Several expeditions were made to find noah's ark dgtl
Noah Ark
সত্যিই কি ছিল নোয়ার নৌকা? এই পাহাড়েই কি রয়েছে তার ধ্বংসাবশেষ?
খ্রিস্টধর্মের আদিপর্বে নোয়ার নৌকার অবশেষ আর্মেনিয়ার কোথাও রয়েছে বলে দাবি করা হতে থাকে। কিন্তু এর কোনও প্রমাণ কেউই দিতে পারেননি।
নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতাশেষ আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০২৩ ১০:০৭
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২১
মহাপ্লাবন এসে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সৃষ্টিকে। সব কিছুই ডুবে গিয়েছিল প্রলয়পয়োধি জলে। আর সেই প্রলয় থেকে সৃষ্টিকে রক্ষা করেছিলেন এক পুরুষ। ‘বাইবেল’-এর ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’-এর ‘জেনেসিস’ পর্বে এই মহাপ্লাবনের বর্ণনায় মূল চরিত্র তিনিই। নোয়া বা নূহ্ নামের সেই ব্যক্তিটিকে আব্রাহামিক ধর্মগুলি (ইহুদি, খ্রিস্ট এবং ইসলাম) একজন নবি বা ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত মানুষ হিসাবেই মনে করে।
(ছবি: পিক্স্যাবে)
০২২১
মহাপ্রলয়ের আগে ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ পেয়ে নোয়া এক সুবিশাল নৌকা বা আর্ক তৈরি করেন। সেই নৌকায় তিনি যাবতীয় প্রাণীর একটি করে যুগলকে স্থান দেন এবং সপরিবার সেই নৌকায় ঠাঁই নেন।
(ছবি: পিক্স্যাবে)
০৩২১
প্রলয়ের পর সেই নৌকার কী হল, এই প্রশ্ন যুগ যুগ ধরে ভাবিয়েছে মানুষকে। প্রাচীন কাল থেকে আজ পর্যন্ত অসংখ্য মানুষ খুঁজে চলেছেন নোয়ার নৌকাকে। খ্রিস্টীয় প্রথম শতক থেকেই এই অনুসন্ধান শুরু হয় বলে ইতিহাসবিদরা জানান।
(ছবি: পিক্স্যাবে)
০৪২১
বাইবেলের ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’-এর ‘জেনেসিস’ পর্বে বলা হয়েছিল যে, মহাপ্লাবন থামলে নোয়ার নৌকা আরারত পর্বতে গিয়ে থামে। যদিও অন্যান্য প্রাচীন ইহুদি ধর্মপুস্তকে অন্য নামের পর্বতের কথা বলা হয়েছে, তবু বেশির ভাগ সন্ধানী আরারত পর্বতের বিষয়টিকেই গুরুত্ব দেন।
(ছবি: পিক্স্যাবে)
০৫২১
এই আরারত পর্বত কোথায়? এই প্রশ্ন যুগ যুগ ধরে ভাবিয়েছে সন্ধানীদের। মধ্যযুগে আর্মেনিয়ার (বর্তমানে তুরস্কের অন্তর্গত ভূখণ্ড) একটি পর্বতকে আরারত বলে ধরে নেওয়া হয়। ইহুদিদের আর এক প্রাচীন গ্রন্থ ‘বুক অফ জুবিলিজ়’ জানায় যে, নোয়ার নৌকা লুবার নামে এক পর্বতশৃঙ্গে গিয়ে ঠেকেছিল। লুবার আসলে আরারত পর্বতেরই একটি চূড়া।
(মাউন্ট আরারত, ছবি: উইকিপিডিয়া)
০৬২১
১৬-১৭ শতকের ইংরেজ নৌসেনাপতি এবং অভিযাত্রী স্যর ওয়াল্টার র্যালি তাঁর ‘হিস্টোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ (১৬১৪) বইয়ের বার বার জানিয়েছেন, আরারত পর্বতকে শুধু মাত্র আর্মেনিয়ার একটি পাহাড় ভাবলে ভুল হবে, তা আসলে এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রসারিত এক পর্বতশিরা। স্যর র্যালির মতে, নোয়ার নৌকা প্রাচ্যের কোথাও গিয়েই ঠেকেছিল।
০৭২১
খ্রিস্টধর্মের আদিপর্বে নোয়ার নৌকার অবশেষ আর্মেনিয়ার কোথাও রয়েছে বলে দাবি করা হতে থাকে। কিন্তু এর কোনও প্রমাণ কেউই দিতে পারেননি। খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে আর্মেনিয়ার সেন্ট জ্যাকব অফ নিসবিস নোয়ার নৌকা খোঁজার জন্য চেষ্টা চালিয়েছিলেন বলে এক কিংবদন্তি জন্ম নেয়। জ্যাকবকে নাকি এক দেবদূত এসে দেখা দেন এবং নোয়ার নৌকায় পৌঁছতে সাহায্য করেন।
ছবি: সংগৃহীত।
০৮২১
