Greenland Ireland UK Gap a strategic chokepoint in North Atlantic Ocean for US dgtl
GIUK Gap
ফাঁক গলে সুমেরু পেরিয়ে ঢুকবে রুশ ডুবোজাহাজ? গ্রিনল্যান্ডের পাশের গর্ত চিন্তা বাড়াচ্ছে আমেরিকার
উত্তর আটলান্টিকের ‘গ্রিনল্যান্ড-আইসল্যান্ড-ইউকে গ্যাপ’-এর কৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম। সেই কারণেই কি বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপটি কব্জা করতে চাইছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প?
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৭ জানুয়ারি ২০২৫ ১৩:৩৯
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২৩
ভোটে জিতেই বরফে ঘেরা গ্রিনল্যান্ডকে আমেরিকার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার কথা বলতে শোনা গিয়েছে সেখানকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গলায়। ২০২৫-এর ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে শপথ নিয়েছেন তিনি। এ বার কি বিশ্বের সবচেয়ে বড় দ্বীপটিকে কব্জা করতে সেখানে সেনা পাঠাবেন বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতা? এই নিয়ে চর্চায় মেতেছেন দুনিয়ার তাবড় প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।
০২২৩
গ্রিনল্যান্ডের কৌশলগত অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের বৃহত্তম দ্বীপটির গা ঘেঁষে উত্তর মেরুতে গিয়ে মিশেছে আটলান্টিক মহাসাগর। সুমেরু এলাকায় রাশিয়ার আধিপত্য রয়েছে। সেখান থেকে দ্রুত নীচে নেমে এসে গ্রিনল্যান্ড দখল মস্কোর পক্ষে খুব কঠিন নয়। আর ঠিক এই আশঙ্কা থেকেই দ্বীপটিকে কব্জা করতে উঠেপড়ে লেগেছেন ট্রাম্প।
০৩২৩
যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর অংশে গ্রিনল্যান্ডের অবস্থান। এক বার সেটি রুশ ফৌজের দখলে গেলে, বলা বাহুল্য প্রশ্নের মুখে পড়বে আমেরিকার নিরাপত্তা। তখন খুব সহজেই পশ্চিম দিকের রাজধানী ওয়াশিংটন বা বাণিজ্যশহর নিউ ইয়র্ক চলে আসবে মস্কোর ক্ষেপণাস্ত্রের নিশানায়। সেই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার সুযোগ দিতে নারাজ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
০৪২৩
গ্রিনল্যান্ডের অদূরেই রয়েছে আইসল্যান্ড এবং ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ। তিনটি দ্বীপের মধ্যে মোট দু’টি সামুদ্রিক রাস্তা রয়েছে। দুনিয়ার তাবড় নৌসেনা কর্তারা এর নাম দিয়েছেন ‘গ্রিনল্যান্ড-আইসল্যান্ড-ইউকে গ্যাপ’ বা জিআইইউকে গ্যাপ। সমুদ্রের লড়াইয়ে এই দুই রাস্তাকে বড় ‘চোকপয়েন্ট’ বলে উল্লেখ করেছেন তাঁরা।
০৫২৩
রণতরী হোক বা মালবাহী জাহাজ— সমুদ্রপথে ইউরোপ থেকে উত্তর আমেরিকা যেতে গেলে জিআইইউকে গ্যাপ ছাড়া অন্য রাস্তা নেই। আর সেই কারণেই এর গুরুত্ব অপরিসীম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ‘গেম চেঞ্জার’-এর ভূমিকা নিয়েছিল এই সামুদ্রিক রাস্তা।
০৬২৩
বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন আমেরিকা থেকে হাতিয়ার এবং রসদ জিআইইউকে গ্যাপ পেরিয়ে অহরহ পৌঁছত ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের বন্দরে। ফলে অ্যাডল্ফ হিটলারের জার্মানির বিরুদ্ধে কখনওই গোলা-বারুদের অভাবে ভুগতে হয়নি তাদের। শুধু তা-ই নয়, আটলান্টিকের এই এলাকাটিকে ব্যবহার করে জার্মান রণতরী এবং ডুবোজাহাজগুলিকে ডুবিয়েছিল মিত্র পক্ষ।
০৭২৩
বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আইসল্যান্ড এবং গ্রিনল্যান্ডে একাধিক সামরিক ঘাঁটিও তৈরি করেছিল মিত্র শক্তি। ফলে হাতিয়ার এবং গোলা-বারুদ লুকিয়ে রাখার সুযোগ পায় তারা। জার্মান বা ইটালির পক্ষে জিআইইউকে গ্যাপ পেরিয়ে সেখানে আক্রমণ শানানো কখনওই সম্ভব হয়নি। পরবর্তী কালে এই কৌশল মিত্র বাহিনীর জয়ের রাস্তা খুলে দিয়েছিল।
০৮২৩
১৯৪৫ সালে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে দু’টি মহাশক্তিতে বিভক্ত হয়ে যায় বিশ্ব। তার মধ্যে একটি হল আমেরিকা এবং দ্বিতীয়টি সোভিয়েত রাশিয়া। ফলে পরবর্তী দশকগুলিতে এদের মধ্যে চলতে থাকে ‘ঠান্ডা লড়াই’। এই সময়ে জিআইইউকে গ্যাপের গুরুত্ব কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছিল।
০৯২৩
কমিউনিস্টশাসিত সোভিয়েত আগ্রাসন ঠেকাতে ১৯৪৯ সালে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলির সঙ্গে ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংগঠন’ (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন বা নেটো) গড়ে তোলে আমেরিকা। এর পরই জিআইইউকে গ্যাপে নজরদারি শুরু করে নেটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলি। সোভিয়েত ডুবোজাহাজের আটলান্টিকে ঢোকা আটকাতে এই চোকপয়েন্টটি ব্যবহার করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন নৌকম্যান্ডারেরা।
১০২৩
জিআইইউকে গ্যাপে নজরদারির জন্য কোলা উপদ্বীপে তৈরি হয় নেটোর সেনাঘাঁটি। সেখানে সাউন্ড সার্ভিলেন্স সিস্টেম মোতায়েন করে আমেরিকার প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগন। পাশাপাশি, যুদ্ধবিমানের সাহায্যে সামুদ্রিক এলাকাটির উপর শ্যেন দৃষ্টি রেখেছিল ওয়াশিংটন। তবে ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের যোগ্য সহযোগিতা পেয়েছিল আটলান্টিকের পারের ‘সুপার পাওয়ার’।
১১২৩
১৯৯১ সালে সোভিয়েতের পতনের পর জিআইইউকে গ্যাপের উপর নজরদারি কমিয়ে দেয় আমেরিকা। নেটোভুক্ত দেশগুলিও তাদের সামরিক সরঞ্জাম ওই এলাকা থেকে সরিয়ে নিয়েছিল। সম্ভাব্য রুশ আক্রমণের আশঙ্কা একেবারে কমে যাওয়ায় এই সিদ্ধান্ত নেয় পেন্টাগন।
১২২৩
রাশিয়ার উত্তর অংশে রয়েছে পুরু বরফের চাদরে ঢাকা সুমেরু। সেখান থেকে মস্কোর উপর আক্রমণ চালানো সম্ভব নয়। এই প্রাকৃতিক কবচ থাকার কারণে এত দিন জিআইইউকে গ্যাপ নিয়ে সে ভাবে ক্রেমলিনকে মাথা ঘামাতে হয়নি। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করেছে, মানছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।
১৩২৩
বিশ্ব উষ্ণায়নের জেরে উত্তর মেরুর বরফ ধীরে ধীরে গলতে শুরু করেছে। এর জেরে রুশ প্রাকৃতিক কবচে ধরছে চিড়। বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, আগামী দিনে আটলান্টিক পেরিয়ে উত্তর অংশ দিয়ে মস্কোকে আক্রমণ করা খুব বেশি কঠিন হবে না। আর সেটা বুঝতে পেরেই জিআইইউকে গ্যাপের উপর প্রভাব বিস্তার করা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে ক্রেমলিন।
১৪২৩
২০১০ সাল থেকে নৌবাহিনীতে সংস্কারের কাজ চালাচ্ছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ডুবোজাহাজের সংখ্যা বৃদ্ধি করে চলেছেন তিনি। সূত্রের খবর, জিআইইউকে গ্যাপের চোকপয়েন্ট এড়িয়ে আটলান্টিকের পথ খোঁজার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে মস্কো। শেষ পর্যন্ত তা পেয়ে গেলে নেটোর চ্যালেঞ্জ যে বহু গুণে বাড়বে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
১৫২৩
জিআইইউকে গ্যাপ এবং এর সংলগ্ন এলাকার অন্য গুরুত্বও রয়েছে। আটলান্টিকের ওই এলাকায় সমুদ্রের গভীরে ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানকারী কেব্লের জাল বিছানো রয়েছে। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, লড়াইয়ের সময়ে ওই তারগুলিকে নিশানা করতে পারে রুশ নৌসেনা। বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট ট্র্যাফিকের ৯৫ শতাংশের বেশি সংশ্লিষ্ট কেব্লগুলি বহন করে বলে জানা গিয়েছে।
১৬২৩
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের একাংশের দাবি, আগামী দিনে হাইব্রিড মডেলের যুদ্ধের দিকে পা বাড়াবে রাশিয়া। আটলান্টিকের গভীরে ইন্টারনেট কেব্ল কেটে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে মস্কোর। এতে বিকল হয়ে পড়বে নেটোভুক্ত দেশগুলির যোগাযোগ ব্যবস্থা। পাশাপাশি আর্থিক ভাবেও দুর্বল হবে তারা।
১৭২৩
রুশ ডুবোজাহাজগুলির চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে আমেরিকা-সহ নেটোভুক্ত দেশগুলি হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে, তা ভাবলে ভুল হবে। নতুন করে জিআইইউকে গ্যাপ এলাকায় টহলদারি শুরু করেছে তারা। সেখানে প্রায়ই চক্কর কাটছে যুদ্ধবিমান। মস্কোর ডুবোজাহাজ চিহ্নিত করতে ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন প্রযুক্তি।
১৮২৩
জিআইইউকে গ্যাপে নজরদারি চালাতে সমুদ্রের গভীরে চলাচলকারী বিশেষ ধরনের ড্রোন তৈরি করছে আমেরিকা। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘ওর্কা’। ২০১৭ সাল থেকে এ ব্যাপারে কাজ করে চলেছে যুক্তরাষ্ট্রের দু’টি সংস্থা বোয়িং এবং হান্টিংটন ইঙ্গল্স ইন্ডাস্ট্রিজ়।
১৯২৩
প্রসঙ্গত, গ্রিনল্যান্ড উত্তর আমেরিকা মহাদেশের মধ্যে থাকলেও, এটি সেখানকার অন্তর্ভুক্ত নয়। উত্তর আমেরিকা মহাদেশের একটি আধা স্বশাসিত দ্বীপ। এটিকে ইউরোপ মহাদেশের ডেনমার্কের একটি অংশ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
২০২৩
প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে থেকেই ট্রাম্প জানিয়ে আসছেন, তিনি গ্রিনল্যান্ডকে আমেরিকার অন্তর্ভুক্ত করতে চান। তাঁর মতে, বৈশ্বিক নিরাপত্তা এবং স্বাধীনতার স্বার্থে গ্রিনল্যান্ডের মালিকানা এবং নিয়ন্ত্রণ আমেরিকার হাতে থাকা অত্যন্ত জরুরি।
২১২৩
সম্প্রতি এ ব্যাপারে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসেনের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট। ‘দ্য ফিনানশিয়াল টাইম্স’-এর প্রতিবেদন অনুসারে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের আধিকারিকেরা জানিয়েছেন, গ্রিনল্যান্ড নিয়ে রীতিমতো ‘হম্বিতম্বি’ করেন তিনি।
২২২৩
কিন্তু ট্রাম্পের দাবি পত্রপাঠ নাকচ করে দিয়েছেন ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী ফ্রেডেরিকসেন। খনিজ সম্পদে ভরা দ্বীপটি ‘বিক্রি’ করতে কোপেনহেগেন একেবারেই আগ্রহী নয় বলে বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। আমেরিকার এই আগ্রাসী মনোভাবে আপত্তি জানিয়েছে ফ্রান্স ও জার্মানিও।
২৩২৩
এই পরিস্থিতিতে ট্রাম্প জোর করে গ্রিনল্যান্ড দখল করতে গেলে রাশিয়া চুপ করে বসে থাকবে কি না, তা-ও বলা কঠিন। যদিও এই ব্যাপারে এখনও কোনও প্রতিক্রিয়া দেননি প্রেসিডেন্ট পুতিন। উল্টে ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করায় ট্রাম্পের ভূমিকার প্রশংসাই করেছেন তিনি।