১৯৭৪ সালে রাজস্থানের জয়পুরে জন্ম অমিতের। তাঁরা দুই ভাই। অমিত এবং আদিত্য। আদিত্য বড়। বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অমিত যখন জন্মেছিলেন, এক জ্যোতিষী নাকি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, এই ছেলে এক দিন অপরাধের দুনিয়ায় দাপিয়ে বেড়াবেন। এ কথা শুনে তাঁর মা আশঙ্কা করেছিলেন, ছেলে হয়তো কুখ্যাত অপরাধী হবে। কিন্তু না, অপরাধী নয়। সেই ছেলেই পরবর্তী কালে হয়ে উঠেছে অপরাধীদের ‘যম’।
কিন্তু আইআইটিতে ঠিক সুবিধা করতে পারছিলেন না অমিত। ফলে পরীক্ষার রেজাল্টও খারাপ হয় তাঁর। যে প্রতিষ্ঠানে এত ভাল ভাল ছাত্রছাত্রী, সেখানে তাঁর খারাপ ফল হওয়ায় হীনম্মন্যতায় ভুগতে শুরু করেন অমিত। এক সাক্ষাৎকারে অমিত বলেন, “প্রত্যেকেই আমার কাছ থেকে ভাল ফল আশা করেছিলেন। কিন্তু সেই আশা পূরণ করতে পারিনি। ফলে ক্রমশ অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। নিজেকে সবচেয়ে কুৎসিত মনে হত।”
অমিত বলেন, “একটা সময় আত্মহত্যার চিন্তাভাবনাও করেছিলাম। নিজেকে অত্যন্ত অশুভ বলে মনে হত। যাই হোক, চার বছরের পড়াশোনা কোনও রকমে শেষ করে জয়পুরে নিজের বাড়িতে ফিরে আসি। কিন্তু চাকরি খোঁজার কোনও চেষ্টা ছিল না আমার মধ্যে। ঘরের মধ্যে নিজেকে বন্দি করে রাখতাম। কখন ঘুমোচ্ছি, কখন উঠছি, সেই সময়েরও কোনও ঠিক ছিল না।”
অমিত ক্রমশ অবসাদে ডুবে যেতে থাকায় তাঁর পরিবার সেই অবস্থা থেকে বার করে আনার চেষ্টা করে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়। তাঁর কথায়, “অবশেষে বন্ধুদের সহযোগিতাই আমাকে ওই পরিস্থিতি থেকে বার করে এনেছিল। ওরাই আমাকে দিশা দেখিয়েছিল। বলেছিল, তুই সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বস। সেই পরামর্শ মনে গেঁথে গিয়েছিল। আইপিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিই। আশ্চর্যজনক ভাবে সেই পরীক্ষায় পাশও করি। সবাই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন আমার এই সাফল্যে। তার পর আর ফিরে তাকাতে হয়নি।”
এক সাক্ষাৎকারে অমিত বলেন, “আমার জন্মভূমি রাজস্থান থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে এক জন তরুণ অফিসার হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছিল। সবে দায়িত্ব পেয়েছি। কোথা থেকে, কী ভাবে শুরু করব তার থই পাচ্ছিলাম না। অবাক হয়ে ভাবছিলাম কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে আমার কর্মভূমিতে কী ভাবে কাজ শুরু করব। এক জন আইপিএস অফিসার, তা-ও আবার খুবই অল্প বয়স, বড় একটা দায়িত্ব পাওয়ার পর মনে হচ্ছিল, যেন অন্ধের হাতে কোনও মূল্যবান জিনিস তুলে দেওয়া হয়েছে।”
অমিত বলেন, “নব্বইয়ের দশকে আমি যখন বিহারে দায়িত্ব পেয়ে আসি, তখন অপরাধদমনে হিমসিম খাচ্ছিল রাজ্য। তরুণ প্রজন্ম উচ্চশিক্ষার জন্য অন্য রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছিল। এমনকি কোনও খ্যাতনামী চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ীও বিহারে আসতে ভয় পেতেন। তাঁদের আশঙ্কা ছিল, বিহারে গেলেই হয় তাঁকে, না হয় তাঁর পরিবারের সদস্যদের অপহরণ করা হবে, না হয় গুলি করে মারা হবে।”
এক জন তরুণ অফিসার। ছিপছিপে গড়ন। সদ্য দায়িত্ব পাওয়া সেই অফিসারই যে বিহারের ‘সুপার কপ’ হয়ে উঠবেন কেউ ভাবতে পারেননি। পটনা, বেগুসরাই, শেখপুরা, মুজফফরপুর— অপরাধের আখড়া ছিল এই জায়গাগুলি। প্রথমে নালন্দা জেলার দায়িত্ব পান অমিত। তার পর শেখপুরা। সেখানে দায়িত্ব পেয়েই ওই জেলার কুখ্যাত দুষ্কৃতী বিজয় সম্রাটকে গ্রেফতার করে গোটা রাজ্যকে চমকে দিয়েছিলেন অমিত। এই ঘটনার জন্য তাঁকে গ্যালান্ট্রি অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়।
২০০৬ সাল। শেখপুরাতে ১৫ জন খুন হয়ে হয়েছিলেন। তার মধ্যে এক জন বিধায়ক, এক জন সাংসদ এবং এক জন বিডিও ছিলেন। নীতীশ কুমার তখন বিহারের ক্ষমতায়। নালন্দা থেকে শোখপুরাতে পুলিশ সুপার হিসাবে বদলি করে পাঠানো হয় অমিতকে। তিনি বলেন, “শেখপুরাতে ঢুকেই দেখেছিলাম সেখানে একটা যুদ্ধের মতো আবহ তৈরি হয়েছে। চারদিকে তখন দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য। তার মধ্যে পর পর খুন মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছিল।”
শেখপুরাতে গিয়ে প্রথমে গ্যাংস্টার বিজয় সম্রাটকে গ্রেফতার করেন অমিত। আর সেই ঘটনাই তাঁকে সকলের চোখে ‘হিরো’ করে তুলেছিল। কিন্তু তার পরেও শেখপুরা, বেগুসরাই, মুজফফরপুর এবং পটনাতে অপরাধ বেড়েই চলেছিল। এই অপরাধের নেপথ্যে কে, সেই তদন্ত করতেই উঠে আসে অশোক মাহাতো গ্যাংয়ের নাম। সে গ্যাংয়ের কুখ্যাত দুষ্কৃতী পিন্টু মাহাতোর খোঁজ পান অমিত।
কিন্তু কিছুতেই পিন্টু মাহাতোর নাগাল পাচ্ছিলেন না অমিত। তিন মাস ধরে পিন্টুর গতিবিধির উপর নজর রাখা হচ্ছিল। এক সাক্ষাৎকারে অমিত বলেন, “অশোক এবং পিন্টু মাহাতোকে ধরার জন্য ওদের মতোই চিন্তা করতে হয়েছিল। নিজেকে অপরাধীর জায়গায় রেখেছিলাম। ওদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে, ওরা কী চিন্তা করছে, সব কিছু ওদের মতো করেই ভাবতে শুরু করি।”
অমিতের সঙ্গে কাজ করেছিলেন বিএসএফের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমান্ড্যান্ট রাঘবেন্দ্র মিশ্র। তিনি জানান, যেখানেই অপরাধ হত, অমিত সবার আগে সেখানে পৌঁছে যেতেন। শুধু সাধারণ মানুষের মধ্যেই নয়, তাঁর সহকর্মীদের মধ্যেও একটা শ্রদ্ধা অর্জন করতে পেরেছিলেন অমিত। মিশ্রের কথায়, “অমিত যেখানেই থাকুন না কেন, বাড়ি হোক বা অফিস, ফোনের উত্তর দিতেন। সাধারণ মানুষের কাছে সহজেই পৌঁছে যেতেন। আর এটাই তাঁকে সকলের নয়নের মণি করে তুলেছিল।”
একের পর এক অপরাধদমন, কুখ্যাত অপরাধীদের গ্রেফতার, বিহারে অমিত লোঢার নামেই তখন কাঁপত অপরাধীরা। ধীরে ধীরে দুষ্কৃতীদের ‘যম’ হয়ে উঠেছিলেন অমিত। বিহার পুলিশের প্রাক্তন ডিজি এস কে ভরদ্বাজ বলেন, “অমিতের সঙ্গে কারও তুলনা চলে না। এমন ডাকাবুকো অফিসার খুব কমই দেখা যায়। এমন সৎ, সত্যবাদী এবং জনসাধারণের প্রিয় অফিসার খুব কমই আছেন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy