Mysterious pyramid like mountain discovered in Antarctica know the reality dgtl
Pyramid in Antarctica
পেঙ্গুইনের দেশে তুষারের চাদরে লুকিয়ে ‘পিরামিড’! গোপন সংগঠনের অফিস, না কি নেপথ্যে অন্য রহস্য?
তুষার-চাদরে ঢাকা অ্যান্টার্কটিকায় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে পিরামিড আকারের কাঠামো! মেরুতে কারা তৈরি করল মিশরীয় স্থাপত্য?
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৫:১০
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
বরফে ঢাকা মহাদেশের মাঝে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ত্রিভুজাকার ‘পিরামিড’! সেই ছবি প্রকাশ্যে আসতেই দুনিয়া জুড়ে পড়ে গিয়েছে তুমুল হইচই। বিশ্বের দুর্গমতম মহাদেশটিতে কে বা কারা তৈরি করল ওই কাঠামো? নেপথ্যে ভিন্গ্রহীদের হাত? না কি একটা সময়ে সেখানেও ছিল প্রাচীন সভ্যতা? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত ভূবিজ্ঞানী থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা।
০২১৮
দক্ষিণ মেরুর হিমায়িত মহাদেশ অ্যান্টার্কটিকা। সুবিশাল ভূখণ্ডটি ঢাকা রয়েছে বরফের পুরু চাদরে। কোথাও জনমানবের চিহ্নমাত্র নেই। প্রাণী বলতে পেঙ্গুইন, সিল, তিমি আর কিছু বিশেষ প্রজাতির মাছ। প্রবল ঠান্ডার কারণে সেখানকার জীবজগতে অদৃশ্য মেরুদণ্ডী প্রাণী। এ-হেন অ্যান্টার্কটিকায় ‘পিরামিড’-এর হদিস মেলায় রীতিমতো হতভম্ব দুনিয়ার তাবড় বিজ্ঞানীকুল।
০৩১৮
বরফে ঢাকা দক্ষিণ মেরুতে ‘পিরামিড’-এর অস্তিত্ব কোনও অভিযাত্রীদল আবিষ্কার করেছে, তা ভাবলে ভুল হবে। ২০১৬ সালে কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে পাঠানো ছবি বিশ্লেষণ করে এর হদিস জানতে পারেন গবেষকেরা। অ্যান্টার্কটিকার মধ্যে রয়েছে এলসওয়ার্থ পর্বতমালা। মহাশূন্য থেকে তোলা এর দক্ষিণ অংশের ছবিতে ‘পিরামিডের চূড়া’ দেখা গিয়েছে বলে খবর প্রকাশ্যে আসে।
০৪১৮
অ্যান্টার্কটিকার সর্বোচ্চ পর্বতমালা হল এই এলসওয়ার্থ। এটি লম্বায় প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার এবং প্রস্থে ৪৮ কিলোমিটার। বরফে ঢাকা মহাদেশটির ম্যারি বাইর্ড ল্যান্ড সংলগ্ন রোন আইস শেল্ফ থেকে এর উৎপত্তি। ১৯৩৫ সালে পর্বতমালাটি আবিষ্কার করেন লিঙ্কন এল্সওয়ার্থ। পরবর্তী কালে তাঁর নামানুসারে পরিচিত পায় এই পাহাড়।
০৫১৮
লিঙ্কনের অ্যান্টার্কটিকায় পর্বতমালা আবিষ্কার কম রোমাঞ্চকর নয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে মার্কিন সেনাদলে যোগ দেন তিনি। সেখানেই নেন বিমান চালানোর প্রশিক্ষণ। গত শতাব্দীর ৩০-এর দশকে ডান্ডি দ্বীপ থেকে রস আইস শেল্ফের দিকে উড়োজাহাজ নিয়ে উড়ে যাওয়ার সময়ে বিপাকে পড়েন তিনি। হঠাৎ করে বিমানের জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ায় রিচার্ড বার্ডের তৈরি লিটল আমেরিকা ক্যাম্পের কাছে অবতরণ করতে বাধ্য হন তিনি।
