‘রক্তচোষা বাদুড়’দের নিয়ে উদ্বিগ্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ তথা ধনকুবের শিল্পপতি ইলন মাস্ক। বড় কোনও বাস্তুঘুঘুর সন্ধান পেয়েছেন তিনি?
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৭:৫৯
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
আমেরিকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে রক্তচোষা বাদুড়ের দল! আর তাদের ঠেকাতে গিয়েই জলের মতো হচ্ছে খরচ! মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ ধনকুবের শিল্পপতি ইলন মাস্কের এ হেন মন্তব্যে আটলান্টিকের পাড়ে তুমুল হইচই। শুধু তা-ই নয়, তিনি বিরাট বড় দুর্নীতির হদিস পেয়েছেন বলেও যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে জল্পনা ছড়িয়ে পড়েছে। এ ব্যাপারে বড় পদক্ষেপ করতে পারে ট্রাম্প প্রশাসন।
০২১৮
চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি দ্বিতীয় বারের জন্য প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতা ডোনাল্ড। তাঁর ‘কিচেন ক্যাবিনেট’-এর সদস্যপদ পেয়েছেন এক্স হ্যান্ডেল, স্পেস এক্স এবং টেসলা কর্তা মাস্ক। সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা হিসাবে তাঁকে নিয়োগ করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। পাশাপাশি সরকারি খরচ কমাতে ধনকুবের শিল্পপতিকে কর্মদক্ষতা বিভাগের (ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি বা ডিওজিই) প্রধান করেছেন তিনি।
০৩১৮
দায়িত্ব পেয়েই কোমর বেঁধে কাজে লেগে পড়েন মাস্ক। সম্প্রতি সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত সরকারি তথ্যে নজর পড়তেই চোখ কপালে ওঠে তাঁর। সেখান থেকে তিনি জানতে পারেন, ১০০ থেকে ৩০০ বছর বয়সি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের একটি বিশাল অংশকে মাসে মাসে কোষাগার থেকে দেওয়া হচ্ছে মোটা টাকা! বলা বাহুল্য, তথ্য ঘেঁটে গোটা বিষয়টিতে গরমিলের গন্ধ পান মাস্ক। আর সঙ্গে সঙ্গেই একে বিরাট সমস্যা বলে উল্লেখ করে সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেছেন তিনি।
০৪১৮
নিজের এক্স হ্যান্ডেলে (সাবেক টুইটার) মাস্ক লিখেছেন, ‘‘সামাজিক নিরাপত্তার সুবিধা যাঁরা পাচ্ছেন, তাঁদের বয়স এবং মৃত্যুর তথ্যের ক্ষেত্রে প্রচুর গোঁজামিল রয়েছে। আর এ সব দেখে মনে হচ্ছে ‘টোয়াইলাইট’ বাস্তব। যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে বহু রক্তচোষা বাদুড়ই সামাজিক নিরাপত্তার সরকারি অর্থ গ্রহণ করছেন।’’
০৫১৮
২০০৫ সালে প্রকাশিত হয় মার্কিন সাহিত্যিক স্টিফেনি মেয়ারের কাল্পনিক প্রেমের উপন্যাসের সিরিজ় ‘টোয়াইলাইট’ বা গোধূলি। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র রয়েছে বেলা সোয়ান নামের এক তরুণী এবং তার ১০৪ বছর বয়সি প্রেমিক রক্তচোষা বাদুড় এডওয়ার্ড কালেন। ওয়াশিংটনে আমজনতার মধ্যেই দিব্যি ঘুরে বেড়ায় সে। পরবর্তী কালে এই সিরিজ়কে নিয়ে হলিউডে তৈরি হয় একাধিক চলচ্চিত্র। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই দারুণ জনপ্রিয়তা পায় রক্তচোষা বাদুড়ের এই উপন্যাস এবং ছায়াছবি।
০৬১৮
এ হেন রক্তচোষা বাদুড়ের কথা বলার পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তার সরকারি তথ্য সংক্রান্ত একটি নথির ছবিও প্রকাশ করাছেন মাস্ক। সেখানে দেখা গিয়েছে, সরকারি টাকা পাচ্ছেন শতবর্ষ পেরিয়ে যাওয়া অন্তত দু’কোটির বেশি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। এদের মধ্যে ১৩০ থেকে ১৩৯ বছর বয়সিদের সংখ্যা ৩৯ লক্ষ। এ ছাড়া ১৪০ থেকে ১৪৯ বছরের ৩৫ লক্ষ এবং ১৫০ থেকে ১৫৯ বছরের ১ লক্ষ ৩০ হাজার জন রয়েছেন। এমনকি ২০০ বছরের বেশি বয়সিরাও এই টাকা পাচ্ছেন বলে আমেরিকার সরকারি নথিতে উল্লেখ রয়েছে।
০৭১৮
২০২০ সালে জনগণনা করে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। মাস্কের যুক্তি, সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত নথির তথ্য তার সঙ্গে একেবারেই মিলছে না। কারণ রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যা ৩৩ কোটি ৫০ লক্ষ। এর মধ্যে শতায়ুর সংখ্যা মাত্র ৮০ হাজার। অর্থাৎ, মৃত ব্যক্তিদের নামেও দিব্যি সামাজিক নিরাপত্তা টাকা তোলা হচ্ছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন টেসলা কর্তা।
০৮১৮
যদিও মাস্কের দেওয়া তথ্যকে ‘অতিরঞ্জিত’ এবং সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পের ‘ভুল ব্যাখ্যা’ বলে দাবি করেছে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি)। সংবাদ সংস্থাটির প্রতিবেদনে অবশ্য, টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ত্রুটিবিচ্যুতি হওয়ার কথা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। সুনির্দিষ্ট একটি পরিসংখ্যান দিয়ে ব্যাপারটি বোঝানোর চেষ্টা করেছেন তাঁরা।
০৯১৮
এপি জানিয়েছে, গত বছরের জুলাইতে সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পের সরকারি খরচ সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন। সেখানে বলা হয়েছে, ২০১৫ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে এর গ্রাহকদের মধ্যে বিলি করা হয়েছে ৮.৬ লক্ষ কোটি ডলার। এর মধ্যে ১.৮ শত কোটি ডলার প্রশাসনিক গাফিলতিতে ভুল ভাবে দেওয়া হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ, ত্রুটির পরিমাণ এক শতাংশেরও কম। তবে কোনও মৃত ব্যক্তিকে টাকা দেওয়া হয়নি। কিছু গ্রাহক অতিরিক্ত টাকা পেয়েছেন বলে দাবি করেছে এপি।
১০১৮
সংবাদমাধ্যমের প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ভুল ভাবে বিলি করা ৩ কোটি ১০ লক্ষ ডলার ফের কোষাগারে ফেরাতে সক্ষম হয়েছে ষুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজ়ারি বিভাগ। এর জন্য একটি পাইলট প্রকল্প চালায় মার্কিন প্রশাসন। সামাজিক নিরাপত্তা প্রাপক মৃতদেহ তালিকার অস্থায়ী অ্যাক্সেস পান ট্রেজ়ারির কর্তাব্যক্তিরা। ১৮৯৯ সাল থেকে সেখানে ১৪ কোটি ২০ লক্ষ গ্রাহকের তথ্য সেখানে নথিবদ্ধ রয়েছে।
১১১৮
যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজ়ারি বিভাগের পদস্থ কর্তাদের আশা, ২০২৩ থেকে ২০২৬ সাল— এই তিন বছরের ক্ষেত্রে ২১৫ লক্ষ কোটি টাকা পুনরুদ্ধার করা যাবে। সংবাদ সংস্থা এপি জানিয়েছে, সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত তথ্য যে সফ্টঅয়্যারে সুরক্ষিত রয়েছে, সেটির ভাষা ‘কোবোল’ প্রোগ্রামিং থেকে এসেছে। ওই সফ্টঅয়্যার প্রোগ্রামিংটিতে তারিখের অভাব রয়েছে। ফলে তথ্যের বিচ্যুতি ঘটছে।
১২১৮
এর আগে সামাজিক নিরাপত্তার সরকারি তথ্য সংরক্ষণে ব্যবহৃত সফ্টঅয়্যার নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংবাদ সংস্থা ‘ওয়্যারড’। সেখানেও ‘কোবোল’ প্রোগ্রামিংয়ের একাধিক খামতির কথা বলা হয়েছিল। অভিযোগ, তার পরও এই সিস্টেমটিকে বাতিল করেনি যুক্তরাষ্ট্রের সরকার।
১৩১৮
মাস্কের ওই পোস্টের পর সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেন এই সরকারি দফতরের মহাপরিদর্শক। তাঁর কথায়, ‘‘২০২৩ সালের মার্চ থেকে গত বছরের জুলাই পর্যন্ত তথ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে মৃত গ্রাহকদের নাম-ঠিকানা নথিবদ্ধ করতে কোনও অতিরিক্ত সিস্টেম আনা হয়নি। ফলে ১৯২০ সাল বা তাঁর আগে জন্মগ্রহণকারীদের অনেকেরই নাম ওই তালিকায় থেকে গিয়েছে। তবে তার অর্থ এই নয় যে, মৃতদেরও সরকারি অর্থ দেওয়া হচ্ছে।’’
১৪১৮
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, সব জেনেও কেন তথ্যভান্ডার সংশোধন এবং সঠিক করতে উদ্যোগী হচ্ছে না মার্কিন প্রশাসন। খোলাখুলি ভাবে এর জবাব দিয়েছেন সামাজিক নিরাপত্তা বিভাগের মহাপরিদর্শক। তিনি জানিয়েছেন, তথ্যভান্ডার সংশোধন করতে চাই নতুন সফ্টঅয়্যার। এর জন্য খরচ হবে ৯০ লক্ষ ডলার। সেটা এই মুহূর্তে করতে রাজি নয় সরকার।
১৫১৮
মাস্ক অবশ্য এই সমস্ত যুক্তি হেলায় উড়িয়ে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এতে একাধিক রাঘব বোয়ালের নাম উঠে আসতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। সূত্রের খবর, এ ব্যাপারে বিস্তারিত রিপোর্ট খুব দ্রুত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের টেবলে পৌঁছে দেবেন টেসলা কর্তা।
১৬১৮
১৯৩৫ সালে আইন পাশ করে সামাজিক নিরাপত্তা প্রশাসন (সোশ্যাল সিকিউরিটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা এসএসএ) নামের একটি স্বশাসিত দফতর তৈরি করে ষুক্তরাষ্ট্রের সরকার। এর মাধ্যমে আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন অবসরপ্রাপ্ত এবং শারীরিক ভাবে অক্ষম মার্কিন নাগরিকেরা। এতে গ্রাহকদের আমৃত্যু সরকার থেকে টাকা দেওয়া হয়।
১৭১৮
বর্তমানে এসএসএর যাবতীয় কাজকর্ম পরিচালনা করে সামাজিক নিরাপত্তা বোর্ড (সোশ্যাল সিকিউরিটি বোর্ড)। এই দফতরের ফিল্ড অফিসারের সংখ্যা ১,২০০। এ ছাড়া এসএসএর রয়েছে নিজস্ব ওয়েবসাইট, ইমেল এবং টোল ফ্রি নম্বর।
১৮১৮
২০১৯ সালে কোভিড অতিমারি শুরু হলে সামাজিক নিরাপত্তা দফতর সাময়িক ভাবে বন্ধ করে দেয় যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। করোনা-পরবর্তী সময়ে দফতরটি ফের খোলে ২০২২ সালে ৭ এপ্রিল। ৯০ বছরের পুরনো সংস্থাটির ‘দুনীর্তি’র ঘুঘুর বাসা মাস্ক আদৌ ভাঙতে পারেন কি না, সেটাই এখন দেখার।