সিঙ্গাপুরের ওই সভায় মোদী হিন্দিতে কথা বলছিলেন। তাই উপস্থিত জনতার কাছে ভুলটা ধরা পড়েনি। তবে সবার চোখ ফাঁকি দেওয়া যায়নি। বিষয়টি নজর করেন কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী। টুইটারে মোদীর বক্তব্য এবং দোভাষীর অনুবাদের ভিডিয়ো পোস্ট করে রাহুল লেখেন, ‘ভাগ্যিস দেশের প্রধানমন্ত্রী আগে থেকে ঠিক করে রাখা প্রশ্নের উত্তর দেন! তাই দোভাষীরাও আগে থেকে মুখস্থ করে আসা উত্তর গড়গড়িয়ে বলে যেতে পারেন। যদি জনতার কাছ থেকে আসা সবরকম প্রশ্নের উত্তর দিতে হত, তা হলে তিনি এবং তাঁর দেশের মানুষ রীতিমতো অপদস্থ হতেন।’
সমালোচনাটি গায়ে লাগার মতো। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কথায়, আসল ব্যাপারটা তার থেকেও অনেক বেশি গুরুতর। তাঁরা বলছেন, ঘটনাটি সিঙ্গাপুরে ঘটেছে। তাই মোদী কী বলছেন এবং দোভাষী কী জানাচ্ছেন, তার সবটাই আমরা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু মোদী যখন রাশিয়ায় ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে কথা বলেন বা চিনে গিয়ে বৈঠক করেন শি জিন পিংয়ের সঙ্গে, তখন কী হয়? সেখানে মোদী কী বলছেন বুঝতে পারলেও তাঁর দোভাষী কী বলছেন, তা বোঝার ক্ষমতা নেই কারও।
তবে ভরসার বিষয় হল, দোভাষীরা কি বলছেন, তা লক্ষ্য করারও লোক আছে। যেমন, চিনে গেলে মোদীর সঙ্গে থাকেন তাঁর মান্দারিন ভাষার দোভাষী আর মধুসূদন এবং শিল্পক মন্দুলে। মধুসূদন বেজিংয়ের ভারতীয় দূতাবাসে কাজ করেন। আর শিল্পক দিল্লির বিদেশমন্ত্রকের দফতরের কর্মী। মান্দারিন ভাষায় এঁদের এতটাই দখল যে, দিব্য বেজিংয়ের বাসিন্দা বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। তবু মোদীর বৈঠকে এঁরা কী বলছেন, তাতে লক্ষ্য রাখেন বিদেশ সচিব বিজয় গোখলে। যাঁর নিজেরও মান্দারিন ভাষায় যথেষ্ট দখল।
রাশিয়ান ভাষায় মোদীর দোভাষীর নাম বিপিন কুমার। বিপিনকে বিদেশ থেকে ভারতে আনা হয়েছিল শুধু সোচিতে পুতিন-মোদী বৈঠকের জন্য। যে বৈঠকে প্রমোদতরীতে হাতে হাত রেখে একসঙ্গে ভ্রমণ করবেন মোদী-পুতিন। আলিঙ্গন করবেন একে অপরকে। ঘোষণা করবেন— রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের কৌশলগত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবার বদলে গেল আরও উন্নততর বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে। ভাষায় কি না হয়!
