২০২১ সালে উত্তরাখণ্ডের বিধ্বংসী বন্যা সামলে নিলেও ভূমিধস এবং বাড়ি-রাস্তার ফাটল সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সেখানকার সাধারণ মানুষকে। আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে সেখানে বসবাসকারী শত শত পরিবার।
নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতাশেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২৩ ১১:১৯
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২৮
ধ্বংসের মুখে উত্তরাখণ্ডের জোশীমাঠ! ধীরে ধীরে মাটির নীচে তলিয়ে যাচ্ছে গাড়োয়াল হিমালয়ের এই গুরুত্বপূর্ণ জনপদ। বিপদের মুখে পড়েছেন ছোট্ট শহরে বসবসকারী মানুষজন।
০২২৮
চামোলি জেলার শহর জোশীমঠ পরিচিত ‘গেটওয়ে অফ গাড়োয়াল’ নামেও। অনেকের কাছে এই শহর পরিচিত ‘জ্যোতির্মঠ’ হিসাবে। ২০১১ সালের জনশুমারি অনুযায়ী, জনসংখ্যা সর্বসাকুল্যে ১৬ হাজার ৭০৯।
০৩২৮
কথিত আছে, সমতল থেকে প্রায় ১ হাজার ৮৭৫ মিটার উচ্চতায় থাকা জোশীমঠ শহর আদি শঙ্করাচার্য দ্বারা প্রতিষ্ঠিত চারটি প্রধান পীঠের একটি। গাড়োয়াল হিমালয় পর্বত অভিযান এবং পর্বতারোহণের জন্য এই শহরে প্রতি বছর প্রচুর মানুষ ভিড় জমান। বদ্রীনাথ এবং হেমকুণ্ড সাহিবগামী হিন্দু এবং শিখ তীর্থযাত্রীদের অন্যতম প্রধান আশ্রয়স্থল এই শহর। সেই জোশীমঠই এ বার বিপদের মুখে।
০৪২৮
২০২১ সালে উত্তরাখণ্ডের বিধ্বংসী বন্যা সামলে নিলেও ভূমিধস এবং বাড়ি-রাস্তার ফাটল সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সেখানকার সাধারণ মানুষকে। আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে সেখানে বসবাসকারী শত শত পরিবার।
০৫২৮
সে রাজ্যের সরকারের নির্দেশে বৃহস্পতিবার রাত থেকেই খালি করা শুরু হয়েছে শহরের ভাঙনের মুখে পড়া বাড়িগুলি। বাসিন্দাদের আশ্রয় শিবিরে নিয়ে যেতেও তোড়জোড় শুরু হয়। শুক্রবার বিকাল থেকে রাস্তাঘাট এবং বাড়িঘরের ফাটল বাড়তেই আরও তৎপর হয় প্রশাসন। স্থানীয়দের দ্রুত অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যেতে হেলিকপ্টারের ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
০৬২৮
বৃহস্পতি এবং শুক্রের পর উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিংহ ধামী শনিবারও একটি মন্দির এবং বেশ কয়েকটি বাড়ির অবস্থা দেখতে জোশীমঠ যাবেন বলে সূত্রের খবর। প্রায় ৬০০ পরিবারকে দ্রুত সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ তিনি দিয়েছেন।
০৭২৮
একটি ভিডিয়োবার্তায় ধামী বলেন, ‘‘জীবন বাঁচানো আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার। জোশীমঠের বিপন্ন বাড়িগুলিতে বসবাসকারী প্রায় ৬০০ পরিবারকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে প্রশাসনকে।’’
০৮২৮
