২০১৮-তে চাকরি পেয়েছিলেন অঙ্কিতা। ২০২২-এর ২০ মে চাকরি হারান মন্ত্রীকন্যা। ববিতা সেই একই চাকরি হারালেন ২০২৩-এর ১৬ মে। চাকরি পেলেন অনামিকা। একই চাকরির মালিক বদলাল তিন বার।
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতাশেষ আপডেট: ১৬ মে ২০২৩ ১৭:০৩
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২৯
বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশেই স্কুলশিক্ষিকা পদে চাকরি পেয়েছিলেন, মঙ্গলবার তাঁর নির্দেশেই চাকরি হারান শিলিগুড়ির কন্যা ববিতা সরকার। তাঁর চাকরি দেওয়া হয় অনামিকা রায় নামে এক পরীক্ষার্থীকে। চাকরি হারানোর পর বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই নির্দেশকেই চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বৃহস্পতিবার ডিভিশন বেঞ্চের দ্বারস্থ হলেন ববিতা।
০২২৯
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশ প্রসঙ্গে বিচারপতি সুব্রত তালুকদার এবং বিচারপতি সুপ্রতিম ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ববিতার আইনজীবী ফিরদৌস শামিম। এর পরই ববিতাকে মামলা দায়েরের অনুমতি দেয় বিচারপতি তালুকদার এবং বিচারপতি ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চ। কেমন ছিল তাঁর লড়াইয়ের পথ?
০৩২৯
একটা শিক্ষক পদের চাকরি। যে চাকরি পেয়েছিলেন রাজ্যের তৎকালীন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীর কন্যা। বেআইনি ভাবে চাকরি পাওয়ার অভিযোগ প্রমাণ হতেই সেই চাকরি পান শিলিগুড়ির ববিতা। এই ঘটনায় রাজ্য জুড়ে তোলপাড় পড়ে গিয়েছিল গত বছর। লড়াইয়ের মুখ হিসাবে রাতারাতি চাকরিপ্রার্থীদের কাছে তারকায় পরিণত হন ববিতা।
০৪২৯
নতুন চাকরিতে ধাতস্থ হতে না হতেই মাস ছয়েকের মধ্যে ববিতার বিরুদ্ধেও নম্বরে কারচুপি করার অভিযোগ ওঠে। আদালতে সেই অভিযোগ প্রমাণও হল। ফলস্বরূপ মঙ্গলবার কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশে অন্য এক কন্যার হাতে গেল সেই চাকরি। তিনি শিলিগুড়িরই অন্য এক এসএসসি পরীক্ষার্থী অনামিকা। আর সেই চাকরির আসা-যাওয়ার মধ্যেই যেন ইতিহাস তৈরি করে ফেলল এই একটি চাকরি।
০৫২৯
২০১৬ সালে স্কুলশিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা হয়েছিল। যে পরীক্ষার মেধাতালিকা প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর। সেই তালিকায় অবশ্য ববিতার নাম ছিল প্রথম ২০তেই।
০৬২৯
হঠাৎ করেই এসএসসি সেই তালিকা বাতিল করে দেয়। প্রকাশিত হয় নতুন তালিকা। নতুন তালিকায় ববিতার নাম চলে যায় ওয়েটিং লিস্টে। আর তাঁর জায়গায় উঠে আসে পুরনো তালিকায় কোথাও না থাকা মন্ত্রীকন্যা অঙ্কিতার নাম!
০৭২৯
তালিকায় হঠাৎ এক ধাপ নীচে কী ভাবে, তালিকায় ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’ অঙ্কিতাই বা কে, তা তখনও জানতেন না ববিতা। পরে পরেশকন্যার পরিচয় জানতে পারেন। শুরু হয় ‘ন্যায্য’ চাকরি ফিরে পাওয়ার দাবিতে দৌড়ঝাঁপ।
০৮২৯
পরেশ আগে ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতা ছিলেন। ২০১৮ সালের ১৮ অগস্ট ফরওয়ার্ড ব্লক ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন। ঘটনাচক্রে, আর তার ঠিক তিন দিন পর অর্থাৎ ২১ অগস্ট এসএসসি-র নতুন মেধাতালিকা প্রকাশ করা হয়। সেই তালিকার একদম উপরে নাম ছিল অঙ্কিতার নাম। তার থেকে ১৬ নম্বর বেশি পাওয়ার পরও ববিতার নাম চলে যায় ওয়েটিং লিস্টে। প্রশ্ন ওঠে, তা হলে মেয়ের চাকরিই কি এই দল বদলের চুক্তির প্রধান ভিত্তি ছিল?
০৯২৯
একই অভিযোগ তোলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও। তাঁর দাবি ছিল, মেয়ের চাকরি-সহ তিনটি শর্তেই তৃণমূলে এসেছিলেন পরেশ। পরে লোকসভা ভোটে হারলেও যখন বিধানসভায় জিতলেন, তখন তাঁকে রাজ্যের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী করে দেওয়া হয়।
১০২৯
‘প্রভাবশালী’ মন্ত্রীর বিপক্ষে লড়াই কঠিন হবে জেনেও হাল ছাড়েননি ববিতা। প্রথমে প্রকাশিত এসএসসি-র র্যাঙ্ক কার্ড নিয়ে ধর্নামঞ্চ থেকে শুরু করে এসএসসি কর্তৃপক্ষ, ছোটাছুটি শুরু করেন ববিতা। এমনকি, তাঁর এবং অঙ্কিতার প্রাপ্ত নম্বর জানার জন্য তথ্য জানার অধিকার আইনেও প্রশ্ন করেন।
১১২৯
ববিতার অভিযোগ ছিল, তাঁর নিয়োগ যে সঠিক পদ্ধতিতে হয়নি, তা প্রথম থেকেই জানতেন অঙ্কিতা এবং মন্ত্রী পরেশ। তবুও শিক্ষকতার মতো পেশার সঙ্গে যুক্ত হতে দুর্নীতিকেই বেছে নেন তাঁরা।
১২২৯
তবে তত দিনে তিনি যে স্কুলের প্রাক্তনী ছিলেন সেই মেখলিগঞ্জের ইন্দিরা গার্লস হাই স্কুলে শিক্ষিকা হিসাবে যোগ দিয়ে দিয়েছেন অঙ্কিতা। বাড়ি থেকে স্কুল হাঁটাপথ। কাজে যোগ দেওয়ার প্রথম দিন অঙ্কিতাকে সঙ্গে করে স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলেন বাবা পরেশ। প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রীকে স্কুলে হাজির হতে দেখে শিক্ষিকা থেকে কর্মীদের একাংশ কিছুটা চমকেই উঠেছিলেন! কিন্তু কেউ কিছু বলেননি।
১৩২৯
রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্কিতার গবেষণা করা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্কিতা গবেষণাপত্রের কাজ করতে যাওয়ার সময় তাঁর ছায়াসঙ্গী হিসাবে থাকতেন পরেশ।
১৪২৯
এর মধ্যেই আদালতের নির্দেশে সিবিআইয়ের হাতে পৌঁছয় এই নিয়োগ দুর্নীতি মামলা। অঙ্কিতা কী ভাবে চাকরি পেলেন, তা এর পরই খতিয়ে দেখা শুরু করে সিবিআই। পরেশকে সিবিআইয়ের সামনে হাজিরার নির্দেশও দেওয়া হয়।
১৫২৯
পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখে আদালতে রিপোর্ট জমা দেয় সিবিআই। এর পর ২০ মে নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির কারণে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশে চাকরি যায় অঙ্কিতার। হাই কোর্ট এ-ও নির্দেশ দেয়, অঙ্কিতাকে সরকারের কাছ থেকে নেওয়া সমস্ত বেতনও ফেরত দিতে হবে। দু’টি কিস্তিতে ওই টাকা ফেরানোর নির্দেশ দেওয়া হয় অঙ্কিতাকে।
১৬২৯
আদালতের নির্দেশে অঙ্কিতার সেই চাকরি যায় ববিতার কাছে। অঙ্কিতার যে স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন সেই মেখলিগঞ্জ ইন্দিরা গার্লস হাই স্কুলেই চাকরি পান ববিতা। অঙ্কিতার বেতনের টাকাও দেওয়া হয় তাঁকেই। শিলিগুড়িতে জয়জয়কার পড়ে যায় ববিতার নামে।
১৭২৯
নতুন চাকরি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন ববিতা। সব ঠিকই চলছিল। কিন্তু চাকরি পাওয়ার ৬ মাসের মধ্যে প্রশ্নের মুখে পড়ে ববিতার নিয়োগও। ববিতার চাকরি বাতিলের দাবিতে হাই কোর্টের দ্বারস্থ হন তাঁরই শহরের অনামিকা।
১৮২৯
অনামিকার অভিযোগ ছিল, স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি)-এর কাছে আবেদন করার সময় স্নাতক স্তরের শতকরা নম্বর বাড়িয়ে দেখান ববিতা। যার ফলে তাঁর ‘অ্যাকাডেমিক স্কোর’ বেড়ে যায়।
১৯২৯
সেখান থেকেই তৈরি হয় যাবতীয় জটিলতা। ববিতার আবেদনপত্র অনুযায়ী, স্নাতক স্তরে ৮০০ নম্বরের মধ্যে ৪৪০ নম্বর পেয়েছিলেন ববিতা। অর্থাৎ, শতকরা হিসাবে ৫৫ শতাংশ। অথচ, স্নাতক স্তরের প্রাপ্ত নম্বরের শতকরা হিসাব ৬০ শতাংশ বা তার বেশি উল্লেখ করা হয়েছে আবেদনপত্রে। অর্থাৎ, ‘ভুল’ সেখানেই। যে কারণে ববিতার ‘অ্যাকাডেমিক স্কোর’ গণনায় ভুল হয়েছে।
২০২৯
নিয়োগের দাবিতে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকা চাকরিপ্রার্থীদের একাংশের দাবি ছিল ববিতার বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্যি হলে, সে ক্ষেত্রে ববিতার ‘অ্যাকাডেমিক স্কোর’ ৩৩-এর বদলে কমে ৩১ হবে। এতে র্যাঙ্কিংয়েও অনেকটাই পিছিয়ে পড়বেন ববিতা!
২১২৯
অনামিকার দাবি, ববিতার র্যাঙ্কিং পিছিয়ে গেলে যোগ্য প্রার্থী হিসাবে ২০ জনের তালিকার শেষে তাঁর নাম উঠে আসবে। ফলে চাকরি তাঁরই পাওয়ার কথা। এই নিয়েই আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন অনামিকা।
২২২৯
সেই মামলার শুনানি চলাকালীন, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় ববিতাকে এমন নির্দেশও দিয়েছিলেন, অঙ্কিতার বেতনের যে টাকা তাঁকে দেওয়া হয়েছিল, তা যেন ববিতা আলাদা করে সরিয়ে রাখেন। ভবিষ্যতে তা তাঁকে ফেরত দিতে হতে পারে বলেও জানিয়েছিলেন বিচারপতি।
২৩২৯
সেই মামলার শুনানি শেষ হয়েছিল আগেই। রায় ঘোষণা হল মঙ্গলবার। রায় ঘোষণা করে কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে চাকরি হারালেন ববিতা। মধ্যশিক্ষা পর্ষদকে ববিতার চাকরি বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়।
২৪২৯
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশ, ববিতার চাকরি পাবেন অনামিকা। স্কুল সার্ভিস কমিশনকে (এসএসসি) অনামিকাকে চাকরির সুপারিশপত্র দিতে হবে বলেও জানিয়েছে কলকাতা হাই কোর্ট। নির্দেশ, অনামিকাকে বাড়ির কাছে কোনও স্কুলে চাকরির সুপারিশ দিতে হবে। তিন সপ্তাহের মধ্যে এই নির্দেশ কার্যকর করার নির্দেশও দিয়েছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়।
২৫২৯
একই সঙ্গে, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় নির্দেশ দিয়েছেন, আগামী ৬ জুনের মধ্যে ববিতাকে ১৫ লক্ষ ৯২ হাজার ৮৪৩ টাকা হাই কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে জমা দিতে হবে। হাই কোর্টের রেজিস্ট্রার সেই টাকা নতুন চাকরি প্রাপক অনামিকার হাতে তুলে দেবেন।
২৬২৯
তবে এত দিনে চাকরির জন্য যে বেতন পেয়েছেন ববিতা, সেই টাকা তাঁকে ফেরত দিতে হবে না। অঙ্কিতার চাকরি যাওয়ার পর তাঁর টাকা বিভিন্ন কিস্তিতে ববিতাকে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সেই নির্দেশ মতো যে টাকা পেয়েছিলেন ববিতা, সেই টাকা ফেরত দিতে মঙ্গলবার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি।
২৭২৯
ববিতার অবশ্য দাবি, এক বছর চাকরি করার পর চাকরি কেড়ে নেওয়া কাম্য নয়। কমিশনের তাঁর নথি তখনই খতিয়ে দেখা উচিত ছিল বলেও তাঁর দাবি।
২৮২৯
নিয়োগের দাবিতে আন্দোলনে যুক্ত থাকা চাকরিপ্রার্থীদের দাবি, এই চাকরির যোগ্য প্রাপক ছিলেন না অঙ্কিতা এবং ববিতা। চাকরি যাঁর প্রাপ্য তাঁর কাছেই গিয়েছে।
২৯২৯
২০১৮-তে চাকরি পেয়েছিলেন অঙ্কিতা। ২০২২-এর ২০ মে চাকরি হারান মন্ত্রীকন্যা। ববিতা সেই একই চাকরি হারালেন ২০২৩-এর ১৬ মে। চাকরি পেলেন অনামিকা। একই চাকরির মালিক বদলাল তিন বার। মাঝখানে কেটে গেল পাঁচ বছর। সম্পূর্ণ হল একটি চাকরিকে কেন্দ্র করে তিন কন্যার লড়াইয়ের বৃত্ত।