ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবসায় ‘কুবের’, আবার এর জন্যই ‘কয়েদি’ও, কী রহস্য লুকিয়ে আছে এই ডিজিটাল মুদ্রায়!
ক্রিপ্টোকারেন্সি হল এক ধরনের ডিজিটাল মুদ্রা। যা সীমানার বেড়া মানে না। যে কোনও দেশেই এই মুদ্রার বিনিময়ে কেনাবেচা হতে পারে। কিন্তু এই অর্থের উৎস কী? কেনই বা এই মুদ্রার ব্যবসায় লাভের অঙ্ক বেশি?
নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতাশেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২২ ১০:০৯
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২২
অঙ্কে মেধাবী, ধারালো বুদ্ধির এক তরুণ শেয়ার ব্যবসায়ী পুরনো ব্যবসা ছেড়ে এসেছিলেন ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবসায়। ২০১৯ সালে সেই ব্যবসা শুরুর দু’বছরের মধ্যেই তাঁর নাম ওঠে ধনকুবের তালিকায়।
০২২২
আবার পরের বছরই একের পর এক অঘটন। ফল— ২০২২ সালের ডিসেম্বরে পুলিশের হাতে বন্দি সেই ব্যবসায়ী। আর্থিক দুর্নীতির অপরাধে তাঁকে জেলে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত আমেরিকার প্রশাসন।
০৩২২
নাম স্যাম ব্যাঙ্কম্যান-ফ্রায়েড। ক্রিপ্টোকারেন্সি এক্সচেঞ্জ এফটিএক্সের প্রতিষ্ঠাতা স্যাম। ক্রিপ্টো দুনিয়ায় তাঁর প্রতিষ্ঠানের বেশ নাম ডাক। যা অধুনা হারিয়েছে।
০৪২২
এই প্রতিষ্ঠানের দৌলতেই ২০২১-এ ফোর্বসের ধনকুবের তালিকায় নাম উঠেছিল স্যামের। আবার এই প্রতিষ্ঠানই জন্মের তিন বছরের মধ্যে ২০২২ সালের নভেম্বরে নিজেকে দেউলিয়া বলে ঘোষণা করেন।
০৫২২
প্রশ্ন হল, তিন বছরে কী এমন হল? কী আছে এই ক্রিপ্টোমুদ্রায় যা মুদ্রা-মাদারির খেলায় এমন সহসা বদল আনতে পারে? এক বছরে পাকা মাথার ধনকুবেরকেও ধরাশায়ী করতে পারে? যিনি ব্যবসার হিসাবেও দুরস্ত।
০৬২২
এ ব্যাপারে আমেরিকার প্রশাসনকে প্রশ্ন করা হলে তারা জানিয়েছে, স্যাম এমন কিছু আর্থিক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িয়েছেন করেছেন, যা আমেরিকায় বেআইনি।
০৭২২
অদ্ভুত ভাবে একা স্যাম নয়। আমেরিকার বিচার বিভাগের কৌঁসুলিরা বলছেন, স্যামের মতো ক্রিপ্টো ব্যবসার বহু নামজাদা হর্তাকর্তাই এখন প্রশাসনের নজরে। প্রত্যেকেই নাকি ক্রিপ্টোকারেন্সির দুনিয়ার নামজাদা বাজিগর। প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই জালিয়াতির অভিযোগ। যদিও এঁরা ঠিক কী ধরনের জালিয়াতি করেছেন তা স্পষ্ট করে জানায়নি প্রশাসন।
০৮২২
ক্রিপ্টোকারেন্সি শব্দটির মধ্যেই রয়েছে রহস্য। কারণ ক্রিপ্টো শব্দটির অর্থই হল গোপন বা গুপ্ত। যা আড়ালে থাকে। যাকে প্রকাশ্যে আনা যায় না।
০৯২২
আবার ক্রিপ্টোকারেন্সি শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে আছে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়— ক্রিপ্টোগ্রাফি। দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যে তথ্য আদানপ্রদানকে সঙ্কেতের মাধ্যমে গোপন এবং সুরক্ষিত রাখাই ক্রিপ্টোগ্রাফির লক্ষ্য।
১০২২
অঙ্কের একটি শাখা হল এই ক্রিপ্টোগ্রাফি। যা নিয়ে চর্চা প্রায় তিন থেকে চার হাজার বছর ধরে। তবে কম্পিউটার আসার পর এই চর্চা বেড়েছে বহুগুণ। ক্রিপ্টোমুদ্রার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ক্রিপ্টোগ্রাফিই ডিজিটালমুদ্রাকে অনলাইন লেনদেনের কুনজর বাঁচিয়ে সুরক্ষিত রাখে।
১১২২
তা হলে ক্রিপ্টোকারেন্সি বিষয়টি আসলে কী? কম্পিউটার বিজ্ঞানের বিশেষ শাখা ক্রিপ্টোলজি ব্যবহার করে যে বৈদ্যুতিন মুদ্রা তৈরি হয়, তারই নাম ক্রিপ্টোকারেন্সি। এই মুদ্রা হাতে ছোঁয়ার উপায় নেই, এর অস্তিত্ব শুধুমাত্র ভার্চুয়াল জগতে।
১২২২
‘ব্লকচেন’ নামে এক প্রযুক্তির সাহায্যে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা কম্পিউটারে নিয়ন্ত্রণ করে এই ভার্চুয়াল মুদ্রা। ব্লকচেন হল তথ্য মজুত রাখার সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। যা কেউ নষ্ট করতে পারবে না। যা কেউ হ্যাক করতেও পারবে না।
১৩২২
১৯৮৩ সালে প্রথম ক্রিপ্টোগ্রাফার ডেভিড চোম ডিজিটাল মুদ্রার লেনদেন নিয়ে কাজ শুরু করেন। তার পরে ১৯৯৫ সালে সেই চেষ্টা বাস্তব রূপ পায়। পরে ২০০৯ সালে সাতোশি নাকামোতো নামে এক ব্যক্তি বিশ্বের প্রথম ক্রিপ্টোকারেন্সি মুদ্রা বিটকয়েন চালু করেন।
১৪২২
বর্তমানে প্রায় ৪ হাজারের বেশি ক্রিপ্টোকারেন্সি রয়েছে। তার মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় ক্রিপ্টোকারেন্সি হল বিটকয়েন। এ ছাড়া এথেরিয়াম, টেথার, বিন্যান্স কয়েন, ইউএসডি কয়েন, ডজ কয়েন, কার্ডানো নামেরও মুদ্রা রয়েছে।
১৫২২
উন্নত প্রযুক্তির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রিপ্টোকারেন্সি ‘মাইনিং’ করা যেতে পারে। তবে তার জন্য দরকার কোডিংয়ে মারাত্মক দখল। সাধারণ লোকের পক্ষে সেটা কঠিন। তা ছাড়া তার জন্য যে পুঁজি দরকার, তা-ও সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।
১৬২২
ছাপোষা মানুষের ক্রিপ্টোমুদ্রা নিয়ে স্বপ্ন দেখতে হলে প্রচলিত ধারা মেনে বিনিয়োগ করা ছাড়া অন্য উপায় নেই। অর্থাৎ টাকা-ডলার-পাউন্ড ভাঙিয়ে ক্রিপ্টোকারেন্সি কিনে আশা রাখতে হবে যে এর মূল্য দিন দিন বাড়বে। নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ক্রিপ্টোকারেন্সি এক্সচেঞ্জ থেকে কেনা যায় এই মুদ্রা। পিয়ার-টু-পিয়ার ডাইরেক্টরি ব্যবহার করেও কেনা যায়।
১৭২২
বাজারে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্যই বিটকয়েন বানানো হয়েছে এমন ভাবে যে, যত বেশি কম্পিউটার এক সঙ্গে গাণিতিক সমস্যার সমাধানের চেষ্টা চালাবে, ততই কঠিন হয়ে উঠবে সে সমাধান খুঁজে বার করা। পুঁজিপতিরা যাতে অনায়াসে বিটকয়েনের বাজার নিজেদের হাতে না নিয়ে নিতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করার জন্যই এই ব্যবস্থা।
১৮২২
কিন্তু ক্রিপ্টোমুদ্রার কিছু অসুবিধাও আছে। যতই হোক ক্রিপ্টোকারেন্সি একটি অতীব সুরক্ষিত কম্পিউটার ফাইলমাত্র। যদি দুর্ভাগ্যক্রমে হারিয়ে যায় ফাইল, বা কম্পিউটার ফাইলের পাসওয়ার্ড যদি অন্য কারও জানা না থাকে, তা হলে সেই ফাইলও আর কোনও দিন কেউ ব্যবহার করতে পারবে না।
১৯২২
বস্তুত অর্থের লেনদেনে নজরদারি চালিয়ে যাতে সাধারণ মানুষের জীবন যাপনের তথ্য সরকারের হাতে পৌঁছে না যায় সে জন্যই ক্রিপ্টোকরেন্সির ভাবনা শুরু। সরকারের নজর এড়িয়ে আর্থিক লেনদেনের জন্যই সমমনস্ক বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়র, হ্যাকার মিলে নতুন নতুন ‘আইডিয়া’ নিয়ে আলোচনা চালাতে থাকেন। সেখান থেকেই ক্রিপ্টোমুদ্রার উদ্ভব।
২০২২
তা হলে কি সরকার এই ক্রিপ্টোমুদ্রার ব্যবহার চাইলে বন্ধ করে দিতে পারে? স্যাম-সহ ক্রিপ্টো মুদ্রার বাজিগরদের উপর তাই কি নজরদারি চালাচ্ছে?
২১২২
এই প্রশ্নের জবাব স্পষ্ট নয়। তবে ক্রিপ্টোকারেন্সি পুরোপুরি স্বনির্ভরও নয়। কারণ ডলার, পাউন্ড বা ভারতীয় টাকা খরচ করে বিটকয়েন কেনা যায়। সুতরাং, দেশি বা বিদেশি সরকার যদি বিটকয়েন বেচাকেনার ওপর আইন চাপায়, তার প্রভাব বিটকয়েনের বাজারে পড়বেই।
২২২২
তবে ক্রিপ্টোকারেন্সির রহস্য যা-ই হোক তা এখনও ভারতে অনুমোদিত নয়। ২০১৮ সালে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক দেশের সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন নিষিদ্ধ করে। কারণ জানিয়ে তখন কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক জানিয়েছিল, ক্রিপ্টোকারেন্সি দেশে ঢুকলে তা ক্ষতি করবে অর্থনীতির। যদিও কী ক্ষতি তার রহস্য উন্মোচন করেনি আরবিআইও।