সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাস থেকে দূরত্ব মাত্র ৪০ কিলোমিটার। এ বার কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাউন্ট হেরমনের দখল নিল ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্স।
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতাশেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৩:০২
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
প্রতিবেশী দেশে ডামাডোলের সুযোগ নিয়ে ‘ঝোপ বুঝে কোপ’! যতটা সম্ভব জমি হাতিয়ে নেওয়ার মরিয়া চেষ্টা। সেই সঙ্গে নিজের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা। সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের পর দ্রুত সেই কাজগুলি সেরে ফেলতে চাইছে ইজ়রায়েল। এর ফলে অচিরেই ইহুদি দেশটি যে কলবরে বৃদ্ধি পেতে চলেছে, তা একরকম স্বীকার করে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
০২১৮
চলতি বছরের ৮ ডিসেম্বর সিরিয়ার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট হেরমনের দখল নেয় ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ২,৮১৪ মিটার। অর্থাৎ প্রায় ৯,২৫০ ফুট। মাউন্ট হেরমনের কৌশলগত গুরুত্ব অনেক। সেই পর্বতশৃঙ্গ থেকে সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাসের দূরত্ব মেরেকেটে ৪০ কিলোমিটার।
০৩১৮
এত দিন মাউন্ট হেরমনের উপরে উড়ত সিরিয়ার সরকারি সেনাবাহিনীর পতাকা। কিন্তু ৮ তারিখ বিদ্রোহীরা রাজধানী দামাস্কাস দখল করলে সেখানকার ঘাঁটি ছেড়ে সরে যান তাঁরা। আর সঙ্গে সঙ্গে ওই পাহাড়চূড়া দখলের নীল নকশা ছকে ফেলে আইডিএফ। এই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় ‘শ্যালডাগ’ কম্যান্ডো ইউনিটকে। অপারেশনে নেমে ইহুদি স্পেশ্যাল ফোর্স যে কোনও ভুল করেনি, তা বলাই বাহুল্য।
০৪১৮
ইজ়রায়েলি সংবাদ সংস্থা ‘দ্য টাইমস্ অফ ইজ়রায়েল’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোনও প্রতিরোধ ছাড়াই মাউন্ট হেরমন কব্জা করতে পেরেছে আইডিএফ। সেখানে জাতীয় পতাকা হাতে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকা কম্যান্ডোদের ছবি ইতিমধ্যেই সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এ বার মাউন্ট হেরমনে বসবে ইহুদি কামান। আর সেই তোপখানার নিশানায় থাকবে দামাস্কাস।
০৫১৮
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা আবার মাউন্ট হেরমনকে প্রাকৃতিক দুর্গ হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এই শৃঙ্গ দখল করায় সামরিক দিক থেকে অনেকটাই সুবিধাজনক অবস্থান পেল ইজ়রায়েল। ওই এলাকা থেকে গোটা দক্ষিণ সিরিয়া এবং লেবাননের একটা বড় অংশের উপর নজরদারি করতে পারবে ইহুদি সেনা। পাশাপাশি ঠেকানো যাবে সম্ভাব্য যাবতীয় আক্রমণ।
০৬১৮
‘দ্য টাইমস্ অফ ইজ়রায়েল’ জানিয়েছে, মাউন্ট হেরমনে উন্নত রাডার ব্যবস্থা মোতায়েন করবে আইডিএফ। সেই কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে পূর্ব দিকের মাউন্ট মেরনে এই ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। যদিও কৌশলগত দিক থেকে তা যথেষ্ট নয়। সেখানকার রাডারের নজর এড়িয়ে বহু বার ইহুদি ভূমিতে ড্রোন এবং রকেট হামলা চালিয়েছে ইরান ও লেবাননের মদতপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজ়বুল্লা।
০৭১৮
মাউন্ট হেরমনে রাডার স্থাপনের কাজ শেষ হলে পুরোপুরি সুরক্ষিত হবে উত্তর ইজ়রায়েলের সমস্ত এলাকা। গত এক বছর ধরে চলা যুদ্ধে ইহুদিদের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। সিরিয়া সীমান্তে কৌশলগত অবস্থান পেয়ে যাওয়ায় সেটাকেও ঢেলে সাজার সময় হাতে পেয়ে যাবে আইডিএফ।
০৮১৮
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের কথায়, মাউন্ট হেরমনের দখল ইজ়রায়েলকে পশ্চিম এশিয়ায় অপ্রতিরোধ্য করে তুলবে। আগামী দিনে লেবানন বা সিরিয়াকে ইহুদি ভূমিতে আক্রমণ শানাতে হলে দু’বার ভাবতে হবে। তবে এর সর্বাধিক আঘাত হিজ়বুল্লার উপর পড়বে বলেও মনে করা হচ্ছে। ইরান মদতপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠীটি এ বার ইহুদি সেনার সহজ নিশানায় চলে এল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
০৯১৮
হিজ়বুল্লার প্রধান হাতিয়ার সরবরাহকারী দেশ হল ইরান। এত দিন সিরিয়া হয়ে বেকা উপত্যকার গুপ্ত পাহাড়ি পথ ঘুরে লেবাননের সশস্ত্র বাহিনীটির হাতে অস্ত্র পৌঁছে দিচ্ছিল তেহরান। মাউন্ট হেরমনের দখল নেওয়ায় সেই চোরাচালানের রাস্তা পুরোপুরি বন্ধ করার সুযোগ পাবে আইডিএফ। আর হাতিয়ারের অভাবে অচিরেই পঙ্গু হয়ে পড়বে হিজ়বুল্লা।
১০১৮
১৯৬৭ সালের বিখ্যাত ছ’দিনের যুদ্ধের পর সিরিয়ার গোলান মালভূমি (গোলান হাইটস্ নামে পরিচিত) পুরোপুরি চলে যায় ইজ়রায়েলের দখলে। ১৯৭৩ সালের ইয়ম কপুর যুদ্ধের পর পাকাপাকি ভাবে সেখানে তৈরি হয় বাফার জ়োন। গত ৮ ডিসেম্বর দামাস্কাসের পতনের পর ওই বাফার জ়োনের দখল নিতে আইডিএফকে নির্দেশ দেন ইহুদি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু।
১১১৮
সূত্রের খবর, গোলান মালভূমির অসামরিক এলাকাগুলি (ডিমিলিটেরাইজ়ড জোন) ইতিমধ্যেই হাতিয়ে নিয়েছে ইহুদি ফৌজ। এর তীব্র নিন্দা করে বিবৃতি দিয়েছে তুরস্ক, মিশর, কাতার, কুয়েত, জর্ডন ও ইরাক-সহ পশ্চিম এশিয়ার অধিকাংশ দেশ। ইজ়রায়েলের পাল্টা যুক্তি, নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে এই পদক্ষেপ করেছে তারা।
১২১৮
সীমানা সম্প্রসারণের পাশাপাশি বিদ্রোহীদের দখলে যাওয়া সিরিয়ার উপর লাগাতার বিমানহানা চালিয়ে যাচ্ছে আইডিএফ। ৮ ডিসেম্বর থেকে প্রতিবেশী দেশটিতে ৩০০-র বেশি হামলা চালিয়েছে আইডিএফ। বিমানবন্দর, অস্ত্রভান্ডার, তেলের ডিপো, সেনাঘাঁটি, গবেষণাগার, গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দফতর এবং সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা— সর্বত্র বোমাবর্ষণ করেছে ইহুদি বায়ুসেনা।
১৩১৮
সরকারি ভাবে ইজ়রায়েল জানিয়েছে, আসাদ সরকারের পতনের পর সেখানকার ফৌজি হাতিয়ারের নাগাল যাতে জঙ্গিরা না পায়, তার জন্যই এই ব্যবস্থা। পাশাপাশি, দামাস্কাস দখল করা বিদ্রোহীদের প্যালেস্টাইনপন্থী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই সিরিয়ার একের পর এক এলাকা আকাশপথে বোমাবর্ষণ করে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ইহুদি বায়ুসেনা।
১৪১৮
অন্য দিকে ইজ়রায়েলের এই আগ্রাসী মনোভাবের কড়া সমালোচনা করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আরব মুলুকের অধিকাংশ দেশ। এতে এই এলাকায় শান্তি বিঘ্নিত হবে বলে মনে করছেন তাঁরা। সেই দাবি উড়িয়ে দিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদকে তেল আভিভ জানিয়েছে, নিজেদের সীমানা সুরক্ষিত রাখার জন্যই ‘সামান্য পরিসরে’ সামরিক পদক্ষেপ করা হচ্ছে।
১৫১৮
মাউন্ট হেরমন এবং গোলান মালভূমির বাফার জ়োনে ঢুকে পড়া নিয়ে মুখ খুলেছেন ইজ়রায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইজ়রায়েল কাটজ়। তাঁর কথায়, ‘‘২৩৫ বর্গ কিলোমিটারের পুরো বাফার এলাকাটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার কাজ করছে আইডিএফ। এই কাজের দায়িত্বভার গোলান মালভূমিতে মোতায়েন থাকা ২১০ নম্বর বাশান আঞ্চলিক ডিভিশনকে দেওয়া হয়েছে। অসামরিক এলাকাটিকে হাতের তালুর মতো চেনেন এই ডিভিশনের সৈনিকেরা।’’
১৬১৮
তবে মাউন্ট হেরমন ও গোলান মালভূমির বাফার জ়োন দখল যে সাময়িক নয়, তা-ও স্পষ্ট করেছে তেল আভিভ। ‘‘গত ৫০ বছরে আইডিএফ কখনওই সীমান্ত পেরিয়ে অগ্রসর হয়নি। উল্টে অধিকৃত এলাকা আমরা শত্রুদের ফিরিয়ে দিয়েছি। এতে লোকসান হয়েছে ইজ়রায়েলের। বার বার আমাদের পিঠে ছুরি বসিয়েছে তারা’’— বলেছেন ইহুদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী।
১৭১৮
গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে গোলান মালভূমির দখল ‘অস্থায়ী’ বলে জানিয়েছিল ইজ়রায়েল। কিন্তু, এ বার আর সেই ভুল করতে নারাজ তেল আভিভ। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সুযোগ নিয়ে আপাতত ওই এলাকা ছাড়ার যে কোনও ইচ্ছাই তাঁদের নেই, তা-ও একরকম ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছেন ইহুদি রাজনীতিকেরা।
১৮১৮
গোলান মালভূমিতে ইজ়রায়েলের দখলকে প্রথম দিন থেকে মান্যতা দিয়ে আসছে আমেরিকা। যদিও বিশ্বের অধিকাংশ দেশ তা মানেনি। সূত্রের খবর, এ বারের আগ্রাসন শেষ হলে নতুন মানচিত্র প্রকাশ করবেন প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। সেখানে এই এলাকাগুলিকে ইহুদিভূমি হিসাবে দেখানো হবে। আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করেই ‘গ্রেটার ইজ়রায়েল’ তৈরির স্বপ্ন পূরণ করতে চাইছেন তিনি।