সপ্তম শতকে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তন নোয়ার নৌকার উপর ভিন্নতর আলোকপাত করতে শুরু করে। পবিত্র কোরান অনুসারে নূহ্ নবি বা নোয়ার নৌকা এশিয়া মাইনরের আনাতোলিয়া অঞ্চলের জুডি পর্বতে গিয়ে ঠেকেছিল। কোরান-এ এই পর্বতকে ‘কার্দু’ নামে উল্লেখ করা হয়েছিল।
০৯২১
পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য বা বাইজেন্টিয়ামের সম্রাট হেরাক্লিয়াস ৬২৮ বা ৬২৯ সাল নাগাদ নোয়ার নৌকার সন্ধানে অনুসন্ধান চালান বলে জানা যায়। আবার ইসলামি কিংবদন্তি জানায়, রাশিদুন খলিফা উমর ইবন আল-খত্তাব নিসবিসের কাছে নৌকার অবশেষ খুঁজে পান এবং সেই কাঠ দিয়ে এক মসজিদ নির্মাণ করান।
১০২১
একাদশ শতকে ক্রুসেড শুরু হলে পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে তথাকথিত প্রাচ্যের সরাসরি যোগাযোগ ঘটে। এত দিন পর্যন্ত আর্মেনিয়ার বাসিন্দারা আরারত পর্বতে নোয়ার নৌকা থাকার গল্পে বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু পশ্চিম ইউরোপীয় ক্রুসেডারদের দ্বারা তারা প্রভাবিত হয় এবং আরারত পর্বতের গল্পটিকে বিশ্বাস করতে শুরু করেন। কিন্তু আরারত পাহাড়ে কোনও অভিযান তারা চালাননি। কারণ, সেই পাহাড়ে ওঠা ধর্মীয় কারণে নিষিদ্ধ ছিল।
(ছবি: পিক্স্যাবে)
১১২১
পরবর্তী মধ্যযুগে নোয়ার নৌকার ধ্বংসাবশেষ নিয়ে বিভিন্ন খ্রিস্টীয় গ্রন্থে উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু সেই নৌকা বা আর্ক যে আস্ত অবস্থায় নেই, সে বিষয়েও খ্রিস্টীয় সন্ন্যাসীরা মত প্রকাশ করতে শুরু করেন।
(ছবি: উইকিপিডিয়া)
১২২১
১৯ শতকে জার্মান অভিযাত্রী ফ্রিডরিখ প্যারোট সর্বপ্রথম মাউন্ট আরারতে অভিযান চালান। তিনি তাঁর অভিযানের বৃত্তান্তে লিখেছিলেন যে, মাউন্ট আরারতের চূড়ায় যে নোয়ার নৌকা ঠেকেছিল, এ বিষয়ে আর্মেনীয়রা অটল বিশ্বাস রাখেন। আর সেই কারণেই তাঁরা এর চূড়ায় কাউকে উঠতে দিতে চান না। কিন্তু ১৮৭৬ সালে ব্রিটিশ অভিযাত্রী জেমস ব্রাইস মাউন্ট আরারত সফর করেন এবং লেখেন যে, সেখানে ৪ ফুট লম্বা এবং ৫ ইঞ্চি পুরু এক কাঠের তৈরি কাঠামোর সন্ধান তিনি পেয়েছিলেন, যা তাঁর মতে প্রাকৃতিক নয়। তিনি নোয়ার আর্ক হিসেবেই সেটিকে চিহ্নিত করেন এবং তার একটি টুকরো নিজের কাছে অভিযানের স্মারক হিসেবে রেখে দেন।
১৩২১
১৮৮৭ সালে সিরিয়ান খ্রিস্টধর্মের এক বিশেষ শাখার যাজক জন জোসেফ নুরি দাবি করেন, তিনি আরারত পর্বতের শীর্ষের কাছাকাছি নোয়ার আর্কের সন্ধান পেয়েছেন। কিন্তু তুরস্কের পণ্ডিতরা নুরির দাবি নস্যাৎ করে দেন।
১৪২১
এর পরে বেশ কিছু দিন নোয়ার আর্ক নিয়ে চর্চা খানিক স্তিমিত হয়ে যায়। পরে বিংশ শতকের মাঝামাঝি আবার মাথাচাড়া দেয় আর্ক-সন্ধান। ১৯৪০ সালে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে ভ্লাদিমির রস্কোভিৎস্কি নামের এক রুশ বৈমানিক জানান যে, মাউন্ট আরারতের উপর দিয়ে ওড়ার সময় তিনি নাকি এক বৃহৎ নৌকার কাঠামোর মতো কিছু একটা দেখতে পেয়েছিলেন বলে জানান।
(মাউন্ট আরারত, ছবি: উইকিপিডিয়া)
১৫২১
১৯৪৮-এ আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনার পিপল’স বাইবেল কলেজের ডিন আরন জে স্মিথ এবং ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ ইগারটন সাইকসের সঙ্গে আরারত পর্বতে আর্কের খোঁজে এক অভিযানের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু তত দিনে রাশিয়ার সঙ্গে আমেরিকার ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে। স্মিথ এবং সাইকসের কর্মকাণ্ডকে রুশ সংবাদমাধ্যম আপত্তিজনক বলে প্রচার করতে থাকে। কারণ মাউন্ট আরারত তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার একেবারে গায়েই অবস্থিত। স্মিথ ও সাইকসের অভিযানও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়।
