দেশের সর্ববৃহৎ স্টক এক্সচেঞ্জ হিসাবে পরিচিত ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ নিজেদেরই শেয়ার স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকাভুক্ত করতে চায়। সংস্থার কিছুটা অংশ জনগণের হাতে তুলে দিয়ে তার লভ্যাংশ নিয়ে মূলধন বাড়ানোর পথে হাঁটতে চায় এনএসই।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০২৫ ১৫:২৮
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
ভারতীয় শেয়ার বাজারে স্বচ্ছতা আনার জন্য ১৯৯২ সালে জন্ম নিয়েছিল ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ। দেশের বিভিন্ন বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেমন ব্যাঙ্ক এবং বিমা সংস্থার মালিকানাধীন মুম্বইস্থিত ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ বা এনএসই।
০২২০
আইপিওর মাধ্যমে শেয়ার বাজার থেকে মুনাফা তোলার জন্য নতুন করে তোড়জোড় শুরু করেছে ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ। শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি। দেশের সর্ববৃহৎ স্টক এক্সচেঞ্জ হিসাবে পরিচিত ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ নিজেদেরই শেয়ার স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকাভুক্ত করতে চায়। সংস্থার কিছুটা অংশ জনগণের হাতে তুলে দিয়ে তার লভ্যাংশ নিয়ে মূলধন বাড়ানোর পথে হাঁটতে চায় এনএসই।
০৩২০
ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ (এনএসই) বেশ কয়েক বছর ধরেই তাদের আইপিও (ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং) পরিকল্পনা করছে। প্রকৃতপক্ষে, এনএসই তাদের প্রস্তাব সেবির কাছে ২০১৬ সালে দাখিল করেছিল। ২০২০ সাল থেকে এনএসইর আইপিও আনার খবর বহু বার প্রকাশ্যে এসেছে। গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক বাধা এবং অন্যান্য কারণে সংস্থার বহু প্রতীক্ষিত আইপিও আনার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি হয়ে চলেছে।
০৪২০
আইপিও হল এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে বেসরকারি সংস্থাগুলির অংশ সর্বসাধারণের কাছে শেয়ারে লেনদেন করার জন্য স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয় এবং এটি বেসরকারি সংস্থাকে বিভিন্ন বিনিয়োগের জন্য মূলধন বাড়ানোর অনুমতি দেয়। বলা যেতে পারে, এটি একটি বেসরকারি সংস্থা বা কোম্পানিকে পাবলিক কোম্পানিতে রূপান্তরিত করার একটি প্রক্রিয়া।
০৫২০
আইপিও কী ভাবে কাজ করে? আইপিওতে বিনিয়োগের সমস্ত প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রক হল সেবি। আইপিওর মাধ্যমে শেয়ার ইস্যু করতে ইচ্ছুক একটি সংস্থাকে প্রথমে সেবিতে নথিভুক্ত হতে হয়। সেবির সমস্ত নথি যাচাই করার পর সঠিক মনে হলে তার পরে এটি অনুমোদন পায়।
০৬২০
দুই পক্ষের মধ্যে বছরের পর বছর ধরে টানাপড়েনের পর এনএসই আবার তাদের শেয়ার তালিকাভুক্ত করার অনুমতি চেয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা সেবিকে চিঠি দিয়েছে। ভারতীয় ইকুইটি বাজারে আইপিও আনার জন্য যে দু’টি বাজারে তালিকাভুক্ত সংস্থায় নাম নথিভুক্ত করতে হয় তারই একটি নিজেদের আইপিও আনার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এই খবরে বিনিয়োগকারীদের মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জেগেছে।
০৭২০
৯০-এর দশকে অর্থনীতির উদারীকরণের সূচনা হওয়ার পর থেকে সংস্থাগুলির বড় রকমের বিনিয়োগের প্রয়োজন হতে থাকে। সংস্থাগুলির নিজেদের অংশ বেচাকেনা করে বিনিয়োগ আনার জন্য এমন একটি সংস্থার প্রয়োজন হয় যেখানে সংস্থাগুলি তালিকাভুক্ত হতে পারে। সেখান থেকেই এনএসইর পথচলা শুরু। সূচনালগ্নে এলআইসি, এসবিআইয়ের মতো বিমা ও ব্যাঙ্কিং সংস্থাগুলির সাড়ে ১০ শতাংশের মতো বিনিয়োগ নিয়ে গড়ে ওঠে এই এক্সচেঞ্জ।
০৮২০
১৯৯২ সালে গ়ড়ে ওঠা এক্সচেঞ্জে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী ২৬৭১টি সংস্থা নাম তালিকাভুক্ত রয়েছে। এনএসইর তালিকায় থাকা ৫০টি প্রধান সংস্থার শেয়ারের দর ওঠানামার সূচককে বলা হয় নিফটি ৫০। আন্তর্জাতিক স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকায় এনএসইর স্থান ষষ্ঠ। সেখানে বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের (বিএসই) স্থান আট নম্বরে। তালিকার প্রথমে রয়েছে আমেরিকার নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ।
০৯২০
২১ কোটি অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করা হয় এনএসইতে। লেনদেন হয় কয়েক হাজার কোটি ডলারের। ২০১২ সালে ইংল্যান্ডের শেয়ার বাজারে লেনদেনের জন্য একটি চুক্তি করে এনএসই। এর ফলে ভারতে বসে যে কেউ সেখানকার শেয়ার বাজারে লেনদেন করতে পারেন।
১০২০
ধীরে ধীরে আড়েবহরে বেড়ে ওঠার পর এনএসই পরিকল্পনা শুরু করে অন্যান্য সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার মতো নিজেদের শেয়ার নথিভুক্ত করার। লিমিটেড থেকে পাবলিক কোম্পানিতে পরিণত হতে ২০১৬ সালে আইপিও আনার প্রস্তাব রাখে সেবির কাছে।
১১২০
২০১৬ সালের ডিসেম্বরে তার ‘ড্রাফট রেড হেরিং প্রসপেক্টাস’ পেশ হয় বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে। তার আগেই ২০১৫ সালে সেবির কাছে একটি সূত্র মারফত খবর আসে, এনএসইর অভ্যন্তরে ঘটে চলেছে দুর্নীতি। আর্থিক দুর্নীতির পরিমাণ আনুমানিক ৫০ হাজার কোটি থেকে ৭৫ হাজার কোটি টাকা।
১২২০
ফলে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার আইপিওর প্রস্তাবনার সেই ফাইল আটকে দেয় সেবি। সেবির হাতে আসা তিনটি বেনামি চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হয় তদন্ত।
১৩২০
তদন্তে উঠে আসে এক অভাবনীয় দুর্নীতির কথা। সেটির নাম ‘কো-লোকেশন’ দুর্নীতি। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে এনএসই তাদের তালিকাভুক্ত সদস্যদের জন্য একটি কো-লোকেশন সুবিধা দেওয়া শুরু করে। সদস্যেরা একটি নির্দিষ্ট মূল্যের পরিবর্তে এক্সচেঞ্জের অফিসের মধ্যেই তাদের সার্ভার স্থাপন করতে পারত। এর ফলে যাদের সার্ভার এক্সচেঞ্জের মধ্যেই থাকত তারা এনএসইর প্রধান ট্রেডিং সার্ভারে দ্রুত প্রবেশ করতে পারতেন।
১৪২০
যে সব সংস্থার সার্ভার এনএসই কার্যালয়ে বসানো থাকত, কয়েক মিলি সেকেন্ডের ব্যবধানে লেনদেনের সুবিধা তারা পেত, তেমনটাই অভিযোগ ওঠে স্টক এক্সচেঞ্জটির বিরুদ্ধে। ধরা যাক, কেউ দিল্লিতে বসে লেনদেন চালাচ্ছেন। শেয়ার কেনা বা বেচার জন্য তাঁর সার্ভার থেকে এক্সচেঞ্জের সার্ভারে সেই বার্তা আসতে যতটা সময় লাগবে, তার কয়েক মিলি সেকেন্ড আগেই সংস্থায় বসানো সার্ভার থেকে সেই একই শেয়ার লেনদেন তত ক্ষণে সম্পন্ন হয়ে গিয়েছে। ফলে দিল্লিতে থাকা সার্ভারের পক্ষে সেই লেনদেনটি হাতছাড়া হয়ে যায়। অন্য ব্রোকারদের থেকে কিছুটা সময় আগেই লেনদেনের জন্য লগ-ইন করে মুনাফা লুটত কো-লোকেশনের সুবিধা পাওয়া সংস্থাগুলি।
১৫২০
কো-লোকেশনের ফায়দা তুলে কয়েকশো কোটি টাকার মুনাফা কামায় এনএসই। এমনটাই অভিযোগ জমা পড়ে সেবির কাছে। কো-লোকেশন দুর্নীতির মামলার তদন্তে এনএসইর প্রাক্তন ম্যানেজিং ডিরেক্টর তথা চিফ এগজ়িকিউটিভ অফিসার (সিইও) চিত্রা রামকৃষ্ণ এবং প্রাক্তন গ্রুপ অপারেটিং অফিসার (জিওও) আনন্দ সুব্রহ্মণ্যমকে গ্রেফতার করে সিবিআই। তাঁদের বিরুদ্ধে ঘুষ নিয়ে বিশেষ সংস্থাকে কো-লোকেশনের সুবিধা পাইয়ে দেওয়া, আর্থিক অনিয়ম এবং নিয়ম ভেঙে কর্মীদের পদোন্নতি দেওয়ার অভিযোগও জমা পড়ে।
১৬২০
ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ (এনএসই)-এর কো-লোকেশন দুর্নীতির মামলায় দেশ জুড়ে তল্লাশি অভিযান চালায় সিবিআই। তদন্তকারী সংস্থার তরফে কলকাতা, দিল্লি, মুম্বই, গাঁধীনগর, নয়ডা, গুরুগ্রাম-সহ বিভিন্ন শহরে তল্লাশি অভিযান চলে। এর মধ্যে একাধিক ‘ব্রোকার সংস্থা’র দফতরও ছিল।
১৭২০
সেই মামলার ফলে ধামাচাপা পড়ে যায় আইপিও আনার প্রস্তাব। তার পরে সেবির কাছে এই প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে অন্তত তিন বার। গত বছর সেবিকে এনএসই জরিমানা দিয়ে অব্যাহতি পেয়েছে। প্রমাণের অভাবে কো-লোকেশন মামলা ২০২৪ সেপ্টেম্বরে বন্ধ করে দিয়েছে সেবি। সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, প্রায় ৬৪৩ কোটি টাকা জরিমানা করা হয় এনএসইকে।
১৮২০
২০২৪ সালে সমস্যা মিটলেও সেবির প্রাক্তন কর্ণধার মাধবী পুরী বুচকে নিয়ে অভ্যন্তরীণ গোলযোগকে ঘিরে ডামাডোল শুরু হওয়ায় এনএসইর আইপিও-র জট কাটা সম্ভব হয়নি।
১৯২০
সিকিউরিটিজ় অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়ার বর্তমান কর্তা তুহিনকান্ত পাণ্ডে জানান, ক্লিয়ারিং কর্পোরেশনগুলিতে (সিসি) স্টক এক্সচেঞ্জগুলির অংশীদারি হ্রাস করার প্রস্তাব ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ আইপিওর বিলম্বের অন্যতম কারণ। তিনি আরও জানিয়েছেন, সেবির ছাড়পত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও বাধা নেই।
২০২০
সূত্রের খবর, এনএসই তাদের আইপিও আনার জন্য অনাপত্তির শংসাপত্র চেয়ে সেবির কাছে একটি আবেদন করেছে। সেবির নতুন চেয়ারম্যান তাঁর প্রথম বোর্ড মিটিংয়ের পর জানিয়েছেন, তারা এনএসইর আইপিওর সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলি খতিয়ে দেখবেন এবং প্রক্রিয়াটি কী ভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় তা দেখবেন।