ইজ়রায়েল বায়ুসেনার এয়ারস্ট্রাইকে কেঁপে উঠেছে সিরিয়ার বন্দর শহর তার্তুসের মাটি। সেখানে ইহুদিরা ‘ভূমিকম্প বোমা’ ফেলেছে বলে দুনিয়া জুড়ে জোর চর্চা শুরু হয়েছে।
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতাশেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ১২:৪০
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
পশ্চিম এশিয়ার বাতাসে শুধুই বারুদের গন্ধ! যুদ্ধবিমানের গর্জনে ঘুম ভাঙছে সেখানকার আমজনতার। দিনভর যত্রতত্র চলছে ‘কার্পেট বম্বিং’। বোমাবর্ষণের অভিঘাতে মাঝেমধ্যেই কেঁপে উঠছে মাটি। অনুভূত হচ্ছে ভূকম্পন। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই উঠছে ‘ভূমিকম্প’ বোমার প্রসঙ্গ। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে শিউরে উঠছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।
০২১৮
বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের পর থেকেই সিরিয়ার উপর লাগাতার ‘এয়ারস্ট্রাইক’ চালিয়ে যাচ্ছে ইজ়রায়েল। এ বার ইহুদি বায়ুসেনার বিরুদ্ধেই উঠল ‘ভূমিকম্প বোমা’ ব্যবহারের অভিযোগ। কম্পনের তীব্রতা রিখটার স্কেলে ধরা পড়েছে বলে জানিয়েছে সিরিয়ায় ‘মানবাধিকার মানমন্দির’ (অবজ়ারভেটরি অফ হিউম্যান রাইটস)।
০৩১৮
চলতি বছরের ১৫ ডিসেম্বর সিরিয়ার বন্দর শহর তার্তুসে ভয়ঙ্কর বিমান হামলা চালায় ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ)। সেই আক্রমণের পর ওই এলাকা তো বটেই, কেঁপে ওঠে আশপাশের মাটি। হামলার পরমুহূর্তের বিস্ফোরণের ছবি ইতিমধ্যেই সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে বিরাট আকারের আগুনের গোলাকে আকাশে উঠতে দেখেছে গোটা বিশ্ব।
০৪১৮
সিরিয়ার ‘মানবাধিকার মানমন্দির’ জানিয়েছে, ইহুদি বিমান হামলার জেরে তৈরি হওয়া ভূকম্পনের রিখটার স্কেলে তীব্রতা ছিল ৩.০। বন্দর শহর তার্তুস থেকে ৮২০ কিলোমিটার দূরে সিরিয়ার ইজ়নিক শহরে অবস্থিত তুরস্কের ম্যাগনেটোমিটার স্টেশন ওই কম্পন চিহ্নিত করে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে।
০৫১৮
‘অপারেশন তার্তুস’-এ অবশ্য কী ধরনের বোমা বা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে, তা স্পষ্ট করেনি আইডিএফ। ফলে ‘ভূমিকম্প বোমা’র অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেক প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ। তাঁদের যুক্তি, যুদ্ধে ব্যবহৃত অতি শক্তিশালী বোমা বা ক্ষেপণাস্ত্রে ছুড়ে গোটা এলাকাটাকে ধূলোয় মিশিয়ে দিতে চাইছে ইহুদি বায়ুসেনা। সেগুলির বিস্ফোরণে ভূমি কেঁপে ওঠা বিচিত্র ব্যাপার নয়।
০৬১৮
পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১২ সালের পর সিরিয়ার তার্তুসে এত বড় ‘এয়ারস্ট্রাইক’ চালায়নি ইজ়রায়েল। মূলত, আসাদ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা বিমান প্রতিরক্ষা ইউনিট, ভূমি থেকে ভূমি ক্ষেপণাস্ত্রের গুদাম, ২৩তম এয়ার ডিফেন্স ব্রিগেডের ঘাঁটি-সহ যাবতীয় সামরিক এলাকাকে নিশানা করছে আইডিএফ। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হামলাটি হয়েছে এয়ার ডিফেন্স ব্রিগেডের ঘাঁটিতে।
০৭১৮
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের অনুমান, বারুদ এবং হাতিয়ার গুদামের উপর ইজ়রায়েলি বোমাবর্ষণের জেরে সেগুলিতে আগুন ধরে গিয়েছে। ‘এয়ারস্ট্রাইক’-এর সঙ্গে সঙ্গেই সেখানেও বিস্ফোরণ শুরু হয়ে যায়। এই দু’য়ের অভিঘাতে মাটি কেঁপে উঠেছে। আর সেটাই ধরা পড়েছে রিখটার স্কেলে।
০৮১৮
‘ভূমিকম্প বোমা’র ব্যবহার নিয়ে এক্স হ্যান্ডেলে (সাবেক টুইটার) একটি পোস্ট করেছেন সিরিয়ার ‘মানবাধিকার মানমন্দির’-এ কর্মরত রিচার্ড কার্দারো। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘‘১৫ ডিসেম্বর স্থানীয় সময় রাত ৯টা ৪৮ মিনিট নাগাদ তার্তুস সামরিক ঘাঁটিতে বিস্ফোরণ শুরু হয়। আর ঠিক রাত ১০টা নাগাদ তা ইজ়নিকের তুর্কি ম্যাগনেটোমিটার স্টেশনে ধরা পড়ে। অর্থাৎ, কম্পনের ঢেউগুলির ৮২০ কিলোমিটার পথ পেরোতে সময় লেগেছে মাত্র ১২ মিনিট।’’
০৯১৮
রিচার্ড আরও জানিয়েছেন, সাধারণ ভূমিকম্পের তুলনায় প্রায় ‘দ্বিগুণ দ্রুততায়’ ওই কম্পন অনুভূত হয়েছে। তাঁর পোস্ট সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তেই দুনিয়া জুড়ে হইচই পড়ে যায়। উল্লেখ্য, তার্তুসে রাশিয়ার নৌঘাঁটি রয়েছে। সেখানে অবশ্য ইজ়রায়েলি বায়ুসেনা কোনও হামলা চালায়নি।
১০১৮
১৯৭১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের আমলে তার্তুসে নৌঘাঁটি তৈরি করে মস্কো। ভূমধ্যসাগরের ‘প্রবেশদ্বার’ হিসাবে এটিকে ব্যবহার করেন রুশ নাবিকেরা। ২০১৫ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে রাশিয়া। এর পর থেকেই ওই নৌঘাঁটি হাতিয়ার সরবরাহের জন্য ব্যবহৃত হয়ে এসেছে।
১১১৮
গত ৮ ডিসেম্বর বিদ্রোহীদের দখলে চলে যায় সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাস। প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়ে চম্পট দেন প্রেসিডেন্ট আসাদ। রাশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রতিবেশী দেশটির জমি কব্জা করছে ইজ়রায়েল। পাশাপাশি তেল আভিভের দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে যুদ্ধবিমান উড়ে গিয়ে সিরিয়ার বিভিন্ন শহরে লাগাতার চালাচ্ছে এয়ারস্ট্রাইক। ইতিমধ্যেই বিমান হানার সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়ে গিয়েছে।
১২১৮
ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এই বিমান হামলার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। বিদ্রোহীদের হাতে দামাস্কাসের পতনকে ইহুদি ভূমির পক্ষে নিরাপত্তার নিরিখে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘ইজ়রায়েলের উত্তর সীমান্তে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং নিরাপত্তার হুমকিকে নস্যাৎ করাই আমাদের এই হামলার লক্ষ্য।’’
১৩১৮
বাশার আল-আসাদ প্রেসিডেন্ট পদে থাকাকালীন সিরিয়ার জমি ইরান মদতপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘হিজ়বুল্লা’র হাতে হাতিয়ার তুলে দিতে যথেচ্ছ ব্যবহার হয়েছে বলে দীর্ঘ দিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে তেল আভিভ। দামাস্কাস বিদ্রোহীদের দখলে চলে যাওয়ায় যাবতীয় অস্ত্র ফেলে রেখে পালিয়েছে আসাদ বাহিনী। সেগুলি প্রতিবেশী লেবাননে চোরাচালানের প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। উত্তর ইজ়রায়েলের এই দেশটি ‘হিজ়বুল্লা’র গড় হিসাবে পরিচিত।
১৪১৮
কিন্তু সেই সুযোগ ইরানের মদতপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠীটিকে দিতে নারাজ ইজ়রায়েল। আর তাই আকাশপথে বোমাবর্ষণ চালিয়ে হাতিয়ারের গুদাম ওড়াতে শুরু করেছে আইডিএফ। অন্য দিকে ইহুদি ফৌজের এ হেন পদক্ষেপের কড়া সমালোচনা করেছেন সিরিয়ার বর্তমান শাসক আহমেদ আল-সারা। আসাদ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তাঁকেই দেশ চালানোর ভার দিয়েছে ‘হায়াত তাহরির আল-শাম’ বা এইচটিএস নামের বিদ্রোহী গোষ্ঠী।
১৫১৮
উল্লেখ্য, আসাদ সিরিয়া ছেড়ে পালাতেই দেশটির জমি হাতিয়ে নিতে ইহুদি ফৌজকে নির্দেশ দেন ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। সঙ্গে সঙ্গে গোলান মালভূমির (গোলান হাইটস্ নামে পরিচিত) বাফার জ়োন পেরিয়ে সিরিয়ার ভিতরে ঢুকতে শুরু করে আইডিএফ। পশ্চিম এশিয়ার দেশটির সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ‘মাউন্ট হেরমনে’-এর দখল নিয়েছে তাঁরা। এই এলাকার মানচিত্রে বদল আসবে বলে হুমকির সুর শোনা গিয়েছে নেতানিয়াহুর গলায়।
১৬১৮
ইজ়রায়েলের এই ধরনের পদক্ষেপগুলিকে ‘বিনা প্ররোচনায় আগ্রাসন’ বলে উল্লেখ করেছেন সিরিয়ার বর্তমান শাসক তথা বিদ্রোহী নেতা আল-সারা। এর ফলে পশ্চিম এশিয়ার পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে বলে বিবৃতি দিয়েছেন তিনি। অন্য দিকে আর এক বিদ্রোহী নেতা আবু মুহাম্মদ আল-জোলানি আবার বলেছেন, ‘‘ইহুদিরা অমূলক ভয় পাচ্ছে। আমরা সন্ত্রাসবাদের সমর্থক নই। ইজ়রায়েলের সঙ্গে আমরা কোনও সংঘাতে যেতে চাই না।’’
১৭১৮
১৯৬৭ সালের বিখ্যাত ছ’দিনের যুদ্ধে গোলান মালভূমির দখল নিয়েছিল ইজ়রায়েল। পরবর্তী সময়ে এর কিছুটা দামাস্কাসকে ফিরিয়ে দেয় তেল আভিভ। আমেরিকা ছাড়া দুনিয়ার অধিকাংশ দেশই আংশিক দখলে থাকা গোলান মালভূমিকে ইজ়রায়েলের অংশ বলে মান্যতা দেয়নি। ১৯৭৪ সালে সেখানে বাফার জ়োন তৈরি করে রাষ্ট্রপুঞ্জ। এর এক প্রান্তে সিরিয়া এবং অন্য প্রান্তটি ইহুদি ফৌজের দখলে থাকবে বলে ঠিক হয়। ৫৭ বছর পর ফের এক বার গোটা মালভূমিটি কব্জা করল আইডিএফ।
১৮১৮
২০১১ সাল থেকে সিরিয়ায় চলছে গৃহযুদ্ধ। রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট অনুযায়ী, এতে এখনও পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন পাঁচ লক্ষের বেশি মানুষ। গৃহহীনের সংখ্যা কয়েক লক্ষ। আসাদ সরকারের পতনে সেই গৃহযুদ্ধ থামল বলেই মনে করা হয়েছিল। কিন্তু ইজ়রায়েলি ডিফেন্স ফোর্স দামাস্কাসের ২৫ মাইলের মধ্যে পৌঁছে যাওয়ায় নতুন করে অস্থিরতা তৈরির সম্ভাবনা আছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।