বেজিঙের বাজারে পাকিস্তানি গাধার বিপুল চাহিদার মূল কারণ হল ‘এজিয়াও’। এটি প্রকৃতপক্ষে ঐতিহ্যবাহী চিনা ওষুধের মূল উপাদান, যা তৈরি হয় গর্দভচর্মের আঠা দিয়ে। ড্রাগনভূমির আমজনতার একটি বড় অংশের বিশ্বাস, নিয়মিত ‘এজিয়াও’ সেবনে বৃদ্ধি পায় রক্ত সঞ্চালন, বাড়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং শরীরে বাসা বাঁধতে পারে না ক্যানসার।
বালুচিস্তানের গ্বদর বন্দর শহরে গাধার কসাইখানা খোলাকে পাক অর্থনীতি এবং সামাজিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন বলা যাবে কি না, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই তর্ক শুরু হয়ে গিয়েছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিতে গাধা খাওয়া নিষিদ্ধ। ফলে পশ্চিমের প্রতিবেশী রাষ্ট্রটিতে চারপেয়ে পশুটির সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইসলামাবাদের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর সারা দেশে গর্দভের সংখ্যা ছিল ৫৫ লক্ষ, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে গ্বদরে গাধার কসাইখানা খোলার উপযোগিতার ব্যাখ্যা দেন পাকিস্তানের ‘ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি’র খাদ্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটির নেতা রানা মহম্মদ হায়াত। তাঁর কথায়, ‘‘জীবিত গাধা রফতানি করা অনেক বেশি কঠিন। এতে লাভের সম্ভাবনাও কম। আর তাই কসাইখানা খুলে গর্দভ-উপজাত দ্রব্য বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’’
কিন্তু তা সত্ত্বেও গ্বদরে গাধার কসাইখানা প্রতিষ্ঠা নিয়ে পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটিতে উঠেছে বিতর্কের ঝড়। বালুচিস্তানের ধর্মীয় নেতারা নির্বিচারে শয়ে শয়ে গাধা জবাইয়ের বিরোধিতা করেছেন। তাঁদের যুক্তি, গরিব পাক নাগরিকেরা পরিবহণের ক্ষেত্রে অনেকাংশেই এই প্রাণীটির উপর নির্ভরশীল। তা ছাড়া এতে অচিরেই গর্দভের সংখ্যার উপর ব্যাপক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর তাতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে।
গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকের পরবর্তী সময়ে ঘরোয়া বাজারে ‘এজিয়াও’র চাহিদা বৃদ্ধি পেলে আফ্রিকার দেশগুলি থেকে গর্দভচর্ম আমদানি শুরু করে বেজিং। কিন্তু পরবর্তী কালে গাধা রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে আফ্রিকান ইউনিয়ন। তার পর থেকেই বিশেষ এই চারপেয়ে প্রাণীটির জন্য ক্রমাগত পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকেছে ড্রাগনভূমির সরকার। গ্বদরের কসাইখানা সেই চাহিদা পূরণ করবে বলে আশা করছে তারা।
নির্বিচারে গাধা হত্যায় সৃষ্ট পরিবেশগত কুফলের পাশাপাশি ‘এজিয়াও’র ব্যাপারে আরও একটি সতর্কবার্তা দিয়েছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁদের দাবি, এতে মোটা লাভের সুযোগ থাকায় গাধা চুরি বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শুরু হতে পারে চারপেয়ে প্রাণীটির ব্যাপক চোরাচালান। এতে পাক সমাজে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তবে এই সমস্ত সতর্কবার্তাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে শাহবাজ় শরিফ সরকার। কারণ এখনও পাক অর্থনীতির একটি বড় অংশই পশুজাত পণ্য রফতানির উপর নির্ভরশীল। ২০১৫-’১৬ এবং ২০১৬-’১৭ আর্থিক বছরে আফগানিস্তানে যথাক্রমে ২৮ লক্ষ ও ৪ লক্ষ ৪৭ হাজার ডলার মূল্যের শূকরের মাংস পাঠিয়েছিল ইসলামাবাদ। ওই সময়ে হিন্দুকুশ পাহাড়ের কোলের দেশটিতে মোতায়েন ছিল মার্কিন শক্তিজোট নেটোর বাহিনী। মূলত, তাঁদের জন্যই ওই মাংস রফতানি করা হয়েছিল।
২০১৩ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে সিপিইসি নিয়ে চুক্তি করে ড্রাগন সরকার। প্রাথমিক ভাবে এতে ৪,৬০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ হলেও পরবর্তী কালে সেই অঙ্ক বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার কোটি ডলারে। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে পশ্চিম চিনের শিনজিয়াং প্রদেশের কাশগড় থেকে শুরু হয়ে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের কারাকোরাম পেরিয়ে ১,৩০০ কিলোমিটার লম্বা রাস্তা শেষ হবে গ্বদর বন্দরে। এই সুদীর্ঘ সড়কপথকে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ কর্মসূচির অন্যতম প্রধান অঙ্গ বলে জানিয়েছে বেজিং।
সিপিইসি প্রকল্পে গ্বদরকে আগামী দিনের সিঙ্গাপুরের জাহাজশিল্পের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু, সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে বালুচিস্তানের বন্দর শহর। কিছু দিন আগে সেখানে একটি বিমানবন্দরের উদ্বোধন করে শাহবাজ় সরকার। কিন্তু আর্থিক দিক থেকে সেখানকার উড়ান পরিষেবা কতটা লাভজনক হবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
গ্বদর পর্যন্ত চলা সিপিইসি প্রকল্প নিয়ে প্রবল আপত্তি রয়েছে বালুচিস্তানের আমজনতার। তাদের অভিযোগ, এর মাধ্যমে পাক সরকার গোটা প্রদেশটিকেই বেজিঙের গোলামে পরিণত করেছে। চিন-পাকিস্তান আর্থিক করিডরের জেরে স্থানীয়েরা কর্মসংস্থান হারাচ্ছেন বলে উঠেছে অভিযোগ। ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমের পাক প্রদেশটিতে বাড়ছে সশস্ত্র আন্দোলন।
এই পরিস্থিতিতে গ্বদরে চিনা সংস্থার নিয়ন্ত্রণাধীনে গাধার কসাইখানা খোলায় পরিস্থিতি জটিল হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ। তাঁদের অনুমান, সংশ্লিষ্ট কসাইখানায় গাধার জোগান ঠিক রাখতে আম বালুচ নাগরিকের পোষা গাধাকেও জোর করে সেখানে পাঠাবে পাক প্রশাসন। ফলে আগামী দিনে সেখানকার সশস্ত্র গোষ্ঠী বালুচ লিবারেশন আর্মি বা বিএলএর নিশানায় আসতে পারে ওই গর্দভ কসাইখানা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy