কুষাণ থেকে সুরি, মুঘল থেকে ব্রিটিশ, তামা থেকে সোনা, দেশে মুদ্রা ‘মুখ’ পাল্টেছে বার বার
যে ধাতুমুদ্রা এবং নোট নিয়ে এত কেনাবেচা, দেশের অর্থনীতি নির্ভর করে আছে যে কাগজের টুকরো বা ধাতু চাকতির উপর, তার ইতিহাস বহু পুরনো।
নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতাশেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২২ ১০:৪৫
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২৭
মুদ্রা নয়, প্রথম দিকে কড়িই ছিল ভারতীয় সভ্যতায় কেনাবেচার বিনিময় মাধ্যম। ১৯০০ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সময়কালে সিন্ধু সভ্যতায় খোদাই করা রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন ছিল। সুমেরীয় সভ্যতার সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার এই ধরনের মুদ্রার মাধ্যমেই বাণিজ্য চলত বলে মনে করা হয়।
০২২৭
বৈদিক যুগেও ‘নিষ্ক’ এবং ‘মনা’ নামের স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। বৈদিক সাহিত্য থেকে বোঝা যায়, ‘রুপি’ শব্দটি সংস্কৃত শব্দ ‘রুপ্যকম’ থেকে আসা। এই শব্দের প্রকৃত অর্থ 'রুপোর মুদ্রা'। বহু বার রূপান্তরণ, নামবদল, হাতবদল, বাতিল হওয়ার পর এখন টাকা ছাপার দায়িত্ব সামলাচ্ছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক।
০৩২৭
লিডিয়ান স্টেটার (পারস্য মুদ্রা) এবং চিনা মু্দ্রা আবির্ভাবের সমসময়ে প্রাচীন ভারতেও মু্দ্রার প্রচলন ছিল।
০৪২৭
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ষোড়শ মহাজনপদের সময়কালে বাণিজ্য বিস্তারের ফলে মুদ্রার প্রচলন বাড়ে। গান্ধার, পাঞ্চাল, কুরু, কুন্তল, শাক্য, সুরসেন এবং সৌরাষ্ট্র ইত্যাদি জনপদে ভিন্ন ভিন্ন মুদ্রার প্রচলন ছিল। তখন অবশ্য এই মুদ্রাগুলিকে ‘টাকা’ বলা হত না। ‘পুরাণ’ অথবা ‘কার্ষাপণ’ নামে পরিচিত ছিল এই প্রাচীন মুদ্রা।
০৫২৭
এই মুদ্রাগুলি ছিল রুপোর তৈরি। ওজন খুব বেশি না হলেও প্রতিটি জনপদের মুদ্রার আকার ছিল ভিন্ন। মহাজনপদ-ভেদে আকার এবং প্রতীকও বদলে যেত। সৌরাষ্ট্রের মুদ্রায় কুঁজযুক্ত ষাঁড়, দক্ষিণ পাঞ্চালের মু্দ্রায় স্বস্তিক প্রতীকের প্রচলন ছিল। কিন্তু মগধের ক্ষেত্রে কোনও নির্দিষ্ট প্রতীক নয়, এক এক সময় এক এক ধরনের প্রতীক ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানা যায়।
০৬২৭
মৌর্য বংশের প্রথম সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তাঁর রাজত্বকালে সোনা, রুপো, তামা এবং সিসার তৈরি খোদাই করা মুদ্রার প্রচলন করেন। পরবর্তী কালে ইন্দো-গ্রিক কুষাণ রাজাদের হাত ধরে বাজারে নতুন মুদ্রা আসে।
০৭২৭
গ্রিক ধারা অনুযায়ী, এই মুদ্রাগুলিতে বিভিন্ন প্রতিকৃতি খোদাই করার প্রচলন দেখা যেত। কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’-য় দেওয়া বিবরণ অনুসারে, রৌপ্যমুদ্রাগুলি ‘রৌপ্যরূপ’ নামে, স্বর্ণমুদ্রাগুলি ‘সুবর্ণরূপ’, তামার তৈরি মুদ্রা ‘তাম্ররূপ’ এবং সিসার তৈরি মুদ্রাগুলি ‘সিসারূপ’ নামে পরিচিত ছিল।
০৮২৭
দিল্লির তুর্কি সুলতানির সময় ফের বদল ঘটে মুদ্রার আকার-আয়তনে। দ্বাদশ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সুলতানরা মুদ্রার উপর ইসলামিক নকশা খোদাই করার নির্দেশ দেন।
০৯২৭
সেই সময় বাজারে সোনা, রুপো এবং তামার তৈরি বিভিন্ন মুদ্রার চল ছিল। সুলতান ইলতুৎমিসের আমলে ‘তঙ্কা’ (রৌপ্যমুদ্রা) এবং ‘জিতল’ (তামার তৈরি মুদ্রা) — এই দুই ধরনের মুদ্রার ব্যবহার শুরু হয়।
১০২৭
এমনকি, সেই সময় অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সুঠাম করতে বাজারে বিভিন্ন মূল্যের মুদ্রাও নিয়ে আসেন দিল্লির সুলতানরা। সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক স্বর্ণমুদ্রার পরিবর্তে তামার মুদ্রা প্রচলন করলেও, তা থেকে সমস্যা সৃষ্টি হয়। জাল মুদ্রায় বাজার ভরে যায়। মহম্মদ সেই সব মুদ্রাকে বাজার থেকে তুলে নিতে বাধ্য হন।
১১২৭
১৫২৬ খ্রিস্টাব্দের পর মুঘল সম্রাটরা বিভিন্ন মুদ্রাব্যবস্থাকে এক জায়গায় এনে কেন্দ্রীয় রূপ দান করেন।
১২২৭
শের শাহ সুরির সঙ্গে যুদ্ধে মুঘল সম্রাট হুমায়ুন পরাজিত হলে শের শাহ একটি রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন শুরু করেন। ১৭৮ গ্রাম ওজনের এই মুদ্রা ‘রুপিয়া’ নামে পরিচিত ছিল। রুপোর তৈরি এই মুদ্রাই পরবর্তী মুঘল বংশ থেকে শুরু করে মরাঠা শাসন, এমনকি ব্রিটিশদের আগমনের পরেও কিছু সময় ব্যবহৃত হয়েছে।
১৩২৭
১৬০০ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশদের আগমনের সময় এই ‘রুপিয়া’রই বহুল প্রচলন ছিল। বহু চেষ্টার পর পরাধীন ভারতে স্টারলিং পাউন্ড মুদ্রার ব্যবহার শুরু হলেও ‘রুপিয়া’র ব্যবহার ভারতের গণ্ডি ছাড়িয়ে ব্রিটেনের বিভিন্ন জায়গাতেও ছড়িয়ে পড়ে।
১৪২৭
অষ্টাদশ শতকে ভারতের বুকে ‘ব্যাঙ্ক অফ হিন্দোস্তান' এবং 'জেনেরাল ব্যাঙ্ক ইন বেঙ্গল’ এবং ‘বেঙ্গল ব্যাঙ্ক’ নামে দু’টি ব্যাঙ্ক ‘পেপার কারেন্সি’ বা কাগজের তৈরি মুদ্রা ছাপাতে শুরু করে।
১৫২৭
এই সময়েই ব্রিটিশাধীন ভারতে প্রথম কাগজের তৈরি টাকা ব্যবহারের চল শুরু হয়। ১৮৫৭ সালে বিদ্রোহের পর ব্রিটিশরা ‘রুপি’কেই প্রধান মুদ্রা হিসাবে চালু করেন। এই কাগজি মুদ্রাগুলিতে সেই সময় রানি ভিক্টোরিয়ার প্রতিকৃতি ব্যবহার করা হত।
১৬২৭
ঊনবিংশ শতকে ব্রিটিশরা বিভিন্ন উপমহাদেশেও এই কাগজি মুদ্রা চালু করে। ‘দ্য পেপার কারেন্সি অ্যাক্ট অফ ১৮৬১’ আইন অনুযায়ী, ব্রিটিশ ভারতবর্ষে নোট সরবরাহের দায়িত্বভার ব্রিটিশ সরকারের উপর আসে।
১৭২৭
এই দায়িত্বভার সামলাতে মিন্ট মাস্টার, অ্যাকাউন্টট্যান্ট এবং কন্ট্রোলার অফ কারেন্সি নামের বিভিন্ন পদও তৈরি করা হয়। ১৯২৩ সালে রাজা পঞ্চম জর্জের ছবি দিয়ে আবার নতুন নোট ছাপা হয়। সেই সময় এক টাকা, আড়াই টাকা, পাঁচ টাকা, ১০ টাকা, ৫০ টাকা, ১০০ টাকা, ১০০০ টাকা এবং ১০০০০ টাকা মূল্যের নোট ছাপা হয়।
১৮২৭
১৯৩৫ সালের ১ এপ্রিল, সোমবার ‘আরবিআই অ্যাক্ট, ১৯৩৪’-এর ২২ নং ধারা অনুযায়ী, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার যাত্রা শুরু হয়। এর প্রধান দফতর কলকাতাতে তৈরি করা হয়। ১৯৩৮ সালে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তরফে সর্বপ্রথম পাঁচ টাকার নোট ছাপা হয়। এই নোটে ষষ্ঠ জর্জের ছবি ব্যবহার করা হয়।
১৯২৭
ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ১০ টাকার নোট, মার্চ মাসে ১০০ টাকা এবং জুন মাসে ১০ হাজার টাকার নোট ছাপা হয়। এই নোটগুলিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দ্বিতীয় গভর্নর স্যর জেমস টেলরের সই ব্যবহার করা হয়।
২০২৭
স্বাধীনতার পর এই নোটগুলি বাতিল করে দেওয়া হয়। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তরফে নতুন করে ছাপা হয় এক টাকার কয়েন। ১৯৫০ সালের ১৫ অগস্ট ‘আনা সিরিজ’ও চালু করা হয়।
২১২৭
এই ঘটনার সাত বছর পর ১৯৫৭ সালে ‘আনা সিরিজ’-এর পরিবর্তে ‘ডেসিমাল সিরিজ’ চালু হয়। ১৬ আনার বদলে ১০০ পয়সা মূল্যের মুদ্রাকে এক টাকার সমতুল্য হিসাবে নির্ধারিত করা হয়।
২২২৭
এক নয়া পয়সা মূল্যের মুদ্রা গোলাকৃতির, দু’নয়া এবং ১০ নয়া পয়সা মূল্যের মুদ্রাগুলি কোণের দিকে খাঁজকাটা, পাঁচ নয়া পয়সা মূল্যের মুদ্রা বর্গাকার আকৃতির বানানো হত, যাতে আকার দেখে চিনতে সুবিধা হয়।
২৩২৭
১৯৫৯ সালে ১০ টাকা এবং হাজার টাকার আলাদা নোট ছাপা হয়, যাতে ভারত থেকে সৌদি আরবে হজযাত্রার সময় পুণ্যার্থীরা কোনও অসুবিধার সম্মুখীন না হন।
২৪২৭
১৯৮০ সালে দু’টাকার নোটে আর্যভট্টের ছবি, এক টাকার নোটে তেল রিগের ছবি, ১০ টাকার নোটে ময়ূর, ২০ টাকার নোটে কোনার্কের চক্র এবং পাঁচ টাকার নোটে চাষের জমির ছবি ব্যবহার করা হয়।
২৫২৭
১৯৯৬ সালে ‘মহাত্মা গান্ধী সিরিজ’-এর নোট বাজারে চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ১০ টাকা এবং ৫০০ টাকা নোট নতুন করে ছাপা হয়।
২৬২৭
২০১১ সালে ৫০ পয়সা, এক টাকা, দু’টাকা, পাঁচ টাকা এবং দশ টাকার নতুন মুদ্রা বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গে ২৫ পয়সা এবং তার চেয়ে কম মূল্যের মুদ্রার ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এমনকি, নতুন ‘রুপি’ প্রতীকেরও প্রচলন হয়।
২৭২৭
২০১৬ সালে আবার ভারতীয় মুদ্রাব্যবস্থায় পরিবর্তন আসে। ৫০০ টাকা এবং ১০০০ টাকার নোট বাতিল হয়। তার পরিবর্তে বাজারে ৫০০ টাকার নতুন নোট আসে। ২০০ টাকা এবং ২০০০ টাকার নতুন নোট মুদ্রার বাজারে চালু হয়।