বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ৬৫০ কিলোমিটার চওড়া ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে ব্রিটেনে আক্রমণের পরিকল্পনা করেও বার বার পিছিয়ে আসে জার্মানি। কারণ ওই সময়ে বিকট শব্দ করে উড়ত বার্লিনের যুদ্ধবিমান। ফলে হামলার আগেই সতর্ক হওয়ার সুযোগ পেয়ে যেতেন ইংরেজ সেনা অফিসাররা। আর সেটাকে কাজে লাগিয়ে আকাশপথে জার্মান আক্রমণ প্রতিহতও করতে সক্ষম হচ্ছিলেন তাঁরা।
এই অবস্থায় লড়াইয়ের ময়দানে ব্রিটেনকে মাত দিতে নতুন প্রযুক্তির আশ্রয় নেন জার্মান নৌকম্যান্ডারেরা। একটি ডুবোজাহাজের উপর লড়াকু জেট বসিয়ে সেটিকে ব্রিটিশ উপকূলের দিকে পাঠানোর পরিকল্পনা করেন তাঁরা। তাতে অবশ্য যুদ্ধজাহাজটি জলের উপরে থাকায় দূর থেকে সেটিকে দেখতে পাওয়ার ঝুঁকি ছিল। তবে তাতে এতটুকু দমে যাননি জার্মান সেনা অফিসাররা।
বার্লিনের ফৌজি কর্তাদের যুক্তি ছিল, ডুবোজাহাজে চাপিয়ে লড়াকু জেটকে ব্রিটিশ উপকূলে পৌঁছে দিতে পারলে অতর্কিতে আক্রমণ শানানো অনেকটাই সহজ হবে। যত ক্ষণ যুদ্ধবিমানটি ডুবোজাহাজের উপরে থাকবে, তত ক্ষণ বন্ধ রাখা হবে এর ইঞ্জিন। এ ভাবে ইংরেজদের বোকা বানাতে চেয়েছিলেন তাঁরা। জার্মানির এই পরিকল্পনার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল প্রথম বিমানবাহী ডুবোজাহাজের বীজ।
কিছু দিনের মধ্যে এ ব্যাপারে অনেকটাই সাফল্য পায় যুক্তরাষ্ট্র। ডুবোজাহাজের মধ্যে হ্যাঙ্গার বা গ্যারাজের মতো একটি জায়গা তৈরি করেন মার্কিন প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীরা। সেখানে লড়াকু জেটকে রেখে বন্ধ করা হত সামনের দরজা। এ ভাবে হ্যাঙ্গারে জল ঢোকার রাস্তা বন্ধ করেন তাঁরা। ফলে যুদ্ধবিমান নিয়ে সমুদ্রের গভীরে যেতে পারত ওই ডুবোজাহাজ।
গত শতাব্দীর ৩০-এর দশকে আমেরিকার তৈরি এই ধরনের জলযানকে বিশ্বের প্রথম বিমানবাহী ডুবোজাহাজের আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অচিরেই এতে একটি সমস্যা ধরা পড়ে। মার্কিন নৌঅফিসারেরা বুঝলেন, সংশ্লিষ্ট ডুবোজাহাজ থেকে বিমান উড়িয়ে আক্রমণ করা যাবে। কিন্তু সেই জেটকে ডুবোজাহাজের হ্যাঙ্গারে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। কারণ, সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় জলযানটির ডেকে যুদ্ধবিমান অবতরণ করানো সম্ভব হচ্ছিল না।
৩০-এর দশকের মধ্য ভাগে এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে আমেরিকার প্রভাব বাড়ছিল। প্রথম থেকেই এই বিষয়টিকে মানতে পারেনি জাপান। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সুযোগের খোঁজে ছিল টোকিয়ো। লড়াই চলাকালীন অতর্কিতে হামলা চালিয়ে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের মার্কিন নৌসেনাঘাঁটি পার্ল হারবারকে উড়িয়ে দেয় জাপানি বায়ুসেনা। আক্রমণের তারিখ ছিল ৭ ডিসেম্বর, ১৯৪১।
পার্ল হারবারে জাপানি হামলার সঙ্গে সঙ্গেই টোকিয়োর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ওয়াশিংটন। প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রটি বুঝেছিল সুযোগ পেলেই বদলা নেবে যুক্তরাষ্ট্র। আর তাই আমেরিকার কোমর ভাঙতে পাল্টা ঘুঁটি সাজাতে শুরু করেন তৎকালীন জাপানি নৌসেনাপ্রধান অ্যাডমিরাল ইসোরকু ইয়ামামোতো। অতি দ্রুত অন্তত ১৮টি বিমানবাহী ডুবোজাহাজ নির্মাণের নির্দেশ দেন তিনি।
১৯৪৫ সালের ২৫ জুলাই দু’টি বিমানবাহী ডুবোজাহাজ নিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরে ডুব দেয় জাপানি নৌসেনার দল। উলিঠি দ্বীপের মার্কিন নৌঘাঁটি উড়িয়ে দিতে দৃঢ়সংকল্প ছিলেন তাঁরা। কিন্তু পরের মাসেই (পড়ুন ৬ ও ৯ অগস্ট) দ্বীপরাষ্ট্রের হিরোসিমা এবং নাগাসাকিতে পরমাণু হামলা চালায় আমেরিকা। সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ করে টোকিয়ো। আর সেই খবর মিলতেই ফেরার রাস্তা ধরে ওই দুই বিমানবাহী ডুবোজাহাজ।
জাপানি নৌঘাঁটিতে ফেরার পথে অবশ্য একটি জলযানকে চিহ্নিত করেছিল আমেরিকার ডুবোজাহাজ। সেটির ক্যাপ্টেন ছিলেন জাপানি নৌসেনা অফিসার তাতসুনোসুকে অ্যারিজ়ুমি। এক বার মার্কিন ডুবোজাহাজে হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েও ফেলেছিলেন তিনি। কিন্তু তখন সদর দফতর থেকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ পান তিনি। এর পর টোকিয়োর ওই অত্যাধুনিক ডুবোজাহাজ চলে যায় ওয়াশিংটনের কব্জায়।
জাপানি বিমানবাহী ডুবোজাহাজের নকশা দেখে আমেরিকার প্রতিরক্ষা প্রকৌশলীরা চমকে গিয়েছিলেন। ওই প্রযুক্তি হাতে পেতে ওয়াশিংটনের উপর প্রবল চাপ তৈরি করেছিল মস্কো। কিন্তু সবাইকে চমক দিয়ে ডুবোজাহাজটিকে ধ্বংস করে দেয় মার্কিন নৌসেনা। তাঁদের যুক্তি ছিল, ওই প্রযুক্তি অন্য কারও হাতে গেলে অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
পরবর্তী কালে অবশ্য নতুন প্রযুক্তি চলে আসায় কোনও দেশই আর বিমানবাহী ডুবোজাহাজ তৈরির দিকে নজর দেয়নি। উল্টে আন্তর্মহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পিছনে পরবর্তী দশকগুলিতে কোটি কোটি ডলার খরচ হয়েছিল। ডুবোজাহাজ প্রযুক্তিতেও এসেছে আমূল বদল। এক কথায় এর প্রয়োজনীয়তাই ফুরিয়ে যাওয়ায় জাপানি জলযানগুলি শুধুমাত্র ইতিহাসেই থেকে গিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy