মেঘের বীজ বপনের বিষয়টি কী? ক্ষেতে যেমন ফসলের বীজ ছড়িয়ে অথবা পুঁতে দেওয়া হয়, বৃষ্টি নামানোর জন্য খানিকটা সে ভাবেই মেঘের উপর কৃত্রিম মেঘ তৈরি করার চেষ্টা করেন গবেষকেরা।
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
নয়াদিল্লিশেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২৩ ১২:৩৭
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
দিল্লি এবং তার আশপাশের অঞ্চলে বায়ুদূষণ কমাতে বৃষ্টি বড় ভরসা। সম্প্রতি কৃত্রিম উপায়ে বৃষ্টির জন্য মেঘের বীজ বপন করেছেন আইআইটি কানপুরের গবেষকেরা। সে জন্য প্রায় ছ’বছর খরচ হয়েছে তাঁদের।
০২২০
ঘোর বর্ষায় কালো মেঘের সারি থেকে অঝোরে বৃষ্টি হলেই রাজধানী এবং তার লাগোয়া অঞ্চলের হাঁসফাঁস করা দূষণ অনেকটা কমে। উত্তরপ্রদেশের বহু অঞ্চলে বৃষ্টির অপেক্ষায় হা-হুতাশ করা মানুষজনের জন্য তাই সুখবর। সম্প্রতি ওই রাজ্যের বুন্দেলখণ্ডে মেঘের বীজ পুঁতেছেন দেশের এই নামজাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গবেষকেরা।
০৩২০
শুধু গ্রীষ্মেই নয়, বায়ুদূষণের জেরে কনকনে শীতেও কাবু হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত। রাজধানী এবং তার লাগোয়া অঞ্চলে শীতের মরসুমে দৃশ্যমানতা কমে যায়। দূষণ নিয়ন্ত্রণে আইআইটি কানপুরের একটি প্রকল্পে সায় দিয়েছিল কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক। সেই প্রকল্পের আওতায় মেঘের উপরে মেঘের বীজ বোনা হয়েছে।
০৪২০
মেঘের বীজ বপনের বিষয়টি কী? আসলে চাষবাসের জন্য ক্ষেতে যেমন ফসলের বীজ ছড়িয়ে অথবা পুঁতে দেওয়া হয়, বৃষ্টি নামানোর জন্য খানিকটা সে ভাবেই মেঘের উপর কৃত্রিম মেঘ তৈরি করার চেষ্টা করেন গবেষকেরা।
০৫২০
কৃত্রিম বৃষ্টির জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে আবহাওয়ায় খানিকটা রদবদল করা হয়। সে জন্য ড্রোনের মাধ্যমে মেঘের উপর সিলভার আইয়োডাইডের মতো রাসায়নিক অথবা ড্রাই আইস কিংবা খাওয়ার নুন ছড়িয়ে দেন গবেষকেরা। যাতে সেই মেঘের স্তর গাঢ় করা যায়। তার থেকেই বৃষ্টির সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
০৬২০
বায়ুতে যে যৎসামান্য জল থাকে তা মেঘে ছড়ানো রাসায়নিকের কণার আশপাশে ঘনীভূত হয়ে স্ফটিকের মতো বরফের দানার আকার নেয়। এর থেকে কৃত্রিম ভাবে বৃষ্টির সম্ভাবনা বাড়ে যায়। এই পদ্ধতিকে ‘নিউক্লিয়েশন’ বলা হয়।
০৭২০
মেঘের উপর রাসায়নিক ছড়ানোর জন্য ড্রোন ছাড়াও বিমান অথবা রকেট ব্যবহার করেন গবেষকেরা।
০৮২০
কৃত্রিম বৃষ্টির জন্য ২৮ জুন, বুধবার নিজেদের ক্যাম্পাসে একটি পরীক্ষা করে আইআইটি কানপুর। তাতে সাফল্যও আসে। বুধবার ক্যাম্পাস থেকে ৫,০০০ ফুট উঁচুতে বিমান উড়িয়ে মেঘের উপর রাসায়নিক ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে মেঘের স্তরকে আরও ঘন করা যায়। যা বৃষ্টি আনতে অনুঘটকের কাজ করবে।
০৯২০
মেঘের বীজ বোনার এই পদ্ধতি অবশ্য নতুন নয়। ১৯৪৬ সালে প্রথম বার এই পদ্ধতিতে বীজ বুনেছিল আমেরিকার বহুজাতিক সংস্থা জেনারেল ইলেকট্রিক। সংস্থার তরফে সে উদ্ভাবনে করেছিলেন সে দেশের রসায়নবিদ তথা আবহবিজ্ঞানী ভিনসেন্ট স্যাফার।
১০২০
ভিনসেন্টের কাজের ছ’বছর পর কলকাতায় এই পদ্ধতিতে কৃত্রিম মেঘ তৈরি করেছিলেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞ এসকে বন্দ্যোপাধ্যায়। এর পরের ৬০ বছরে কর্নাটক, অন্ধ্রপ্রদেশে এবং মহারাষ্ট্রে মূলত খরা রুখতে অথবা বাঁধের জলস্তর বৃদ্ধি করতে এই পদ্ধতিতে কৃত্রিম মেঘসঞ্চার করা হয়েছিল।
১১২০
পুণের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ট্রপিক্যাল মিটিয়োরোলজি (আইআইটিএম)-এর অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী জেআর কুলকার্ণী বলেন, ‘‘সাধারণত কৃত্রিম মেঘ তৈরি করতে মেঘের প্রয়োজন হয়। তবে যে মেঘগুলি উলম্ব আকৃতির হয়, তার উপরেই মেঘের বীজ বোনা যায়।’’
১২২০
কৃত্রিম ভাবে বৃষ্টির জন্য যে ধরনের মেঘের সাহায্য নেওয়া হয়, সেগুলিকে পরিবাহী মেঘ বলা হয়। তবে বৃষ্টি নামাতে দিগন্ত বিস্তৃত স্তরীভূত মেঘের উপর এই বীজ বোনা হয় না বলে জানিয়েছেন কুলকার্ণী।
১৩২০
বুন্দেলখণ্ডে কৃত্রিম উপায়ে বৃষ্টি নামানোর জন্য কানপুরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হয় উত্তরপ্রদেশ সরকার। এই প্রকল্পের দায়িত্বে ছিলেন প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মণীন্দ্র আগরওয়াল। সংবাদমাধ্যমের কাছে তিনি বলেন, ‘‘বৃষ্টির লক্ষ্যে আমাদের পরীক্ষা সফল হয়েছে।’’
১৪২০
২০১৭ সালে এই প্রকল্পের ছাড়পত্র দিয়েছিল উত্তরপ্রদেশ সরকার। সে সময় মহোবা শহরে মেঘের বীজ বোনার কাজে রাজি হয়েছিলেন চিনের গবেষকেরা।
১৫২০
প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১০ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা পারিশ্রমিকে চিনের গবেষকেরা সে প্রকল্পে কাজ করতে চেয়েছিলেন। তবে উত্তরপ্রদেশ সরকারকে প্রকল্পের খুঁটিনাটি জানাতে নারাজ ছিলেন তাঁরা। শেষমেশ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়নি। এর পর আইআইটি কানপুরের দ্বারস্থ হয় সরকার।
১৬২০
যে প্রযুক্তিতে কৃত্রিম উপায়ে বৃষ্টি নামানো যায়, তা উপলব্ধ হলেও এই পদ্ধতি কাজে লাগাতে ছ’বছর সময় লাগল কেন? গবেষকদের দাবি, বিমানে করে যে সব যন্ত্রপাতি নিয়ে মেঘের বীজ বোনা হত, সেই বিমানটিই জোগাড় করতে পারেননি তাঁরা।
১৭২০
ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর থেকে বিমান জোগাড়ের চেষ্টা করলেও তাতে নাকি সাড়া দেননি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এর পর ৫০ লক্ষ টাকার চুক্তিতে একটি বিমান দিতে রাজি হয়েছিল হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড (হ্যাল)। তবে অন্যান্য যন্ত্রপাতির জন্য সে অর্থ বরাদ্দ থাকায় ওই প্রকল্প আটকে যায় বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক আগরওয়াল।
১৮২০
চিনের গবেষকেরা প্রকল্প ছেড়ে বেরিয়ে গেলে ২০১৭ সালের ২৬ জুন উত্তরপ্রদেশ সরকারের কাছে এই প্রকল্পের সবিস্তার জানিয়ে আবেদন করে আইআইটি কানপুর। বায়ুদূষণ এবং খরার মতো পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝতে থাকা বুন্দেলখণ্ডে প্রকল্পের পরীক্ষায় রাজি হয়ে যায় ওই রাজ্য সরকার।
১৯২০
এই প্রকল্পে বিমানের গুরুত্ব রয়েছে বলে জানিয়েছেন কানপুরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক তথা পরিবেশ বিষয়ক জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সচিদানন্দ ত্রিপাঠী। বিমানভাড়ার পাশাপাশি মেঘের বীজ ছড়াতে বিমানের সঙ্গে যন্ত্রপাতি লাগানোর খরচও রয়েছে। ত্রিপাঠী জানিয়েছেন, বীজ বুনতে প্রতি ঘণ্টায় ২ থেকে ৫ লক্ষ টাকা খরচ হয়।
২০২০
ত্রিপাঠী জানিয়েছেন, ইজ়রায়েল, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং আমেরিকায় মেঘের বীজ থেকে বৃষ্টির ফসল পেয়েছেন গবেষকেরা।