উদ্ধারকাজ চলতেই চলতেই যদি কোনও বড়সড় বিপদ ঘটে যায়, সেই উদ্বেগ থেকেই তৈরি রাখা হয়েছে মেডিক্যাল দল। পরিস্থিতি খুব ভাল ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে তৈরি করা হয়েছে কন্ট্রোল রুমও। সেখানে মোতায়েন থাকবে রাষ্ট্রীয় এবং জাতীয় দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া বাহিনী।
০৯২৮
জোশীমঠের মাড়োয়ারি এলাকা বর্তমানে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। সেখানে মাটি ফেটে প্রবল বেগে ক্রমাগত ভূগর্ভস্থ জল বেরিয়ে আসছে বলে সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর।
১০২৮
এই আবহে জোশীমঠের বাসিন্দারা আতঙ্কে দিন তো কাটাচ্ছিলেনই, তবে শুক্রবার বিকালে একটি মন্দির হুড়মুড়িয়ে ভেঙে যাওয়ার পর আরও বেশি আতঙ্ক তৈরি হয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।
১১২৮
জোশীমঠের যে বাসিন্দাদের এখনও উদ্ধার করা হয়নি, সব থেকে খারাপ অবস্থায় রয়েছেন তাঁরা। শীতের মরসুমে হাড়কাঁপানো শীতেও বাড়ির ভিতরে পা দিতে চাইছেন না তাঁরা।
১২২৮
শৈত্যপ্রবাহে কাবু হয়ে গেলেও বাড়ি থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বার করে এনে রাস্তাতেই রাত কাটাচ্ছেন তাঁরা। অপেক্ষা করছেন, কখন তাঁদের আশ্রয় শিবিরে যাওয়ার পালা আসবে।
১৩২৮
জীবন বাঁচানোর তাগিদ থাকলেও বাপ-ঠাকুরদাদের তৈরি বাড়ি ছেড়ে যেতে হচ্ছে বলে বিষণ্ণতাও ছড়িয়ে পড়েছে তাঁদের চোখে-মুখে। রয়েছে চাপা ক্ষোভও।
১৪২৮
স্থানীয়দের দাবি, ‘উন্নয়নের জোয়ারেই’ তলিয়ে যাওয়ার পথে জোশীমঠ। তাঁদের কথায় বিগত কয়েক দশকে ওই এলাকায় পরিকাঠামোগত উন্নতি করতে গিয়ে আখেরে বিপদই হয়েছে।
১৫২৮
বড়সড় নির্মাণকাজ, গাছ কাটা, পাহাড় কেটে সুড়ঙ্গ তৈরি করা এবং ধাপ কেটে নতুন জনবসতি তৈরির প্রচেষ্টায় আলগা হয়েছে জোশীমঠের মাটি। আর তার জেরেই বর্তমানে এই পরিস্থিতি।
১৬২৮
তবে জোশীমঠ যে হুড়মুড়িয়ে মাটির নীচে চলে যেতে পারে, তা আঁচ করা হয়েছিল অন্তত ৪৭ বছর আগে! জানানো হয়েছিল ১৯৭৬ সালে মিশ্র কমিটি নামে একটি সমীক্ষক দলের রিপোর্টে।
১৭২৮
মিশ্র কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, হিমালয়ের ধসপ্রবণ এলাকার উপরে গড়ে উঠেছে এই শহর। প্রাকৃতিক ও মানুষের কর্মকাণ্ডের জেরে জোশীমঠের স্থায়িত্ব বড়জোর ১০০ বছর বলেও রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল।
১৮২৮
রিপোর্টে বলা হয়েছিল ১০০ বছরের মধ্যেই ধীরে ধীরে মাটির নীচে ধসে যাবে হিমালয়ের কোলে থাকা এই শহর। কিন্তু ১০০ বছরও গেল না। ৪৭ বছরেই পরিস্থিতির জেরে জোশীমঠের অস্তিত্ব থাকবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
১৯২৮
১৯৭৬-এর রিপোর্টে ধস কী ভাবে রোখা যায়, সেই পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল। জানানো হয়েছিল ভূমিধস আটকাতে বোল্ডার না সরানো, বড়সড় নির্মাণকাজ বন্ধ রাখা, গাছ না কাটার মতো বিষয়গুলিতে বিশেষ নজর রাখা উচিত।
২০২৮
তবে সে সব সতর্কবার্তা উড়িয়ে দিনে দিনে বেড়েছে শহরের পরিধি। বেড়েছে ব্যবসা এবং জনঘনত্ব। পাহাড়ে ধাপ কেটে, সুড়ঙ্গ খুঁড়ে তৈরি হয়েছে রাস্তাঘাট। তৈরি হয়েছে একের পর এক জলাধার এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্পও। ক্রমেই প্রাকৃতিক শহর থেকে বাণিজ্যিক শহরে পরিণত হয়েছে জোশীমঠ। ফাঁপা হয়েছে মাটির তলাও।
২১২৮
তবে মানুষের কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি শহরের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকেও দায়ী করেছেন স্থানীয়রা।
২২২৮
প্রসঙ্গত, জোশীমঠ কেন ধীরে ধীরে মাটির নীচে ধসে যাচ্ছে, তা খুঁজে বার করতে রাজ্য সরকারের তরফে বিশেষজ্ঞদের একটি দল গঠন করা হয়েছিল। এ বার বিশেষজ্ঞদের একটি দল গঠন করা হল কেন্দ্রের তরফেও।
২৩২৮
বিগত কয়েক দিন ধরেই ক্রমাগত বসে যাচ্ছে জোশীমঠের জমি। ফাটল ধরছে একের পর এক বাড়িতে। রাস্তাতেও যেখানে-সেখানে ফাটল ধরতে দেখা যাচ্ছে। মাটির তলা থেকে উঠে আসছে অদ্ভুত শব্দ। এর পরই জোশীমঠের আতঙ্কিত স্থানীয়রা তাঁদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার দাবিতে পথে নামেন।
২৪২৮
মাটি বসে যাওয়ার কারণে এ পর্যন্ত চামোলি জেলার এই শহরে সাড়ে পাঁচশোরও বেশি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিংধর জৈন, মাড়ওয়ারি, জেপি কলোনির মতো শহরের বেশ কিছু অঞ্চলে প্রতি দিন মাটি বসে গিয়ে নতুন করে ফাটল দেখা দিচ্ছে ঘরবাড়িতে।
২৫২৮
গাড়োয়াল হিমালয়ের গুরুত্বপূর্ণ জনপদ জোশীমঠ ধউলিগঙ্গা এবং অলকানন্দার সঙ্গমস্থল বিষ্ণুপ্রয়াগ এই স্থান থেকে মাত্র ১৩ কিলোমিটার দূরে। কথিত আছে, আগে জয়ত্রীমঠ নামে পরিচিত ছিল জোশীমঠ। বর্তমানে উত্তরাখণ্ডের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটককেন্দ্রের বর্তমান পরিস্থিতিতে আতঙ্কে পর্যটকেরাও।
২৬২৮
উত্তরাখণ্ডের বহু পর্যটনস্থলে যাওয়া যায় জোশীমঠ হয়ে। জোশীমঠ থেকে মাত্র ৪৬ কিলোমিটার দূরে বদ্রিনাথ। শীতকালে যখন বদ্রিনাথে মন্দিরের দ্বার বন্ধ হয়ে যায়, তখন বদ্রিবিশাল পূজিত হন জোশীমঠের বাসুদেব মন্দিরে। জোশীমঠ থেকে ট্রেক করে যাওয়া যায় নন্দাদেবী ন্যাশনাল পার্ক। ‘ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স’ নামেও যা পরিচিত। গাড়োয়াল হিমালয়ের প্রবেশদ্বার বলা হয় জোশীমঠকে। দয়রা বুগিয়াল, চন্দ্রভাগা লেক, তপোবন, বিষ্ণুপ্রয়াগের, কিংবা হেমকুণ্ডের মতো স্থানে পায়ে হেঁটে যেতে হলে এক রাত কাটাতে হয় জোশীমঠে।
২৭২৮
উত্তরাখণ্ডের ২,৬০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত জনপ্রিয় হিল স্টেশন জোশীমঠ। প্রশ্ন উঠছে জোশীমঠ ধ্বংস হয়ে গেলে এই সব অঞ্চলে ট্রেকিংয়ে যাওয়ার কী হবে, তা নিয়েও।
২৮২৮
জোশীমঠে বার বার হয়েছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। বার বার নেমেছে ভূমিধস। সেই অতীত থেকে। বর্তমানেও এই অঞ্চল যেন বসে আছে সর্বনাশের আশায়।