১৬২১
১৯৫৯ সালে তুরস্কের এক ভূতাত্ত্বিক জরিপের সময় মাউন্ট তেন্দুরেকের এক অঞ্চলে বিশেষ আকৃতির একটি গঠন দেখতে পান সে দেশের এক সামরিক বৈমানিক। কিন্তু তার আগে স্থানীয় এক মেষপালক সেই অদ্ভুত আকৃতির ভৌগোলিক গঠনটিকে চিহ্নিত করেছিলেন। কিন্তু বৈমানিক ইলহান দুরুপিনার নেটো-র হয়ে এক জরিপ চালানোর সময় আকাশ থেকে নৌকাকৃতির এক কাঠামো দেখতে পান। কাঠামোটি ৪৫০ ফুট লম্বা এবং ১৫০ ফুট চওড়া। দুরুপিনরার সেটিকেই নোয়ার নৌকা বলে শনাক্ত করেন। কিন্তু পরের বছরেই আমেরিকান খ্রিস্টীয় মিশনারি জর্জ ভ্যান্ডেম্যান সেই অঞ্চলে এক অভিযান চালান এবং কাঠামোটিকে একটি প্রাকৃতিক বিষয় বলে জানান।
(দুরুপিনার সাইট, ছবি: উইকিপিডিয়া)
১৭২১
ভ্যান্ডেম্যানের ঘোষণা সত্ত্বেও দুরুপিনার সাইট নিয়ে মানুষের আগ্রহ কমেনি। ১৯৭৭, ১৯৭৯ এবং ১৯৮৪ সালে আমেরিকান চিকিৎসাকর্মী রন ইয়াট সেখানে যান। তাঁর প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে তুরস্কের সরকার ১৯৮৬ সালে দুরুপিনের সাইটকে জাতীয় উদ্যান হিসাবে ঘোষণা করে।
(দুরুপিনার সাইট, ছবি: সংগৃহিত)
১৮২১
আমেরিকান মহাকাশচারী জেমস আরউইন ১৯৭০ এবং ১৯৮০-র দশকে নোয়ার আর্কের সন্ধানে আরারত পর্বতে অভিযান চালান। কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে তাঁর অভিযান সফল হয়নি। মহাকাশচারী আরউইন তখন ঘোরতর ধার্মিক। তিনি মন্তব্য করেন যে, আর্কই তাঁদের সঙ্গে ছলনা করেছে।
১৯২১
নতুন সহস্রাব্দেও চালু থাকে নোয়ার নৌকা নিয়ে উন্মাদনা। হনলুলুর ধনকুবের ড্যানিয়েল ম্যাকগিভার্ন উপগ্রহ থেকে আরারত পর্বতের ছবি তোলার এক প্রকল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। সেই সব ছবিতে পর্বতের উত্তর-পশ্চিম ঢালে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন অঞ্চল ধরা পড়ে। ম্যাকগিভার্ন দাবি করেন সেগুলি নাকি নৌকার ধ্বংসাবশেষ। ২০১১ সাল পর্য়ন্ত তিনি মাউন্ট আরারতে বেশ কয়েকটি অভিযান চালান। তবে কোনওটিতেই ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়নি।
(ছবি: উইকিপিডিয়া)
২০২১
বলাই বাহুল্য, নোয়ার নৌকার হদিস আজ পর্যন্ত মেলেনি। যেমন আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি শেষ নৈশভোজে জিশুর ব্যবহার করা পানপাত্র বা সিনাই পর্বতে মোজেসের পাওয়া দশটি প্রত্যাদেশের দু’টি প্রস্তরখণ্ড। প্রকৃতপক্ষে মহাপ্রলয় বলে বিশ্বের বিভিন্ন পুরাণে যে কাহিনি বর্ণিত রয়েছে, তা যদি কখনও ঘটেও থাকে, তবে সেই আমলে কাঠ দিয়ে তৈরি কোনও নৌকার কাঠামো এত দিন টিকে থাকার কথা নয়। নোয়ার নৌকা বেঁচে আছে মানুষের কল্পনায়-বিশ্বাসে-সাহিত্যে-চলচ্চিত্রে।
(ছবি: উইকিপিডিয়া)
২১২১
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালে নোয়ার আর্ক-এর ভাবনাকে নিয়ে আমেরিকার কেন্টাকি স্টেটের উইলিয়ামসটাউনে গড়ে তোলা হয় ‘আর্ক এনকাউন্টার’ নামে এক থিম পার্ক। সেখানে বাইবেলের বর্ণনা মেনেই তৈরি হয় নোয়ার সুবিশাল নৌকা। তাতে রাখা হয় বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি। স্মৃতিতে মহাপ্লাবনকে রেখে অগণিত মানুষ বেড়াতে যান সেখানে।