China Great Sparrow Campaign world deadliest environmental disaster resulted 75 million human deaths dgtl
Great Sparrow Campaign
চড়ুই নিধন যজ্ঞ, মারা পড়ে কোটি কোটি পাখি! প্রেসিডেন্টের এক সিদ্ধান্তে দুর্ভিক্ষ নামে চিনে
কৃষি বিপ্লব এবং আর্থিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে চড়ুই নিধনের নির্দেশ দেন চিনের চেয়ারম্যান মাও। লাখ লাখ চড়ুই মারা যেতেই দেশ জুড়ে শুরু হয় দুর্ভিক্ষ। প্রাণ হারান কয়েক কোটি মানুষ।
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতাশেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০২৪ ১৪:৪৬
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে একটা নির্দেশ। হুকুম তামিলের পর সবাই যখন হাঁফ ছেড়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন, তখনই প্রতিশোধ নিল প্রকৃতি। যার খেসারত দিতে প্রাণ যায় সাড়ে সাত কোটি মানুষের। সাড়ে ছ’দশক পরও যার দগদগে ঘা বয়ে বেড়াচ্ছে ভারতের উত্তর-পূর্বের প্রতিবেশী চিন।
০২২০
ড্রাগন-ভূমির সেই মৃত্যুমিছিলের নেপথ্যে ছিল দেশটির প্রথম চেয়ারম্যান মাও জে দংয়ের একটা সিদ্ধান্ত। চিনকে চড়ুই-শূন্য করতে চেয়েছিলেন তিনি। ফলস্বরূপ সেখানে শুরু হয় ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ। না খেতে পেয়ে প্রাণ হারান কোটি কোটি মানুষ।
০৩২০
সালটা ছিল ১৯৫৮। চিনের কমিউনিস্ট শাসন তত দিনে ন’বছর পেরিয়ে গিয়েছে। ওই সময়ে দেশবাসীকে ‘সামনের দিকে লম্বা লাফ’ দেওয়ার আহ্বান জানালেন চেয়ারম্যান মাও। ইতিহাসে যা ‘গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড’ নামে পরিচিত।
০৪২০
চিনকে শিল্পোন্নত দেশে পরিণত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন চেয়ারম্যান মাও। সেই মতো একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ করেন তিনি। চড়ুই নিধন ছিল তারই অংশ। বেজিং তখন দারিদ্রের সঙ্গে কোমর বেঁধে লড়াইয়ে নেমেছে। ওই সময় ব্যক্তিগত মালিকানাধীন খামার বন্ধ করার নির্দেশ দেন মাও। পাশাপাশি, জোর দেওয়া হয় যৌথ এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কৃষিকাজের দিকে।
০৫২০
কৃষির উন্নতি করতে গিয়ে হঠাৎই এক দিন চা়ঞ্চল্যকর রিপোর্ট হাতে পান চিনের চেয়ারম্যান। তাতে লেখা ছিল মাছি, মশা, ইঁদুর আর চড়ুই আমজনতার স্বাস্থ্য এবং ফসল উৎপাদনে বাদ সাধছে। মূলত, চড়ুই এবং ইঁদুরের জন্য প্রত্যেক বছর নষ্ট হচ্ছে লক্ষ লক্ষ টন খাদ্যশস্য।
০৬২০
রিপোর্ট দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলে চেয়ারম্যান মাও। আগুপিছু চিন্তা না করে এগুলিকে নির্মূল করার নির্দেশ দেন তিনি। সরকারি তরফে এই নিয়ে ব্যাপক প্রচারের সিদ্ধান্ত নেয় বেজিং। আর সেই আন্দোলনের সুরটি বেঁধে দেন স্বয়ং মাও। বললেন, ‘রেন ডিং সেং তিয়ান’। অর্থাৎ মানুষকে প্রকৃতি জয় করতে হবে।
০৭২০
মাও ভেবেছিলেন, মশা, মাছি এবং ইঁদুর মারলে রোগভোগ কমবে। নির্মূল হবে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি, প্লেগের মতো রোগ। আর চড়ুই নিধনে রক্ষা করা যাবে বিপুল পরিমাণ শস্য। যা বিদেশের বাজারে বিক্রি করে মোটা টাকা ঘরে তুলবে চিন। কারণ, আর্থিক দিক থেকে আমেরিকাকে পিছনে ফেলার স্বপ্নে তখন বিভোর ছিলেন এই কমিউনিস্ট নেতা।
০৮২০
মাওকে পাঠানো রিপোর্টে বলা হয়েছিল, একটা চড়ুই বছরে চার থেকে পাঁচ কেজি শস্য খেয়ে ফেলে। চিনের চেয়ারম্যান হিসাব কষে দেখলেন, দেশে চড়ুইয়ের সংখ্যা ১০ লক্ষ হলে তারা প্রতি বছর সাবাড় করছে ৬০ হাজার চিনার খাবার। যাকে ঘোর অপরাধ বলেই মনে করছিলেন তিনি।
০৯২০
