স্মৃতিচারণে আখতারি বলেছিলেন, ‘‘আমি এর আগে কখনও স্টেজে অনুষ্ঠান করিনি৷ এত মানুষ স্টেজের উপর থেকে দেখে প্রথমে মনে হয়েছিল, বোধ হয় অজ্ঞান হয়ে যাব৷ একটু বেশি ক্ষণ সময় নিয়েছিলাম গান ধরতে৷ সে সময় আল্লাহকে বলেছিলাম, শক্তি দিতে৷ মুমতাজ বেগমের গাওয়া আমার সব চেয়ে প্রিয় ওই গজল দিয়েই অনুষ্ঠান শুরু করি৷ গলা ফেলার পর অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস পেয়েছিলাম৷’’
ফৈজাবাদ জেলার এক অখ্যাত শহরে জন্ম৷ মা মুস্তারির প্রেমে পড়েছিলেন বাবা আসগর হুসেন৷ লখনউয়ের আইনজীবী হুসেনের দ্বিতীয় স্ত্রী মুস্তারি৷ যিনি নিজেও ছিলেন তওয়াইফ৷ বিয়ের কিছু দিন পরই মুস্তারি ও তাঁর মেয়েদের তাড়িয়ে দেন আসগর৷ মেয়েদের নিয়ে মুস্তারি চলে আসেন ফৈজাবাদ৷ আখতারির জীবনে এটাই প্রথম বিচ্ছেদ৷ বাবাকে জীবনভর খুঁজে গিয়েছেন। কখনও যোগাযোগ হয়েছে, কখনও হয়নি৷ এ কথা সত্যি, যে ভাবে বাবাকে কাছে পেতে চেয়েছিলেন, সে ভাবে পাননি৷ মা এবং যমজ বোনের সঙ্গে এর পর বেঁচে থাকার লড়াই৷ এই লড়াইয়ের মধ্যেই দ্বিতীয় বিচ্ছেদ৷
আখতারিবাই বেগম হলেন ঠিকই, কিন্তু একটা শর্তও ছিল সেই বিয়েতে। কী সেই শর্ত? সাধারণ আসরে গান গাইতে পারবেন না বেগম। মেনে নিয়েছিলেন। হয়তো নিজেও চেয়েছিলেন একেবারে ঘরোয়া জীবন, গ্ল্যামার থেকে বিরতি। কিন্তু ক্রমেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন বেগমসাহেবা। বছর কয়েক এই ভাবে কাটিয়ে চরম অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসকেরা জানান, কোনও ওষুধে এই রোগ সারবে না। ওঁকে গানে ফেরাতে হবে।
১৯৪৯ সালে লখনউ রেডিয়োয় তিনটে গজল আর একটা দাদরা রেকর্ড করেন। অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর রেকর্ডে দেখা যাচ্ছে, সেই গান ব্রডকাস্টের সময় তাঁকে বেগম আখতার বলে সম্বোধন করা হয়। রেকর্ডিং করে এত আনন্দ পান, যে বাড়ি ফিরে অঝোরে কেঁদে ফেলেন। পরবর্তীকালে কোনও বড় অনুষ্ঠানের পরও যে ছবি ঘনিষ্ঠরা দেখেছেন। যে মা জীবনভর তাঁকে আগলে রেখেছিলেন, তাঁর মৃত্যু এর কয়েক বছর পর।
কাকার ইচ্ছেতেই গান শুরু। মাত্র সাত বছর বয়সে। যাযাবর থিয়েটার কোম্পানির চন্দাবাইয়ের কাছে হাতে খড়ি। এর পর পাটনার প্রখ্যাত সারেঙ্গি বাদক ইমদাদ খাঁ (যিনি সে সময় নিয়মিত মলকাজান ও গহরজানের সঙ্গে বাজাতন), পাটিয়ালার আতা মহম্মদ খাঁ, লাহোর নিবাসী কিরানা ঘরানার আবদুল ওয়াহিদ খাঁ, গয়ার জমির খাঁ, জুন্দা খাঁ, উস্তাদ বরকত আলি খাঁ (উস্তাদ বড়ে গুলাম আলির ভাই)য়ের কাছেও শিখেছেন।
নাটকে অভিনয়ের সূত্র ধরে কলকাতায় আসা। নাটকের পাশাপাশি জলসাতেও গান করতেন। কলকাতার সাঙ্গীতিক পরিমণ্ডলে গান শেখা থামেনি। ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে তালিম নিয়েছেন। লখনউতে চলে গেলেও কলকাতা প্রায় আসতেন রেকর্ডিংয়ের জন্য। জে এন ঘোষের মেগাফোন কোম্পানিতে ১০ বছরের চুক্তি ছিল। কখনও থেকেছেন ট্যাংরায়, কখনও রিপন স্ট্রিটে মজিদ খাঁ সাহেবের (কেরামৎ খাঁ সাহেবের বাবা) বাড়ির কাছে ভাড়া বাড়িতে। কখনও উঠেছেন বৌবাজারে। কখনও হোটেল ব্রডওয়ে। নিরিবিলি যে হোটেল সে সময় অনেক গাইয়ে-বাজিয়েরই পছন্দ ছিল।
এর পর ‘আমিনা’, ‘রূপ কুমারী’-সহ করেকটি ছবিতে অভিনয়। পরে লখনউ ফিরে আসেন। ১৯৪২ সালে পরিচালক মেহবুব খান তাঁকে ‘রোটি’ ছবিতে অভিনয় ও গান করার কথা বলেন। আখতারি রাজি হন। সেই ছবির সুরকার ছিলেন অনিল বিশ্বাস। বিয়ের পর থেকে অভিনয়েও নিষেধাজ্ঞা ছিল। বেশ কিছু হিন্দি ছবিতেও তাঁর স্মরণীয় গান আছে। প্রখ্যাত সব সুরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন।
সেটা ১৯২৫। বিভিন্ন জলসায় গান-রেকর্ডিং যখন চলছে, তখন আখতারি মোটের উপর ঠিক করে নেন, তিনি সঙ্গীত শিল্পীই হবেন। এক দিন মাকে সে কথা বলেন। মা খুবই চিন্তায় পড়েন। আখতারিকে নিয়ে যান বরেলি শরিফে এক সুফি পীরের কাছে। তাঁকে সমস্যার কথা জানান। সঙ্গে উদ্বেগ, মেয়ে বিবাহযোগ্যা। মায়ের প্রশ্ন, এমতাবস্থায় তাঁর কী করণীয়?