রাশিয়ান দোভাষী বিপিন অবশ্য এখন তাঁর বিদেশি ভাষা শিক্ষার ডিগ্রি সম্পূর্ণ করছেন ক্যালিফোর্নিয়ার মন্টেরির ‘ডিফেন্স ল্যাঙ্গোয়েজ ইনস্টিটিউট অব ফরেন ল্যাঙ্গোয়েজ’-এ। ভাষাশিক্ষায় দিন দিন মন্টেরির কদর বাড়ছে ভারতীয় বিদেশমন্ত্রকের কর্মীদের মধ্যে। আসলে বিদেশমন্ত্রকের কর্মী মানেই ধরে নেওয়া হয় তিনি একাধিক ভাষা বলতে পারঙ্গম।
বিদেশমন্ত্রকের কার্যালয়ের একটি পরিচিত ঠাট্টার বিষয় হল, সেখানে কোথায় পোস্টিং প্রশ্ন করার আগে জানতে চাওয়া হয় কী ভাষা বলতে পারেন। মান্দারিন হলে তোমায় ঠেকায় কে! রাশিয়ান? দারুণ ব্যাপার। আমেরিকান! ট্রাম্পের আমলের পর থেকে কদর বেড়েছে এঁদেরও। জড়ানো উচ্চারণে অদ্ভুত সব আমেরিকান শব্দের অজানা রহস্য খুলবে কে?
এককালে বিদেশ দফতরের ভাষা ছাত্রদের চেনা গন্তব্য ছিল জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অফ ল্যাঙ্গোয়েজ’। তবে এখন ধারা বদলেছে। জেএনইউ-এর জায়গা নিয়েছে মন্টেরি। তবে বিদেশমন্ত্রকের কার্যালয়ে এখনও অনেকে আছেন, যাঁরা জেএনইউ বা মন্টেরির প্রশিক্ষণ ছাড়াই চোস্ত রাশিয়ান বলতে পারেন। এঁদের মধ্যে দু’জন পুরনো বিশ্বস্তের নাম শিপ্রা দাস এবং জি বালাসুব্রহ্মণ্যম।
মোদীর সাম্প্রতিক দোভাষী বিড়ম্বনার কারণ নীলাক্ষি কি মন্টেরিতে গিয়েছিলেন? জানা নেই। তবে একটা সময় তো এমনও ছিল, যখন জেএনইউ বা মন্টেরি কিছুই ছিল না। তখন মোদীর মতো রাষ্ট্রনেতাদের বিদেশ-ভরসা কারা হতেন? কে তাঁদের বলে দিত রাশিয়ান ডিনারে ‘ব্ল্যাক ব্রেড’ বা চিনা আমন্ত্রণে ‘মাও তাই’ স্যুপ বস্তুটি কী? কী ভাবে খেতে হয়!
বাসুদেওকে পরবর্তীকালে দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত করে পাঠায় ভারত সরকার। তবে নিজের জগতের বাইরে তাঁর কীর্তি অজানাই ছিল বহুদিন। পরে সে সব প্রকাশ্যে আসে এক চিনা শিক্ষাবিদ তান চুং-এর লেখা বই ‘হিমালয় কলিং: দ্য অরিজিনস অব চায়না অ্যান্ড ইন্ডিয়া’-তে। সেখানে বাসুদেওকে নিয়ে একটি সুন্দর ঘটনার কথা লিখেছিলেন তিনি।
ঘটনাটি ১৯৫৪ সালের। তখন ‘হিন্দি-চিনি ভাই-ভাই’ পর্ব জেটগতিতে এগোচ্ছে। জওহরলাল সে সময় চিনে গিয়েছিলেন মাওয়ের সঙ্গে দেখা করতে। পূর্ণিমার রাত। বেজিংয়ের জোংনানহাইয়ে মাওয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠতে যাবেন নেহরু, ঠিক তখনই তাঁর হাত দু’টো ধরে কবিতার লাইন বলতে শুরু করেন মাও। চিনের বিখ্যাত কবি কিউ ইউয়ানের কবিতা। যার অর্থ, দুঃখ দুঃখতর হয় যখন বন্ধু দূরে যায়। আনন্দ আনন্দতর হয় সুন্দর মানুষের সান্নিধ্যে। আবেগঘন ওই মুহূর্ত সম্পূর্ণ জলে যেত, যদি বসন্ত বাসুদেও ঠিক সময়ে ওই কয়েক ছত্রের অর্থ নেহরুকে না বোঝাতেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy