মন্ত্রী জিতেন্দ্র বলেছেন, ‘‘শুধু মহাকাশচারীকে মহাকাশে পাঠিয়ে দিলেই তো হল না, তাঁদের নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসার বিষয়টিও তো নিশ্চিত করতে হবে! ইসরোর মানব রোবট সেই কাজটিই করবে।’’
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতাশেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০২৩ ১১:৪২
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২২
পরনে নীল রঙের শাড়ি। ফুলহাতা গলাবন্ধ ব্লাউজ। কাঁধ ছোয়া কালো চুল পরিপাটি করে সিঁথি কেটে আঁচড়ানো। টেবলে হাত রেখে গুছিয়ে বসে আছেন ব্যোম মিত্র। হঠাৎ দেখলে অঙ্কের দিদিমণি মনে হতে পারে। তবে ইনি কিছুটা ফ্যাশন সচেতনও। ‘ম্যাচিং’ নীল টিপ কপালে। ঘন চোখের পাতা আরও ঘন হয়েছে মাসকারা-আইলাইনারে। ঠোঁটে পরিমিত গোলাপি রঙের ছোঁয়া। সঙ্গে হালকা হাসির আভাসও।
০২২২
তাঁকে দেখতে প্রায়ই ভি়ড় জমে দর্শনার্থীদের। হাসিমুখেই তাঁদের সামলান ব্যোম মিত্র। প্রশ্ন করলে জবাব দেন। হাত মেলাতে চাইলে বাড়িয়ে দেন হাত। নিজস্বী তোলার আবদারও মেটান সাধ্যমতো। একদম মানুষের মতোই হাবভাব। যদিও ব্যোম মিত্র মানুষ নন।
০৩২২
ব্যোম মিত্র একজন হিউম্যানয়েড। অর্থাৎ মানুষের মতো আচরণকারী রোবট। তবে শুধু সেটুকু বললে বোধ হয় তার পুরো পরিচয় দেওয়া হয় না। ভারতীয় পোশাকে সাজগোজ করা এই মহিলা রোবট আগামী দিনে মহাকাশেও পাড়ি দেবে ভারতের হয়ে। সে কথা মাথায় রেখেই তাকে তৈরি করেছে ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো।
০৪২২
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় বিজ্ঞানমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহ ঘোষণা করেছেন মহাকাশে ব্যোম মিত্রের অভিযানের কথা। সাংবাদিক সম্মেলনে গগনযান নিয়ে কথা বলছিলেন কেন্দ্রীয় বিজ্ঞানমন্ত্রী। সেখানেই তিনি বলেন, ‘‘গগনযানে চড়ে মহাকাশে মানুষ যাওয়ার আগে এ বছরই এক মহিলা রোবটকে মহাকাশে পাঠাবে ইসরো।’’ এই মহিলা রোবটই ব্যোম মিত্র। যার নামেই রয়েছে মহাকাশ।
০৫২২
খাঁটি সংস্কৃত ভাষায় নাম রাখা হয়েছে ইসরোর মহাকাশচারী এই রোবটের। ‘ব্যোম’ শব্দের অর্থ মহাকাশ। ‘মিত্র’ অর্থাৎ বন্ধু। ফলত ইসরোর মহাকাশচারী রোবট মহাকাশে পৌঁছনোর আগেই হয়েছে ‘মহাকাশের বন্ধু’ বা বলা ভাল ‘বান্ধবী’।
০৬২২
আগামী ২০২৪ কিংবা ২০২৫ সালে ভারত তাদের প্রথম মানবচালিত মহাকাশযান পাঠাতে চলেছে মহাকাশে। মন্ত্রী জিতেন্দ্র সে কথা জানিয়ে বলেছেন, ‘‘মহাকাশচারীদের মহাকাশে পাঠিয়ে দিলেই তো হল না! তাঁদের নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসার বিষয়টিও তো নিশ্চিত করতে হবে। ইসরোর মানব রোবট সেই কাজটিই করবে।’’
০৭২২
২০১২ সাল থেকে মহাকাশে মানুষ পাঠানোর চেষ্টা শুরু করেছে ইসরো। লক্ষ্য ছিল, ভূপৃষ্ঠ থেকে ৪০০ কিলোমিটার উঁচু কক্ষপথে মানব মহাকাশচারী নিয়ে যাবে এই অভিযান। ওই উচ্চতাতেই মহাকাশে পৃথিবীকে চক্কর কাটবে সাত দিন ধরে। তার পর ফিরে আসবে পৃথিবীতে।
০৮২২
এ কাজের জন্য পরীক্ষামূলক ভাবে প্রথম একটি মহাকাশযানটি পাঠানো হয় অপেক্ষাকৃত কাছের কক্ষপথে। তার পর তাকে ফিরিয়েও আনা হয় পৃথিবীতে। বঙ্গোপসাগরে অবতরণ করেছিল পরীক্ষামূলক সেই গগনযান। সেটা ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাস। এর পরেই ২০১৮ সালের ১৫ অগস্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেন, ২০২২ সালে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তিতে মহাকাশে ভারত প্রথম মৌলিক অভিযানে মহাকাশে মানুষ পাঠাবে।
০৯২২
যদিও সেই তারিখ পিছিয়ে যায় অতিমারির দৌলতে। ২০২০ সাল থেকে ২০২২ সে ভাবে কাজ এগোয়নি। অবশেষে ২০২৪ সালের শেষ কিংবা ২০২৫ সালের শুরুতে ঠিক হয়েছে গগনযানের গগনযাত্রা। ভারতের প্রথম মৌলিক মহাকাশ অভিযান, যেখানে মানুষকে পাঠানো হবে মহাকাশচারী হিসাবে।
১০২২
এর আগে ভারতীয় মহাকাশচারী রাকেশ শর্মাও মহাকাশে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেটি ছিল রাশিয়ার অভিযান। রাশিয়ার মহাকাশ স্টেশন সালইয়ুত-৭-এ রাশিয়ার মহাকাশচারীদের সঙ্গে সাত দিন ছিলেন রাকেশ। তবে তার সঙ্গে গগনযানের তফাত অনেক।
১১২২
গগনযান ভারতের মৌলিক অভিযান। তা ছাড়া এখানে মহাকাশচারীরা কোনও মহাকাশ স্টেশনে পৌঁছবেন না। তাঁরা সাত দিন থাকবেন মহাকাশযানের ভিতরেই। ঘুরবেন পৃথিবীর চারপাশে। এ ছাড়াও সালইয়ুত-৭ ছিল পৃথিবীর অনেক কাছের কক্ষপথে। ভূপৃষ্ঠ থেকে ২১৯ কিলোমিটার ছিল তাঁর উচ্চতা। সেখানে গগনযান পৌঁছবে পৃথিবীর ৪০০ কিলোমিটার দূরত্বের কক্ষপথে। অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ দূরে।
১২২২
সম্ভবত সে জন্যই মহাকাশচারীদের নিরাপত্তা নিয়ে অনেক বেশি চিন্তিত ইসরো। বিজ্ঞানমন্ত্রী জানিয়েছেন, ইসরোর মানব রোবট ব্যোম মিত্রকে গগনযানে মহাকাশের ওই একই দূরত্বে পাঠানো হবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহের জন্য। মহাকাশযানে থেকে এই মানব রোবট যাচাই করে দেখবে মহাকাশে ভরশূন্যতা মানবশরীরের উপর কতটা প্রভাব ফেলবে। এমনকি, কোনও রকম বিকিরণ মানবশরীরে সমস্যা তৈরি করবে কি না, তাও দেখবে।
১৩২২
এই সব তথ্যই সংগ্রহ করার ক্ষমতা রয়েছে ব্যোম মিত্রের। বিজ্ঞানমন্ত্রী জানিয়েছেন, ইসরোর মহিলা রোবট হুবহু মানুষের মতো কাজকর্ম করবে।
১৪২২
গগনযানের কথা ভেবে ২০২০ সালেই তৈরি করা হয়েছিল ব্যোম মিত্রকে। তার গলায় ঝোলানো পরিচয়পত্র বলছে সে ভারত সরকারের মহাকাশ বিভাগে কর্মরত। ইসরোর ইনারসিয়াল সিস্টেম ইউনিটে তাঁর যাবতীয় কাজ।
১৫২২
ওই পরিচয়পত্রই জানাচ্ছে ইসরোর মানবহীন গগনযান অভিযানে মহাকাশচারী ব্যোম মিত্র। আর সে হাফ হিউম্যানয়েড। অর্থাৎ, অর্ধেক মানব রোবট।
১৬২২
অর্ধেক কেন? তার কারণ এই রোবট মানবীর মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত মানুষের দেহের মতো হলেও এর পা নেই। মহাকাশযানে চলেফিরে বেড়াতে পারবে না সে। যদিও মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণ প্যানেল চালাতে পারবে। এ ছাড়াও মহাকাশযানে মানব মহাকাশচারীর করণীয় আরও অনেক কাজ করতে পারবে সে।
১৭২২
ব্যোম মিত্র ঠিক কী কী কাজ করতে পারে, তার ব্যাখ্যা নিজে মুখেই দিয়েছিল সে। ইসরোরই আয়োজিত একটি পরিচয় পর্ব অনুষ্ঠানে ব্যোম মিত্র আত্মপরিচয় দিয়ে বলে, ‘‘আমাকে তৈরি করা হয়েছে মানবহীন গগনযান অভিযানের জন্য। আমি মহাকাশযানের মডিউলের প্যারামিটার নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। আপনাদের বিভিন্ন বিষয়ে সতর্ক করতে পারি। এমনকি, মানুষের জীবন বাঁচানোর প্রক্রিয়াও আমি সম্পন্ন করতে পারি।’’
১৮২২
আর কী কী পারে এই মানবী রোবট? ২০২০ সালেই তার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তৎকালীন ইসরোর চেয়ারম্যান কে শিবন। তিনি বলেছিলেন, ‘‘ওর কাজ হবে মহাকাশযানে এক জন মানুষ যা যা করতে পারে, ঠিক তা-ই করার। মহাকাশযানটির সমস্ত যান্ত্রিক জিনিসপত্র ঠিক ভাবে চলছে কি না, তা দেখতে পারবে। মহাকাশযানের ভিতরের পরিবেশ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করবে ও। তা মানুষের জীবনকে কোনও ভাবে বিপন্ন করতে পারবে কি না সেই তথ্যও সংগ্রহ করতে পারবে।’’
১৯২২
এ ছাড়াও এই রোবটে থাকবে বিশেষ সেন্সর। ভবিষ্যতে যদি মহাকাশচারীদের সঙ্গে তাকে মহাকাশে পাঠানো হয়, তবে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারবে ব্যোম মিত্র। তাদের গলার স্বর আলাদা আলাদা ভাবে চিনতেও পারবে এই রোবট। জবাব দিতে পারবে প্রশ্নেরও।
২০২২
জিতেন্দ্র জানিয়েছেন, গগনযানের চূড়ান্ত অভিযানের আগেই আরও দু’টি পরীক্ষামূলক অভিযান হবে। একটি চলতি বছরের অক্টোবরে। হয় প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে। তবে সেই অভিযানে সম্ভবত ব্যোম মিত্রকে পাঠানো হবে না। বিজ্ঞানমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘দ্বিতীয় অভিযানে মহাকাশে পাঠানো হবে এই মহিলা রোবটকে।’’
২১২২
ইসরো সূত্রে অবশ্য জানানো হয়েছে মহাকাশে ২০২৪ অথবা ২০২৫ সালে মানব মহাকাশচারী পাঠানোর আগে দু’টি মানবহীন অভিযান চালানো হবে। ওই দুই অভিযানেই পাঠানো হবে মানব রোবটকে।
২২২২
তবে কি অক্টোবরেই ভারতের ব্যোম মিত্র যাচ্ছে মহাকাশে? তার পর কি সে নিরাপদে ফিরে আসতে পারবে পৃথিবীতে? আপাতত তারই অপেক্ষায় ইসরো-সহ গোটা দেশ।