পীরবাবা আখতারির চোখের দিকে তাকান। তার পর, তার সবচেয়ে প্রিয় গজল বেছে দিতে বলেন। আখতারি তাঁর সামনে বইয়ের একটা পাতা মেলে ধরেন, যেখানে অন্য গানের সঙ্গে তাঁর প্রিয় গজলটিও ছিল। পীরবাবা একটি বিশেষ গানে হাত রাখেন এবং পরবর্তী অনুষ্ঠান ওই গজল দিয়ে শুরু করতে আদেশ করেন। সেই গজলটি— দিওয়ানা বানানা হ্যায় তো, দিওয়ানা বানা দে।
এইচএমভি গানটি রেকর্ড করে। সেই গান এত জনপ্রিয় হয়, যে এইচএমভির সব রেকর্ড নিঃশেষ হয়ে যায়। কিন্তু বাজারে জনপ্রিয়তায় এতটুকুও ভাটা পড়ে না, বরং চাহিদা বাড়তে থাকে লাফিয়ে। ইংল্যান্ড থেকে রেকর্ডের কপি করে যা পূরণ করা এক সময় অসম্ভব হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত ভারতে ‘রেকর্ড প্রেসিং প্লান্ট’ নিয়ে আসতে বাধ্য হয় এইচএমভি।
এত বছর পার করে এসেও কেন এত জনপ্রিয় আখতারিবাইয়ের গান? শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রভূত তালিম ওঁর ঠুংরি-দাদরা-গজলে অদ্ভুত ভাবে মিশে যেত। রাগের মধ্যে যে অনুরাগ থাকে, সেটা বড় মিষ্টি করে উনি ব্যবহার করতেন। কখনও খেয়ালের সঙ্গে ফোক মিশিয়েছেন, কখনও গজলের সঙ্গে দাদরা। পাশাপাশি, উপস্থাপনের সময় তাঁর স্বকীয়তা বজায় রাখতে পারতেন। গজল গাওয়ার ক্ষেত্রে উচ্চারণ, আবেদন এবং গায়ন শৈলী বদলে আধুনিকতার ছোঁয়া আনেন আখতারি। যা ছিল সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে থাকা ভাবনা-চিন্তার ফসল।
পুরনো লখনউ শহরের হজরতগঞ্জ এলাকার কেন্দ্রে বেগম হজরত মহল পার্ক। অযোধ্যার শেষ নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের স্ত্রী হজরত মহল সিপাহি বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়ে প্রায় এক বছর লখনউয়ের দখল রাখেন নিজের হাতে। তাঁর স্মৃতিজড়িত সেই পার্ক পেরিয়ে গেলে গোমতী নদীর পাড় বরাবর কিছু দূর এগোলে ঠাকুরগঞ্জ এলাকা। সেখানেই অমরগঞ্জে গ্রিনল্যান্ড পার্কের কাছে রয়েছে বেগম আখতারের সমাধি।
ঋণ: বেগম আখতার, দ্য কুইন অফ গজল, সুতপা মুখোপাধ্যায়, রূপা অ্যান্ড কোং। দিওয়ানা বানানা হ্যায়, মেগাফোন, পরিচিতি: জয়দেব মুখোপাধ্যায়। অ্যান ইনট্রোডাকশন টু ক্লাসিকাল মিউজিক, বিজয়প্রকাশ সিংহ, রোলি বুকস। তহজীব-এ-মৌসিকী, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, বাউলমন প্রকাশন। অ্যায় মোহাব্বত: রেমিনিসিং বেগম আখতার, রীতা গঙ্গোপাধ্যায় ও জ্যোতি সভারওয়াল, স্টেলার পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড। জলসাঘর ছবির গান নিয়ে অ্যাড্রু রবিনসনকে দেওয়া সত্যজিৎ রায়ের সাক্ষাৎকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy