলায়?
০২২৬
২০২১ সালে তৃণমূলের টিকিটে প্রথম বারের জন্য বিধায়ক হন মানিক। ভোটে জিতে পলাশিপাড়ার বিধায়ক হিসাবে বিধানসভায় প্রবেশ করেন তিনি। তাঁর আগে পলাশিপাড়ার বিধায়ক ছিলেন তাপস সাহা। তাঁকে তেহট্টে সরিয়ে পলাশিপাড়ার আসন মানিককে দেওয়া হয়। একুশের বিধানসভা ভোটে বিরোধী গেরুয়া শিবিরের প্রার্থী বিভাসচন্দ্র মণ্ডলকে ৬২ হাজার ভোটে হারিয়ে মানিক বিধায়ক হয়েছিলেন।
০৩২৬
মানিক ভোটের আগে দাবি করেছিলেন, নদিয়ার পলাশিপাড়াতেই তাঁর আদি বাড়ি। নিজেকে বার বার পলাশিপাড়ার ছেলে বলেই ভোটপ্রচারে নেমেছিলেন তিনি।
০৪২৬
২০২১-এ প্রথম বারের জন্য ভোটে জিতলেও মানিকের ভোটে দাঁড়ানোর ইতিহাস পুরনো। ২০১১ সালেও পলাশিপাড়া থেকে বিধানসভা নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। কিন্তু জিততে পারেননি।
০৫২৬
২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে দীর্ঘ দিনের বাম শাসনকে হঠিয়ে তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতায় এলেও সিপিএমের প্রার্থী এস এম সাদির কাছে ১৬০০ ভোটে হেরে যান মানিক। ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর ২০১৬ সালের নির্বাচনে মানিককে আর প্রার্থী করা হয়নি। ভোটে না জিতলেও ২০১১-এর বিধানসভা নির্বাচনের পর রাজ্যের তরফে তাঁকে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ করা হয়।
০৬২৬
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়া ছাড়াও সদ্য ইডির হাতে ধৃত মানিক যোগেশ চন্দ্র চৌধুরী ল’ কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। বর্তমানে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছেন তিনি।
০৭২৬
মানিক নিজেকে সবসময় মুখ্যমন্ত্রী মমতা-ঘনিষ্ঠ বলে দাবি করে এসেছেন। মানিকের দাবি, মুখ্যমন্ত্রী এবং তিনি সহপাঠী ছিলেন। কলেজ জীবনে দীর্ঘ সময় তিনি মমতার পাশে ছিলেন বলেও বহু বার দাবি করেছেন।
০৮২৬
২০১১ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পরই রাজ্যের তরফে মানিককে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি করা হয়। অভিযোগ, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের চেয়ারম্যান থাকাকালীনই ব্যাপক দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। যাঁরা নিয়োগ দুর্নীতির নেপথ্যে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে মানিক অন্যতম বলেও অভিযোগ ওঠে।
০৯২৬
তবে মানিককে নিয়ে বিতর্ক এই প্রথম নয়। তৃণমূলের কাছের লোক বলে পরিচিত হলেও বাম জমানায় সিপিএমের রাজ্য কমিটির এক সদস্যের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকার অভিযোগ তুলেছিলেন তৃণমূলেরই একাংশ।
১০২৬
২০১৪ সাল। মানিক তখন বহাল তবিয়তে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের চেয়ারম্যান পদে বসে। ওই বছরের লোকসভা নির্বাচনের আগে বালুরঘাট লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী অর্পিতা ঘোষের হয়ে প্রচারে নেমে বেফাঁস মন্তব্য করে বসেন মানিক। মন্তব্য করেন, প্রাথমিক শিক্ষক পদে চাকরি হবে তৃণমূল কর্মীদের ছেলেমেয়েদেরই। এর জন্য দরকার হলে তিনি জেলে যাবেন বলেও তিনি মন্তব্য করেন। সব প্রাথমিক শিক্ষককে অর্পিতার হয়ে প্রচারে নামতেও তিনি আহ্বান জানান।
১১২৬
মানিকের ওই বক্তব্যের জেরে রাজ্য জুড়ে হইচই পড়ে যায়। প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের কর্তা কী ভাবে চাকরির প্রতিশ্রুতি দিতে পারেন, সে প্রশ্ন তুলে নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হন বিরোধীরা। মানিক অবশ্য দাবি করেছিলেন, তাঁর বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।
১২২৬
চলতি বছরের শুরুর দিক থেকে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলা নিয়ে রাজ্যে শোরগোল পড়ে যায়। প্রাথমিকের পাশাপাশি, নবম-দশম এবং একদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগেও দুর্নীতির অভিযোগ সামনে আসে। সিবিআইয়ের হাতে তদন্তভার যাওয়ার পর থেকে নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে মানিককে একাধিক বার তলব করে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় একাধিক বার তলব করা হয় রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কেও।
১৩২৬
প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগে ২০ জুন কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে পর্ষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে অপসারণ করা হয় মানিককে।
১৪২৬
প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ চেয়ারম্যানের পদ থেকে অপসারণের পর মানিককে তাঁর এবং পরিবারের সম্পত্তির হিসাব পেশ করার নির্দেশ দেয় কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের একক বেঞ্চ। সেই নির্দেশের বিরুদ্ধে ডিভিশন বেঞ্চেরও দ্বারস্থ হয়েছিলেন মানিক।
১৫২৬
তবে শেষমেশ নিজের এবং তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদের সম্পত্তির হিসাব আদালতে জমা দেন মানিক।
১৬২৬
এর পর সিবিআইয়ের পাশাপাশি এই মামলার তদন্তে নামে ইডি। ২২ জুলাই শিক্ষক দুর্নীতি মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত পার্থের নাকতলার বাড়ি-সহ ১৩টি জায়গায় একসঙ্গে হানা দেয় ইডি। এর মধ্যে ছিল মানিকের বাড়িও। প্রায় ১৭ ঘণ্টা তল্লাশি চালানো হয় মানিকের বাড়িতে। অভিযানে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র উদ্ধার করেন গোয়েন্দারা। মানিকের বাড়ি থেকে ইডি বেরিয়ে গেলেও ইডি আধিকারিকদের হাতে গ্রেফতার হন পার্থ।
১৭২৬
২৮ জুলাই আবার জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য মানিককে তলব করে ইডি। ১৩ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে ইডির দফতরে আটকে রেখে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
১৮২৬
এর মধ্যেই প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতির ফাঁকা পদে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য গৌতম পালকে নিয়োগ করা হয় রাজ্যের তরফে।
১৯২৬
মাঝে এই গুজব রটে যে নিখোঁজ হয়েছেন মানিক। তাঁর বিরুদ্ধে সিবিআই লুকআউট নোটিসও জারি করে। সিবিআইয়ের লুকআউট নোটিস জারির পর মানিকের নিরাপত্তা তুলে নেয় রাজ্য পুলিশ। তবে সকলকে চমকে দিয়ে মানিক জানান, তিনি বেপাত্তা নন, যাদবপুরের বাড়িতেই আছেন।
২০২৬
এ সবের মধ্যে বার বার সংবাদমাধ্যমের প্রতিও রোষ প্রকাশ করতে দেখা গিয়েছিল মানিককে। অভিব্যক্তিতে বুঝিয়েছিলেন, তাঁর অবস্থার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সংবাদমাধ্যমই দায়ী। এমনকি, ‘‘আই অ্যাম রক্তাক্ত বাই প্রেস’’ বলেও মন্তব্য করতে শোনা গিয়েছিল মানিককে।
২১২৬
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মামলায় ইডি যে চার্জশিট দিয়েছিল, তাতেও মানিকের নাম ছিল। চার্জশিটে অভিযোগ আনা হয়েছিল যে, চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চাকরি দিয়েছিলেন মানিক। সেই খবর ছিল পার্থর কাছেও। কিন্তু পার্থ এই বিষয়ে কোনও ব্যবস্থা নেননি। ইডি সূত্রে খবর, প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ এবং প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মানিকের মোবাইল বার্তা আদানপ্রদানের প্রমাণ রয়েছে তাদের হাতে। চার্জশিটেও এর উল্লেখ রয়েছে।
২২২৬
চার্জশিটে পার্থ ও মানিকের হোয়াটসঅ্যাপ কথোপকথনের উল্লেখ ছিল। জানা যায়, পার্থের সঙ্গে ১০ মিনিটের জন্য কথা বলতে চেয়েছিলেন মানিক। আবার, মানিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ করে রাজ্যের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে মেসেজ করেছেন জনৈক ব্যক্তি। যেখানে লেখা ছিল, ‘দাদা, মানিক ইজ় টেকিং মানি যা-তা ভাবে।’ অর্থাৎ, মানিক অবৈধ ভাবে টাকা তুলছেন বলে অভিযোগ করেছেন।
২৩২৬
চার্জশিট জমা দেওয়ার পর মানিককে তলব না করা সত্ত্বেও ২১ সেপ্টেম্বর রাতে তিনি নিজেই ইডি আধিকারিকদের কাছে গিয়ে বিভিন্ন নথি জমা দিয়ে আসেন বলে সূত্রের খবর। সেই নথি ধরে তদন্ত চলছিল।
২৪২৬
হাই কোর্ট কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইকে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় তদন্তভার দিয়েছিল। হাই কোর্টের নির্দেশ ছিল প্রয়োজনে মানিককে গ্রেফতারও করতে পারে সিবিআই। টেট-কাণ্ডে কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিলেন প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের অপসারিত চেয়ারম্যান মানিক।
২৫২৬
প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগ-দুর্নীতি মামলায় শুনানি শেষ হলেও সুপ্রিম কোর্ট রায় ঘোষণা স্থগিত রাখে। পাশাপাশি শীর্ষ আদালত এ-ও জানিয়ে দিয়েছিল, প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগ-দুর্নীতি মামলায় রায় ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত মানিককে কোনও ভাবেই গ্রেফতার করতে পারবে না সিবিআই। তবে, টেট মামলায় সিবিআই তদন্ত করার যে নির্দেশ কলকাতা হাই কোর্ট দিয়েছিল, তাতেও স্থগিতাদেশ দেয়নি দেশের শীর্ষ আদালত।
২৬২৬
তবে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছিল ইডি। নিয়োগ-দুর্নীতি মামলায় মানিক কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে যে নথি জমা দিয়েছিলেন, সেখানে একাধিক গরমিল রয়েছে বলে ইডি সূত্রে খবর। সে কারণেই সোমবার রাতভর তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন ইডি আধিকারিকরা। জিজ্ঞাসাবাদ চলার সময় বয়ানে অসঙ্গতি এবং জেরায় অসহযোগিতার অভিযোগ আনা হয় মানিকের বিরুদ্ধে। শেষে সোমবার রাতেই গ্রেফতার করা হল তাঁকে।