০৬১৮
প্রসঙ্গত, উড়োজাহাজ নিয়ে ওড়ার সময়েই অ্যান্টার্কটিকার রস আইস শেল্ফের কাছে নতুন পর্বতমালা দেখতে পান লিঙ্কন। তবে বেতারযন্ত্রটি খারাপ হয়ে যাওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে সেই খবর বেস ক্যাম্পে পাঠাতে পারেননি তিনি। লিঙ্কন অবশ্য ওই পর্বতমালার নাম দিয়েছিলেন সেন্টিনেল রেঞ্জ। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই সেটা বদলে দেওয়া হয়।
০৭১৮
ভূবিজ্ঞানীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এল্সওয়ার্থ পর্বতমালায় সারা বছর গড় তাপমাত্রা থাকে হিমাঙ্কের ৩০ ডিগ্রি নীচে। খুব অল্প সময়ের জন্য সেখানে পা রাখতে পারেন দুঃসাহসী অভিযাত্রীরা। সাধারণত, সেটা নভেম্বর থেকে জানুয়ারি, বছরের এই তিন মাসের মধ্যে হয়ে থাকে।
০৮১৮
এ-হেন এল্সওয়ার্থ পর্বতমালায় ‘পিরামিড’-এর হদিস মিলতেই বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ‘ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব’। কেউ কেউ বলতে শুরু করেন, মিশর থেকে সেগুলিকে অ্যান্টার্কটিকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অনেকে আরও এক ধাপ এগিয়ে সেগুলিকে জার্মানির বাভারিয়ায় আডাম ভাইসহাউপ্ট প্রতিষ্ঠিত গুপ্ত সংগঠন ‘ইলুমিনাটি’র তৈরি আস্তানা বলে প্রচার চালাতে থাকেন।
০৯১৮
‘ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব’-এর একাংশের আবার ধারণা, প্রাগৈতিহাসিক যুগে ব্রাজ়িলের আমাজ়নের মতো দুর্ভেদ্য বৃষ্টি অরণ্যে ঢাকা ছিল অ্যান্টার্কটিকা। সেই সময়ে সেখানে পিরামিড আকারের ওই কাঠামোগুলি তৈরি করা হয়। এগুলির সঙ্গে প্রায় ১০ হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার সম্পর্ক রয়েছে বলে দাবি করেছেন তাঁরা।
১০১৮
কিন্তু আধুনিক গবেষকেরা এই তত্ত্ব মানতে নারাজ। তাঁদের দাবি, এল্সওয়ার্থ পর্বতমালায় হিমবাহের মিলনের জেরে তৈরি হয়েছে ওই ত্রিভুজাকার পিরামিড সদৃশ চূড়া। এর সঙ্গে প্রাগৈতিহাসিক যুগের কোনও সম্পর্ক নেই। গোটা বিষয়টিকে তাঁরা ‘প্রকৃতির খেলা’ বলে উল্লেখ করেছেন।
১১১৮
এ ব্যাপারে সবচেয়ে জোরালো যুক্তি দিয়েছেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কিন ভূবিজ্ঞানী তথা অধ্যাপক এরিক রিগনোট। অ্যান্টার্কটিকা এবং গ্রিনল্যান্ড নিয়ে লম্বা সময় ধরে গবেষণা চালাচ্ছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘দক্ষিণ মেরুর ওই পিরামিড আকারের চূড়া নিয়ে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু এটা কোনও অতি প্রাকৃতিক ঘটনা বা মানুষের হাতে তৈরি কাঠামো নয়। সেখানকার প্রকৃতিই ওটাকে গড়ে তুলেছে।’’
১২১৮
ভূবিজ্ঞানীরা বর্তমানে এল্সওয়ার্থ পর্বতমালার পিরামিডের মতো দেখতে চূড়াগুলিকে ‘হর্ন’ বা খড়্গ বলে অভিহিত করে থাকেন। তাঁরা জানিয়েছেন, অ্যান্টার্কটিকার ওই এলাকায় রয়েছে একাধিক হিমবাহ। অনেক সময়েই পাহাড়ের গা বেয়ে সেগুলি ধীরে ধীরে নীচের দিকে নামার চেষ্টা করে। এতে হিমবাহের উপরের মোটা তুষারের চাপে পাহাড়ের চূড়া পিরামিডের মাথার মতো উঁচু খাড়াই এবং ছুঁচলো হয়।
১৩১৮
এ ছাড়া আরও কয়েকটি কারণের কথা বলেছেন ভূবিজ্ঞানীরা। তাঁদের দাবি, বরফে ঢাকা মহাদেশটিতে অনেক সময়ে দুই বা তার বেশি হিমবাহের মিলন দেখতে পাওয়া যায়। সেই সময়কার ঘর্ষণেও পাহাড়ের আকার পিরামিডের মতো হতে পারে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একটি কেন্দ্রীয় বিন্দু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একাধিক হিমবাহের তীব্র বৃত্তাকার ক্ষয়ের কারণে এগুলি তৈরি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
১৪১৮
ইউরোপের সুইৎজ়ারল্যান্ড এবং ইটালি সীমান্তে আল্পস পর্বতমালায় রয়েছে সুবিখ্যাত ম্যাটারহর্ন শৃঙ্গ। এই চূড়াটিও নিখুঁত ভাবে ত্রিভুজ আকার নিয়ে বছরের পর বছর ধরে ওই এলাকায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। এর নেপথ্যেও হিমবাহের ধর্ষণ বা বৃত্তাকার ক্ষয়কেই দায়ী করে থাকেন ভূবিজ্ঞানীরা। তাঁদের কথায়, অ্যান্টার্কটিকাতেও একই ঘটনা ঘটেছে।
১৫১৮
পরিবেশবিজ্ঞানী মাউরি পেল্টো জানিয়েছেন, এল্সওয়ার্থ পর্বতমালা এবং এর কাছের প্যাট্রিয়ট পাহাড় নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে গবেষণা চলছে। অ্যান্টার্কটিকার মতো প্রবল ঠান্ডার জায়গায় এই ধরনের চূড়া তৈরি হওয়া একেবারেই আশ্চর্যের নয়। মেরুবিজ্ঞানীরা বিষয়টি তাঁদের রচনায় নথিবদ্ধও করেছেন।
১৬১৮
প্রায়ই কথা বলতে শোনা গিয়েছে পটসডামের ‘জার্মান রিসার্চ সেন্টার ফর জিয়োসায়েন্স’-এর ভূতত্ত্ববিদ মিচ ডারসিকে। তিনি জানিয়েছেন, অ্যান্টার্কটিকায় ৪০০ কিলোমিটারেরও বেশি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এল্সওয়ার্থ পর্বতমালায় এ রকম পিরামিড আকৃতির অনেক পর্বতচূড়়া রয়েছে। পাহাড় বরফে ঢাকা থাকায় এগুলির অধিকাংশই দেখতে পাওয়া যায় না। ভূবিজ্ঞানী এই ধরনের পর্বতচূড়াকে ‘নুনাটক’ বা ‘পিরামিডাল পিক্ড মাউন্টেন’ বলে থাকেন।
১৭১৮
পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি হল পিরামিড। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে ওই ত্রিভুজাকার কাঠামো। উত্তর আফ্রিকার নীল নদের কোলের দেশটির মরুভূমিতে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পিরামিডগুলিতে লুকিয়ে রয়েছে হাজারও রহস্য। সেগুলি কেন তৈরি করা হয়েছিল, তার উত্তর এখনও সঠিক ভাবে পাননি প্রত্নতাত্ত্বিকেরা।
১৮১৮
পিরামিডের জন্ম মিশরে হলেও দেশটির বাইরেও এর হদিস পাওয়া গিয়েছে। তবে সেগুলি সবই মিশরীয় সভ্যতার চারণভূমিতে। উত্তর আফ্রিকার ওই এলাকা থেকে বহু দূরে আর কোথাও কোনও পিরামিড খুঁজে পাননি প্রত্নতাত্ত্বিকেরা। আন্টার্কটিকার মতো কঠিন প্রাকৃতিক পরিবেশে সেগুলি থাকতেই পারে না বলে স্পষ্ট করেছেন তাঁরা।