গৃহযুদ্ধে রক্তাক্ত সিরিয়ায় পরমাণু বোমার পরীক্ষা চালানোর অভিযোগ উঠেছে ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে। যদিও এই নিয়ে তেল আভিভের তরফে মেলেনি প্রতিক্রিয়া।
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ ১০:৫৪
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৯
পশ্চিম এশিয়ায় পরমাণু হামলা? যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় এ বার ছড়াল তেজস্ক্রিয়তার আতঙ্ক। অভিযোগের তির উঠেছে ইহুদি সেনার দিকে। সত্যি সত্যিই তাঁরা পরমাণু হাতিয়ার ব্যবহার করে থাকলে ভূমধ্যসাগরের তীরের বিশাল এলাকা যে মৃতের স্তূপে পরিণত হবে, তা বলাই বাহুল্য। যদিও এই বিষয়ে রা পর্যন্ত কাড়েনি ইহুদি দেশের সরকার বা ফৌজ।
০২১৯
চলতি বছরের ১৬ ডিসেম্বর প্রতিবেশী রাষ্ট্র সিরিয়ার বন্দর শহর তার্তাসে বড় রকমের বিমান হামলা চালায় ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ)। বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে গোটা এলাকা। পাশাপাশি অনুভূত হয় ভূকম্পন। এর পরই জোরালো হতে শুরু করে ইহুদি ফৌজের পরমাণু অস্ত্র প্রয়োগের তত্ত্ব।
০৩১৯
পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমগুলির একাংশের দাবি, সিরিয়ায় আমেরিকার তৈরি ‘বি-৬১’ পরমাণু বোমার পরীক্ষা চালিয়েছে আইডিএফ। যুদ্ধবিমান থেকে সেটি প্রতিবেশী দেশটির তার্তাসে নিক্ষেপ করে ইহুদি সেনা। এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত সংস্থা লকহিড মার্টিনের তৈরি এফ-৩৫ জেট ব্যবহৃত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
০৪১৯
গত শতাব্দীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শুরু হয় ঠান্ডা লড়াই। ওই সময়ে মস্কো ও ওয়াশিংটনের মধ্যে চলছিল পরমাণু হাতিয়ার বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা। সেখানে সোভিয়েতকে পিছনে ফেলতে ১৯৬৩ সালে ‘বি-৬১’ আণবিক বোমা তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্র।
০৫১৯
আমেরিকার প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগন জানিয়েছে, ‘বি-৬১’ হল প্রকৃতপক্ষে থার্মোনিউক্লিয়ার গ্র্যাভিটি বোমা। কৌশলগত আণবিক হাতিয়ার হিসাবে এটিকে ব্যবহারের কথা ভাবা হয়েছিল। ১৯৬৮ সাল থেকে এর ব্যাপক উৎপাদন শুরু করে ওয়াশিংটন। যদিও এখনও পর্যন্ত কোনও যুদ্ধেই ‘বি-৬১’ প্রয়োগ করেনি যুক্তরাষ্ট্র।
০৬১৯
পেন্টাগন সূত্রে খবর, দ্বিস্তরীয় তেজস্ক্রিয়তা বিকিরণের ক্ষমতা রয়েছে ‘বি-৬১’ পরমাণু বোমার। তবে এর বিকিরণ ক্ষমতা কম। এর মাধ্যমে গোটা একটা শহরকে চোখের নিমেষে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। আণবিক বোমাটি ১৪১.৬ ইঞ্চি লম্বা। এর ব্যাস ৩৪ সেন্টিমিটার এবং ওজন ৭১৫ পাউন্ড বা ৩১৫ কেজি।
০৭১৯
সংবাদ সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিরিয়ার তার্তাসে আকাশপথে হামলা হতে না হতেই মাটি কাঁপতে শুরু করে। প্রায় ৮৪০ কিলোমিটার দূরে তুরস্কের ইজ়নিক শহরেও সেই কম্পন অনুভূত হয়। বদলে যায় হাওয়ার গতি। রিখটার স্কেলে ওই কম্পনের মাত্রা তিন ছিল বলে দাবি করা হয়েছে।
০৮১৯
পশ্চিমি প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, সিরিয়ার তার্তাসে পরমাণু হামলা চালায়নি আইডিএফ। বরং সেখানে আণবিক পরীক্ষা করেছে ইজ়রায়েল। তাঁদের আরও দাবি, পশ্চিম এশিয়ার ইহুদি দেশে দীর্ঘ দিন ধরেই পরমাণু হাতিয়ার মোতায়েন রেখেছে আমেরিকা। গৃহযুদ্ধে রক্তাক্ত প্রতিবেশীর উপর সেই অস্ত্র চালিয়ে শক্তি বুঝে নেওয়ার সুযোগ ছাড়েনি ইহুদি ফৌজ।
০৯১৯
অন্য দিকে, এই যুক্তি মানতে নারাজ রাশিয়া। মস্কোর পাল্টা যুক্তি, আমেরিকার বোমা নিয়ে সিরিয়ায় পরমাণু পরীক্ষা চালানো ইজ়রায়েলের পক্ষে অসম্ভব। কারণ এই কাজের সবুজ সঙ্কেত কখনওই দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয়ত, এতে ইহুদি ভূমিতেও তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকছে। ফলে তেল আভিভের পক্ষে এই ঝুঁকি নেওয়া আত্মহত্যার শামিল। তা ছাড়া পশ্চিম এশিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ার কোনও প্রমাণ মেলেনি।
১০১৯
রুশ সরকারি সংবাদ সংস্থা স্পুটনিকে লেখা হয়েছে, আইডিএফ নতুন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের সাহায্যে সিরিয়ার যুদ্ধবিমানকে নিশানা করেছে। কিন্তু একে পরমাণু হামলা বলা যাবে না। তার্তাসে সিরিয়ার সরকারি সেনাবাহিনী প্রচুর পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলা-বারুদ মজুত রেখেছিল। সেই গুদাম উড়িয়েছে ইজ়রায়েল।
১১১৯
স্পুটনিকের দাবি, ওই হাতিয়ার ডিপোর মধ্যেই ছিল অতি শক্তিশালী স্কাড ক্ষেপণাস্ত্র। সেগুলিকেও পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছে ইহুদি বায়ুসেনা। আইডিএফের বিমানহানায় হাতিয়ার ডিপোয় আগুন ধরে যায়। সেখানেও লাগাতার বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। এর তীব্রতায় মাটি কাঁপা অস্বাভাবিক নয় বলে মনে করছেন রুশ প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।
১২১৯
পাশাপাশি, তুরস্কের ইজ়নিক শহরের ভূকম্পনের সঙ্গে পরমাণু হামলার যোগসূত্র থাকার কোনও প্রমাণ মেলেনি। ফলে এই তত্ত্ব মানতে নারাজ রাশিয়া। মস্কোর বিশ্লেষকেরা মনে করেন , ‘বি-৬১’ আণবিক বোমার প্রয়োগে ৮৪০ কিলোমিটার দূরে ভূমিকম্প হওয়া সম্ভব নয়। কারণ এটি কৌশলগত আণবিক হাতিয়ার। ওই এলাকা ভূকম্পপ্রবণ হওয়ায় প্রাকৃতিক কারণে সেটা অনুভূত হয়েছে বলে মনে করেন তাঁরা।
১৩১৯
গত ১৫ ডিসেম্বর বিদ্রোহী গোষ্ঠী ‘হায়াত তাহরির আল-শাম’ (এইচটিএস) এবং তাদের সহযোগী ‘জইশ আল-ইজ্জা’ দখল করে সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাস। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে দেশ ছেড়ে চম্পট দেন প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ। পালিয়ে গিয়ে রাশিয়ার আশ্রয় নেন তিনি। স্ত্রী-সহ গোটা পরিবারকে অবশ্য আগেই মস্কোয় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
১৪১৯
বিদ্রোহীদের হাতে দামাস্কাসের পতন হতেই সিরিয়ায় বিমানহানা শুরু করে ইজ়রায়েল। এর কারণ অবশ্য ব্যাখ্যা করেছে তেল আভিভ। ইহুদি দেশটি জানিয়েছে, আসাদ পালিয়ে যাওয়ায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রে নেই কোনও স্থায়ী সরকার। এই পরিস্থিতিতে আইসিস থেকে শুরু করে হিজ়বুল্লার মতো কট্টর ইজ়রায়েল-বিরোধী জঙ্গিদের হাতে সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর হাতিয়ার চলে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। আর তাই নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে আইডিএফকে হাতিয়ার এবং গোলা-বারুদের গুদাম ওড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
১৫১৯
পাশাপাশি, গোলান মালভূমির (গোলান হাইটস) দিক থেকে লাগাতার সিরিয়ার জমি কব্জা করছে তেল আভিভ। এই এলাকা ভবিষ্যতে হাতিয়ার, মানব এবং মাদক পাচারের করিডর হিসাবে ব্যবহার হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে ইজ়রায়েল। সেই কারণেই গোটা গোলান মালভূমিকে নিজেদের দখলে রাখতে চাইছেন ইহুদি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু।
১৬১৯
কিন্তু গোলান মালভূমি হাতিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স্তরে চাপের মুখে পড়েছে ইজ়রায়েল। আইডিএফের পুরনো অবস্থানে ফিরে যাওয়া নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জে হয়েছে ভোটাভুটি। সেখানে প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছে ভারত, পাকিস্তান এবং চিন-সহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশ। আমেরিকা ও ব্রিটেনকে অবশ্য পাশে পেয়েছেন ইহুদিরা।
১৭১৯
১৯৭৩ সালের আরব-ইজ়রায়েল যুদ্ধ শেষ হলে রাষ্ট্রপুঞ্জের নির্দেশে গোলান মালভূমিতে তৈরি হয় অসামরিক এলাকা। সেখানে টহলদারির দায়িত্ব নেয় রাষ্ট্রপুঞ্জের শান্তিসেনা। ওই এলাকার এক পাশে চলে যায় ইজ়রায়েল। এত দিন পর্যন্ত অন্য অংশের দখল ছিল সিরিয়ার সরকারি সেনাবাহিনীর হাতে।
১৮১৯
গোলান মালভূমির ওই অসামরিক এলাকাটি ৪০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। অভিযোগ, আসাদ সরকারের পতনের পর এর পুরোটাই ‘গিলে নিয়েছে’ আইডিএফ। সেখান থেকে কবে বাহিনী প্রত্যাহার করা হবে বা আদৌ হবে কি না, তার কোনও ইঙ্গিত দেয়নি নেতানিয়াহু প্রশাসন।
১৯১৯
গত ২০ ডিসেম্বর গোলান মালভূমির অসামরিক এলাকায় ফের শান্তিসেনা পাঠানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় রাষ্ট্রপু়ঞ্জ। কিন্তু পরে নিরাপত্তা পরিষদের নির্দেশে তা ছ’মাসের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। ওই অংশ এখন বাহিনী পাঠালে মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়ানো প্রায় অসম্ভব। আর তাই রাষ্ট্রপুঞ্জের মূল নীতি নির্ধারক সংস্থা নিরাপত্তা পরিষদ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।