কৃষি বিপ্লব এবং আর্থিক সমৃদ্ধির নেশায় ১৯৫৮ সালে দেশ জুড়ে ‘চড়ুই হত্যা’ অভিযান শুরু করেন মাও। পরবর্তীকালে ইতিহাসবিদেরা এর নামকরণ করেন, ‘দ্য গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেন’। সরকারি তরফে চড়ুই নিধনে তখন বিশেষ পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল।
১০২০
মাওয়ের নির্দেশে সমগ্র দেশবাসী চড়ুই হত্যায় মেতে উঠেছিল। ওই সময়ে চিনারা চড়ুইয়ের বাসা দেখলেই তা ভেঙে দিতেন। নষ্ট করতেন ডিম। এ ছাড়া চড়ুই নিধনের জন্য প্রচণ্ড জোরে হাঁড়ি বা ড্রাম বাজানো হত। প্রবল আওয়াজে ভয় পেয়ে একটা সময়ে ছোট্ট পাখিগুলি মাটিতে লুটিয়ে পড়ত। গুলি করে এবং বিষ দিয়েও বহু পাখি হত্যা করেছিলেন তাঁরা।
১১২০
চড়ুই নিধন যজ্ঞে যোগ দিয়েছিলেন চিনের স্কুল-কলেজের পড়ুয়া থেকে শুরু করে সরকারি কর্মীরাও। নিধনযজ্ঞে কারখানার শ্রমিকদেরও দেখা গিয়েছিল। দ্রুত চড়ুইয়ের বংশ কী ভাবে লোপ করা যায় তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা চালিয়েছিল তৎকালীন মাও সরকার।
১২২০
চেয়ারম্যান মাওয়ের এই চড়ুই নিধন নিয়ে ২০১০ সালে প্রকাশিত হয় ‘মাও’স গ্রেট ফেমিম’। যার লেখক ছিলেন ফ্রাঙ্ক ডিকোটার। তাঁর দাবি, এক বছরের মধ্যে ১০০ কোটি চড়ুইয়ের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল চিন। যদিও সংখ্যাটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় বলে বইতে উল্লেখ করেন তিনি।
১৩২০
এই চড়ুই নিধনের পরই প্রকৃতির রোষে পড়ে চিন। কারণ, ছোট্ট এই পাখিটা শুধু যে শস্য খেয়ে নিত, তা নয়। ফসলের উপরে থাকা নানা ধরনের পোকামাকড় ছিল এদের খাদ্য। চড়ুই না থাকায় শুরু হয় সেই পোকামাকড়ের বাড়বাড়ন্ত।
১৪২০
ডিকোটার জানিয়েছেন, ১৯৬০ সালে পরিস্থিতি হাতে বাইরে চলে যায়। কাকতালীয় ভাবে এই বছর খরার কবলে পড়েছিল চিন। তার উপর ছিল পঙ্গপালের আক্রমণ। যার ঝাঁকে ঝাঁকে এসে মাঠের পর মাঠ ফসল নষ্ট করে দিয়েছিল। বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহার করেও সেগুলিকে মারা সম্ভব হয়নি।
১৫২০
বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে ওই সময়ে চিনের কৃষি জমি বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল। ফলে ফসলের উৎপাদন হঠাৎ করে অনেকটা কমে যায়। যা ওই দুর্ভিক্ষকে ডেকে এনেছিল।
১৬২০
চিনের এই দুর্ভিক্ষ নিয়ে একাধিক বই রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হল ড্রাগন ভূমির সাংবাদিক ইয়াং জিশেংয়ের লেখা ‘টম্বস্টোন: দ্য গ্রেট চায়না ফেমিন’। সেখানে তিনি বলেছেন, পেটের জ্বালায় মাটি খেয়ে দিন কাটিয়েছে বহু চিনা পরিবার।
১৭২০
ওই দুর্ভিক্ষে মৃতের সংখ্যা নিয়ে অবশ্য মতপার্থক্য রয়েছে। বেজিংয়ের দাবি, দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারিয়েছিলেন দেড় কোটি মানুষ। এঁদের প্রত্যেকে না খেতে পেয়ে মারা গিয়েছিলেন, এমনটা নয়। বরং খাবারের জন্য অনেকেই একে অপরকে খুন করেছিলেন বলে উল্লেখ রয়েছে চিনের সরকারি তথ্যে।
১৮২০
প্রথম দিকে অবশ্য চড়ুই নিধনের ফলেই দুর্ভিক্ষ নেমেছে, তা মানতে রাজি ছিলেন না চেয়ারম্যান মাও। পরবর্তীকালে বিষয়টি বুঝতে পারেন তিনি। তখন অবশ্য অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছিল। ১৯৬২ সালে শেষ হয় চিনের ওই দুর্ভিক্ষ।
১৯২০
গত বছর (২০২৩) গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেনের উপর দু’টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়েছে, দুর্ভিক্ষে যাঁরা বেঁচে গিয়েছিলেন, তাঁদের স্বাস্থ্যের উপরেও মারাত্মক প্রভাব পড়েছিল।
২০২০
ওই দুই গবেষণাপত্র অনুযায়ী, চিনে উচ্চ রক্তচাপ, ডিসলিপিডেমিয়া, ডায়াবেটিস, ক্যানসার, ফুসফুস-লিভার-কিডনির রোগ, হৃদরোগ, স্মৃতি-সম্পর্কিত রোগ, আর্থ্রাইটিস এবং হাঁপানির সমস্যা বাড়ছে। এর নেপথ্যে চড়ুই নিধন এবং দুর্ভিক্ষ মূল কারণ বলে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে।