যাত্রিবাহী বিমানে অতি শক্তিশালী টেলিস্কোপ বসিয়ে তাকে উড়ন্ত মানমন্দিরে বদলেছিল নাসা। ওই দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যেই চন্দ্রপৃষ্ঠে জলের অস্তিত্ব খুঁজে পান জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৬:১১
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
ছিল যাত্রিবাহী বিমান। হয়ে গেল মহাকাশ গবেষণার মানমন্দির। আর এই পরিবর্তন হওয়া ইস্তক পেটের মধ্যে বিশাল একটি টেলিস্কোপ নিয়ে রাত-দিন পৃথিবীর চক্কর কেটেছে ওই উড়োজাহাজ। শুধু তা-ই নয়, এর সাহায্যে একের পর এক কালজয়ী অবিষ্কার করে গোটা দুনিয়াকে রীতিমতো চমকে দিয়েছে আমেরিকার বিখ্যাত মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র নাসা।
০২২০
‘স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারিক অবজ়ারভেটরি ফর ইনফ্রারেড অ্যাস্ট্রোনমি’। সংক্ষেপে সোফিয়া। এটাই ছিল নাসা পরিচালিত যুক্তরাষ্ট্রের উড়ন্ত মানমন্দিরের পোশাকি নাম। এতে রাখা হয় অত্যাধুনিক একটি টেলিস্কোপ। ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪৫ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়তে থাকা বিমানে বসানো ওই দূরবীক্ষণ যন্ত্রটির সাহায্যে অন্তরীক্ষে নজরদারি চালাত নাসা।
০৩২০
মহাশূন্যের ইনফ্রারেড বর্ণালিকে চাক্ষুষ করতে সোফিয়া টেলিস্কোপ তৈরি করে নাসা। তবে এ কাজে জার্মান মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘ডয়চেস জ়েনট্রাম ফুওর লুন্ত-উন্দ রুমফার্ট’ বা ডিএলআরের সাহায্য নিয়েছিল তারা। টেলিস্কোপটির নকশা নির্মাণে ১৬ আনা কৃতিত্ব জার্মান প্রযুক্তিবিদদের। আর যাত্রিবাহী বিমানকে উড়ন্ত মানমন্দিরে বদলান আমেরিকান মহাকাশ গবেষকেরা।
০৪২০
অত্যাধুনিক এই টেলিস্কোপটির সাহায্যেই প্রথম বার চন্দ্রপৃষ্ঠে জলের অস্তিত্ব জানতে পারে নাসা। এ ছাড়া প্লুটোর বায়ুমণ্ডল বুঝতেও দারুণ ভাবে সাহায্য করেছিল সোফিয়া।
০৫২০
অন্তরীক্ষে রয়েছে ‘হাব্ল’ নামের নাসার আর একটি টেলিস্কোপ। কৃত্রিম উপগ্রহের মতো পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে করতে মহাবিশ্বের যাবতীয় তথ্য পাঠিয়ে চলেছে ওই দূরবীক্ষণ যন্ত্র। ‘হাব্ল’-এ রয়েছে ২.৫ মিটার বিস্তৃত একটি আয়না। সম আকৃতির আয়না রয়েছে সোফিয়া টেলিস্কোপেও।
০৬২০
এখন প্রশ্ন হল, অন্তরীক্ষে ‘হাব্ল’-এর মতো টেলিস্কোপ থাকা সত্ত্বেও কেন উড়ন্ত মানমন্দির তৈরি করেছিল নাসা? ভূপৃষ্ঠের উপর দূরবীক্ষণ যন্ত্র স্থাপন করলে কী সমস্যা হত? জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের দাবি, মহাবিশ্ব থেকে আসা ইনফ্রারেড বর্ণালির ৮০ শতাংশই আটকে দেয় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল। ফলে ভূপৃষ্ঠের উপর থাকা টেলিস্কোপ থেকে সেগুলি বিশ্লেষণ করা খুবই কঠিন। সেই সময়ে অবশ্য জেমস ওয়েব টেলিস্কোপকে অন্তরীক্ষে পাঠায়নি নাসা।
০৭২০
দ্বিতীয়ত, উড়ন্ত মানমন্দিরের সাহায্যে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মহাশূন্যের উপর নজরদারি করার সুযোগ পেতেন গবেষকেরা। ফলে অন্তরীক্ষের নতুন নতুন রহস্য উন্মোচনে সুবিধা হত তাঁদের। ভূপৃষ্ঠের উপরে বসানো স্থবির টেলিস্কোপে এটা করা সম্ভব নয়।
০৮২০
তৃতীয়ত, ‘হাব্ল’-এর মতো মহাশূন্যে ঘূর্ণায়মাণ টেলিস্কোপ নির্মাণ অত্যন্ত খরচসাপেক্ষ। এর রক্ষণাবেক্ষণে ফি বছর জলের মতো ডলার খরচ করে নাসা তথা যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। তুলনামূলক ভাবে সোফিয়ার ক্ষেত্রে ব্যয়ের অঙ্ক ছিল অনেকটাই কম।
০৯২০
মহাকাশ গবেষণায় সাধারণ ভাবে দু’ধরনের টেলিস্কোপ ব্যবহার হয়। একটির নাম, রিফ্র্যাকটিং টেলিস্কোপ। অপরটির পরিচিতি রিফ্লেকটিং টেলিস্কোপ হিসাবে। প্রথম দূরবীক্ষণ যন্ত্রটির আকার কতটা টিউবের মতো। এর ভিতরে থাকে দু’টি অতি শক্তিশালী কাচের লেন্স। মহাশূন্যের কোনও বস্তুকে এর সাহায্যে সরাসরি দেখতে পারেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী।
১০২০
১৭ শতকে নিজের হাতে গড়া দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে বৃহস্পতি এবং তার চাঁদ প্রত্যক্ষ করেন কিংবদন্তি ইটালীয় মহাকাশবিজ্ঞানী গ্যালিলিও। তাঁর তৈরি ওই টেলিস্কোপ ছিল রিফ্র্যাকটিং শ্রেণির। বর্তমানে এই পর্যায়ের সর্ববৃহৎ দূরবীক্ষণ যন্ত্রটি রয়েছে আমেরিকার ইয়ার্কেস মানমন্দিরে। ওই টেলিস্কোপের লেন্সের আকার ৪০ ইঞ্চি।
১১২০
রিফ্লেক্টিং টেলিস্কোপের নকশা বেশ জটিল। এতে কাচের লেন্সের বদলে থাকে আয়না। জার্মান প্রযুক্তিবিদদের তৈরি সোফিয়া ছিল প্রকৃতপক্ষে একটি ‘ক্যাসেগ্রেইন ডিজ়াইন নাসমিথ’ প্রজাতির দূরবীক্ষণ যন্ত্র। এর সাহায্যে মহাশূন্যের ইনফ্রারেড বর্ণালি দেখার সুযোগ পেতেন আমেরিকার জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।
১২২০
সোফিয়ার পাঠানো মহাশূন্যের ইনফ্রারেড বর্ণালি অবশ্য সরাসরি দেখতে পেতেন না নাসার গবেষকেরা। কারণ মানব-চোখে ধরা পড়ে না ওই বর্ণালি। ফলে প্রথমে ‘সুপার কম্পিউটার’-এ ফেলে সেগুলিকে বিশ্লেষণ করতেন তাঁরা। এর পর বর্ণালির সাহায্যে তৈরি হওয়া ছবি দেখে চলত অন্তরীক্ষের অপার রহস্যের কিনারা করার চেষ্টা।
১৩২০
সোফিয়া টেলিস্কোপটিকে ‘বোয়িং ৭৪৭ এসপি’ বিমানের পেটে বসিয়ে সেটিকে উড়ন্ত মানমন্দিরে বদলেছিল নাসা। ১৯৭০-এর দশকে মার্কিন উড়োজাহাজ নির্মাণকারী সংস্থা বোয়িং এটিকে তৈরি করেছিল। ১৯৭৭ সালে ২৫ এপ্রিল বিমানটিকে কিনে নেয় প্যান আমেরিকান এয়ারলাইন্স। ওই সময়ে যাত্রী পরিবহণের কাজ করত ওই উড়ন্ত মানমন্দির।
১৪২০
১৯৮৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি প্যান আমেরিকার থেকে ‘বোয়িং ৭৪৭’কে কিনে নেয় ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স। ফলে আরও কয়েক বছর যাত্রী পরিবহণের কাজে ব্যবহার হয় ওই উড়োজাহাজ। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের একেবারে শেষে বিমানটিকে হাতে পায় ইউনিভার্সিটি স্পেস রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন (ইউএসআরএ)। তারিখটি ছিল ১৯৯৭ সালের ৩০ এপ্রিল।
১৫২০
বিমানের সাহায্যে উড়ন্ত মানমন্দির তৈরির পরিকল্পনা প্রথমে করেছিল ইউএসআরএ। কিন্তু প্রকল্পটির বাস্তব রূপায়নের ক্ষমতা ছিল না তাদের। বিষয়টি জানার পর এগিয়ে আসে নাসা। ২০০০ সালে জার্মান মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ডিএলআরের সঙ্গে মিলে উড়ন্ত মানমন্দির তৈরির কাজ শুরু করেন মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।
১৬২০
প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার সাত বছরের মাথায় (পড়ুন ২০০৭ সাল) জন্ম হয় সোফিয়ার। এর পর একাধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা পেরিয়ে ২০১০ সালে নাসার হয়ে কাজ শুরু করে ওই অত্যাধুনিক টেলিস্কোপ। এর পাঠানো প্রথম ইনফ্রারেড বর্ণালি জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা হাতে পান ওই বছরের ২৬ মে।
১৭২০
২০২০ সালে চন্দ্রপৃষ্ঠে জলের অস্তিত্বের কথা ঘোষণা করে নাসা। ওই বছরই ‘মিল্কি ওয়ে’ ছায়াপথের কেন্দ্রস্থলে থাকা ব্ল্যাক হোলের ছবিও প্রকাশ্যে আনে আমেরিকার জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সংস্থা। দু’টি ঘটনাতেই সোফিয়া টেলিস্কোপের উপর নির্ভরশীল ছিলেন মহাকাশ গবেষকেরা।
১৮২০
২০১৫ সালে প্লুটো নিয়ে গবেষণার জন্য সোফিয়াকে ওড়ায় নাসা। টেলিস্কোপটির পাঠানো তথ্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন, সৌরমণ্ডলের দূরতম গ্রহটির বায়ুমণ্ডলে রয়েছে নাইট্রোজ়েন, মিথেন এবং কার্বন ডাই অক্সাইড। পরবর্তী কালে অবশ্য একাধিক কারণে প্লুটোকে গ্রহের তালিকা থেকে বাদ দেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।
১৯২০
২০২২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সোফিয়ার অবসর ঘোষণা করে নাসা। কর্মজীবনে ৯২১ বার আকাশে উড়েছিল ওই মানমন্দির। বর্তমানে আমেরিকার অ্যারিজ়োনা প্রদেশে মহাকাশ সংগ্রহশালার রয়েছে সোফিয়া।
২০২০
একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারে সাহায্য করলেও সোফিয়াকে বেশি দিন ব্যবহার না করার নেপথ্যে এর বিপুল রক্ষণাবেক্ষণের খরচকেই দায়ী করেছিল নাসা। তবে এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেনি আমেরিকান মহাকাশ গবেষণা সংস্থা।