China conducted naval exercise near Australia and New Zealand to challenge US in Indo Pacific Region dgtl
China vs US in Indo Pacific
ছোট্ট দ্বীপের সঙ্গে বড় চুক্তি করে অসি-কিউয়িদের চিনা চমকানি! প্রশান্ত মহাসাগরে আমেরিকাকে ঘিরছে ড্রাগন?
কুক দ্বীপপুঞ্জকে কেন্দ্র করে চিনের সঙ্গে বিরোধ বাড়ছে নিউ জ়িল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার। তবে ড্রাগনের মূল লক্ষ্য আমেরিকা, বলছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০২৫ ১৪:৫৮
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২২
তাইওয়ানের পর অস্ট্রেলিয়া-নিউ জ়িল্যান্ড। ড্রাগনের ‘দাদাগিরি’তে অতিষ্ঠ দক্ষিণ গোলার্ধের দুই প্রতিবেশী দেশ। মহড়ার নামে একেবারে তাদের ঘাড়ের কাছে এসে ‘চোখ রাঙাচ্ছে’ চিনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএর নৌসেনা। শুধু তা-ই নয়, এ ভাবেই নিউ জ়িল্যান্ডের থেকে কুক দ্বীপপুঞ্জকে ছিনিয়ে নেওয়ার ছক কষছে বেজিং, বলছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
০২২২
দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের কুক দ্বীপপুঞ্জ একটি স্বশাসিত রাষ্ট্র। কিন্তু দেশটির সঙ্গে সাংবিধানিক সম্পর্ক রয়েছে নিউ জ়িল্যান্ডের। ‘কিউয়ি’ দেশ থেকে কুক দ্বীপপুঞ্জের দূরত্বে আনুমানিক ৩ হাজার ২৩২ কিলোমিটার। এ-হেন দ্বীপরাষ্ট্রটি হঠাৎ করে চিনের সঙ্গে সামরিক এবং আর্থিক চুক্তি করায় বেজায় চটেছে ওয়েলিংটন। যদিও তাতে আমল দিতে নারাজ বেজিং।
০৩২২
চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি তিন দিনের চিন সফর শেষ করে দেশে ফেরেন নিউ জ়িল্যান্ডের উপপ্রধানমন্ত্রী উইনস্টন পিটার্স। ওয়েলিংটনে ফিরেই তিনি জানতে পারেন কুক দ্বীপপুঞ্জ এবং ড্রাগনের মধ্যে সম্পাদিত হয়েছে একাধিক নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক চুক্তি। সেই নথিতে সই করার আগে কুকের সরকারি প্রশাসনের তরফে নিউ জ়িল্যান্ড সরকারকে কিছু জানানো হয়নি।
০৪২২
বিষয়টি জানতে পেরে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন পিটার্স। প্রসঙ্গত, তাঁর চিন সফরকালে কুকের প্রধানমন্ত্রী মার্ক ব্রাউনের বিরুদ্ধে আনা হয় অনাস্থা প্রস্তাব। কিন্তু সেখানে তিনি জয়ী হন। কুর্সিতে টিকে যাওয়ায় বেজিংয়ের সঙ্গে চুক্তি করতে ব্রাউনের কোনও সমস্যা হয়নি। একে কাকতালীয় বলে উল্লেখ করেছে ড্রাগন।
০৫২২
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, কুকের পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাবের ভোটাভুটি হয় গত ২৬ ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ পিটার্সের চিনের সফর শেষ করার ঠিক এক দিন আগে কুর্সি বাঁচাতে সক্ষম হন ব্রাউন। আর তাই একে কাকতালীয় বলে মানতে নারাজ নিউ জ়িল্যান্ড। কিউয়িদের অনুমান, পর্দার আড়ালে থেকে এ ব্যাপারে কলকাঠি নেড়েছে চিন, যা পিঠে ছোরা গেঁথে দেওয়ার শামিল।
০৬২২
এ বছরের ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ করেই অস্ট্রেলিয়া এবং নিউ জ়িল্যান্ডের জলসীমায় (পড়ুন তাসমান সাগর) ঢুকে পড়ে বেশ কয়েকটি চিনা যুদ্ধজাহাজ। সেখানে লম্বা সময় ধরে মহড়া চালায় তারা। যুদ্ধাভ্যাসের সময়ে রণতরীগুলি থেকে ছোড়া হয় বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র। এর কারণ অনুসন্ধানে নেমে কুক দ্বীপপুঞ্জ এবং ড্রাগনের নিরাপত্তা চুক্তির কথা জানতে পারে কিউয়িরা।
০৭২২
সংশ্লিষ্ট মহড়ায় মোট তিনটি রণতরী ব্যবহার করেন লালফৌজের নৌসৈনিকরা। এর মধ্যে একটি ছিল তেলবাহী জাহাজ। বাকি দু’টি হল জিয়াংকাই ক্লাসের ফ্রিগেট এবেং রেনহাই ক্লাসের ‘জুনাই’ নামের ক্রুজ়ার। অভিযোগ, মহড়ার সময়ে যুদ্ধজাহাজগুলি থেকে লাগাতার ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে পিএলএ নৌসেনা। এতে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
০৮২২
অস্ট্রেলীয় প্রতিরক্ষা দফতর সূত্রে খবর, চিনা রণতরী থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র তাদের ‘এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জ়োন’-এ আছড়ে পড়ে। ফলে বহু বাণিজ্যিক বিমানের যাত্রাপথ বদল করতে বাধ্য হয় ‘ক্যাঙারু প্রশাসন’। নিজেদের সামুদ্রিক পরিধির বাইরে এ ভাবে বেজিংয়ের শক্তি প্রদর্শনের কড়া সমালোচনা করেছে অসি সরকার।
০৯২২
অস্ট্রেলিয়ার পাশাপাশি একই রকমের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে নিউ জ়িল্যান্ড সরকার। বিষয়টি নিয়ে দ্য ইউরেশিয়ান টাইমসের কাছে মুখ খোলেন কিউয়ি প্রতিরক্ষামন্ত্রী জুডিথ কলিন্স। তাঁর কথায়, ‘‘মহড়ার নামে চিনা নৌসেনা যা করেছে, সেটা অপ্রত্যাশিত। কোনও আগাম সতর্কতা ছাড়াই অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে শুরু করে তারা। এর মধ্যে জাহাজ বিধ্বংসী ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রও ছিল।’’
১০২২
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, এই ধরনের মহড়ার ক্ষেত্রে ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা আগে নিকটবর্তী দেশগুলিকে নোটিস দিতে হয়। অসি ও কিউয়ি প্রশাসনের অভিযোগ, চিন সে সবের ধার ধারেনি। কয়েক ঘণ্টার নোটিসেই যুদ্ধাভ্যাস শুরু করে দেয় পিএলএ নৌসেনা। আর তাই অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনি অ্যালবানিজ় বেজিঙের এই কীর্তিকলাপকে ‘বিপজ্জনক’ বলে উল্লেখ করেছেন।
১১২২
দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের কুক দ্বীপপুঞ্জ স্বশাসিত এলাকা হলেও নিউ জ়িল্যান্ডের সঙ্গে এর নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। সেখানকার বাসিন্দাদের ‘নাগরিক’ তকমা দিয়ে রেখেছে কিউয়িরা। আর তাই কুকবাসীরা অবাধে নিউ জ়িল্যান্ডে আসা-যাওয়া করতে পারেন। কিউয়ি পাসপোর্ট বা ডলার ব্যবহারের ক্ষেত্রেও কোনও বাধা নেই।
১২২২
নিউ জ়িল্যান্ডের উপপ্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে বিবৃতি দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘‘যে হেতু কুক দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে সাংবিধানিক সম্পর্ক রয়েছে, তাই সেখানকার প্রশাসন আমাদের না জানিয়ে কোনও নিরাপত্তা চুক্তি করতে পারে না। প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার দেশগুলির সঙ্গে ওয়েলিংটন সম্পর্ক মজবুত করার চেষ্টা করছে। বেজিঙের আগ্রাসী মনোভাবে তাতে বাধা পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।’’
১৩২২
মোট ১৫টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত কুকের জনসংখ্যা মাত্র ১৫ হাজার। তবে এই দ্বীপের অধিকাংশ বাসিন্দাই চাকরি বা অন্যান্য কাজের জন্য থাকেন নিউ জ়িল্যান্ডে। সেই সংখ্যাটি আনুমানিক এক লক্ষ বলে জানা গিয়েছে। ২০০১ সালে ‘যৌথ শতবর্ষ ঘোষণা’ করে কুক দ্বীপপুঞ্জের প্রশাসন। সেখানে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে কিউয়িদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার কথা বলা হয়েছিল।
১৪২২
কিন্তু গত কয়েক দশকে এই এলাকায় নিজের উপস্থিতি বৃদ্ধি করেছে চিন। ফলে কুক দ্বীপপুঞ্জে বেড়েছে বেজিঙের প্রভাব। এর জেরে সেখানকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব ধীরে ধীরে নিজেদের অস্ট্রেলিয়া, নিউ জ়িল্যান্ড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছেন বলে মনে করেন দুনিয়ার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
১৫২২
২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেওয়ার পর থেকে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় দ্রুত নৌসেনার উপস্থিতি বৃদ্ধির দিকে নজর দেন চিনা চেয়ারম্যান শি জিনপিং। পরবর্তী বছরগুলিতে সেখানকার একের পর এক দ্বীপরাষ্ট্রের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তি করে বেজিং। সেই তালিকায় রয়েছে সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, ভানুয়াতু, কিরিবাতি এবং সামোয়া। সেখানে সর্বশেষ হিসাবে যুক্ত হল কুক দ্বীপপুঞ্জ।
১৬২২
বিশ্লেষকদের দাবি, পিএলএ নৌসেনার এই আগ্রাসনের জেরে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জ। অস্ট্রেলিয়া এবং নিউ জ়িল্যান্ডের সঙ্গে দৃঢ় সামরিক সম্পর্ক রয়েছে ওয়াশিংটনের। সেই কারণেই পেশি ফুলিয়ে ওই দুই দেশকে চমকাতে চাইছে জিনপিংয়ের পিএলএ নৌসেনা।
১৭২২
প্রশান্ত মহাসাগরে মার্কিন নৌসেনার সবচেয়ে বড় ঘাঁটি রয়েছে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে। এই এলাকার একের পর এক দ্বীপরাষ্ট্রের উপর প্রভাব বিস্তার করে ওই ঘাঁটিকে ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা রয়েছে চেয়ারম্যান শি-র। সেই মতো ড্রাগন নৌসেনাকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি, বলছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ।
১৮২২
এ ছাড়া তাইওয়ানকে চিনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে ঘোষণা করেছেন প্রেসিডেন্ট জিনপিং। অনেকেরই অনুমান, দ্বীপরাষ্ট্রটিকে দখল করতে সেখানে আচমকা হামলা চালাবে চিনা লালফৌজ। অন্য দিকে তাইপেকে নিরাপত্তার যাবতীয় আশ্বাস দিয়ে রেখেছে ওয়াশিংটন। সেই কারণেই দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে প্রভাব বাড়াচ্ছে পিএলএ নৌসেনা।
১৯২২
এ বছরের জানুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। কুর্সিতে বসেই ড্রাগনের উপর বিপুল শুল্ক চাপানোর নির্দেশ দেন তিনি। সম্প্রতি এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রকে কড়া হুঁশিয়ারি দেয় বেজিং। ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।
২০২২
গত ৫ মার্চ ট্রাম্পের শুল্কনীতি নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে ওয়াশিংটনের চিনা দূতাবাস। সেখানে বলা হয়েছে, “আমেরিকা যদি যুদ্ধই চায়, তা শুল্কযুদ্ধ হোক, বা বাণিজ্যযুদ্ধ কিংবা অন্য কোনও যুদ্ধ, আমরা শেষ পর্যন্ত লড়াই করতে তৈরি আছি।”
২১২২
আমেরিকার চিনা দূতাবাস যুদ্ধ-প্রস্তুতির কথা বলতেই পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনও। মার্কিন প্রতিরক্ষাসচিব পিট হেগসেথ বলেছেন, “আমরাও তৈরি রয়েছি। যারা শান্তি চায়, তাদের যুদ্ধের জন্যও তৈরি থাকতে হয়। এই জন্যই আমরা নিজেদের সামরিক শক্তিকে নতুন ভাবে সাজিয়ে তুলছি।’’
২২২২
এই আবহে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় চিনা আধিপত্যকে ওয়াশিংটন একেবারেই ভাল চোখে দেখছে না। ফলে কুক দ্বীপপুঞ্জকে কেন্দ্র করে দুই মহাশক্তির সংঘর্ষের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।