নাটকে শান্তিলাল ও ঋতব্রত
সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে সমগ্র বিশ্ব আতঙ্কিত। লড়াই চলছে করোনা ভাইরাসের সঙ্গে। বাংলা তথা ভারতে বন্ধ সমস্ত রঙ্গালয়। এই রকম সময়ে যাঁকে স্মরণ করতেই হয়, তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সম্ভবত সে জন্যই হোল নাইন ইয়ার্ডস নাট্যদল আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ়র সহযোগিতায় লকডাউনের সমস্ত বিধিনিষেধ মেনেই প্রযোজনা করেছে ‘দ্য পোস্ট অফিস’ নাটকটি।
ইন্টারনেটে এই ভাবে নাটক করা বা দেখার অভিজ্ঞতা আমাদের প্রায় নেই। তবু নাটককে বাঁচিয়ে রাখা এবং প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বিকল্প ধারা খোঁজার এটি একটি চমৎকার প্রয়াস। পরিচালক অভ্রজিৎ সেন মূল নাটকের ভাব ও ভাবনাকে নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ের সঙ্গে মিশিয়ে করেছেন এই উপস্থাপনা। রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’ নাটকের সঙ্গে আমাদের অধিকাংশ মানুষের পরিচয় হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে। এ রকম মানুষ কমই পাওয়া যায়, যারা কৈশোরে স্কুলের ‘ডাকঘর’ নাটকের অভিনয়ে অংশ নেয়নি—অন্তত অভিনয় হতে দেখেনি। যদিও অনেক ছোট বয়সে দেখা নাটকের গল্পাংশ মনে না-ও থাকতে পারে আর বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই গল্পটি না-ও জানতে পারে। তাই গল্পটি সংক্ষেপে জানানো দরকার।
নাটকের মূল চরিত্র অমল। সে তার পিসেমশাই মাধব দত্ত ও তাঁর স্ত্রীর কাছে থাকে। কঠিন অসুখে আক্রান্ত অমল গৃহবন্দি কবিরাজের নির্দেশে। বাইরের আলো-বাতাস তার কাছে যমদূতের সমান। তবে শরীর ঘরে আটক থাকলেও তার মন উড়ে বেড়ায়, ঘুরে বেড়ায়, চলে যেতে চায় দূর দেশে— সমস্ত কঠোর বাধানিষেধ উপেক্ষা করে। তার মনের খবর রাখেন শুধু ঠাকুরদা। একা জানালার ধারে বসে থাকা অমলকে তিনি শোনান দেশবিদেশের খবর, যা অমলের কল্পনাকে লাগামছাড়া করে দেয়।
সারাদিন বসে থাকা অমলের সঙ্গে আলাপ হয় নানা চরিত্রের—দইওয়ালা, রাজার প্রহরী, মোড়ল, ছেলের দল। অমলের সঙ্গে তাদের কথায় বারবার বোঝা যায় যে, অমলের কাছে শারীরিক কষ্টের চেয়ে অনেক বেশি কষ্টকর তার এই বন্দিদশা। সে মুক্ত ভাবে দেখতে চায় এই পৃথিবীকে, কিন্তু বাদ সাধে তার অসুখ। অমল অপেক্ষা করে সুদিনের— যে দিন তার বন্দিদশা ঘুচে যাবে। সে অপেক্ষা করে কোনও এক ডাক হরকরার—যে নিয়ে আসবে রাজার চিঠি, যাতে থাকবে তার মুক্তির কথা। অমল কল্পনায় কখনও হয়ে যায় দইওয়ালা, কখনও প্রহরী, আবার কখনও বা ডাক হরকরা। প্রতিটি মানুষের চোখ দিয়ে অমল দেখে এই সব সম্পর্ক। কঠিন পরিস্থিতিতেও তার মন মুক্ত আর গভীর আশাবাদী। মূল নাটকের শেষে দূতের হাত ধরে অমল ধীরে ধীরে চলে যায় সেই পরম মুক্তির পথে। তার আর রাস্তার পাহারাওয়ালা হওয়া হয় না—সম্ভব হয় না সুধার সঙ্গে দেখা করা। কিন্তু এই মুক্তিতেই তো অমল প্রকৃত অর্থে মিশেছে বিশ্বের সঙ্গে।
এখন এই বিশ্বের দমবন্ধ করা পরিস্থিতিতে ‘দ্য পোস্ট অফিস’ নাটকটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। গৃহবন্দি অবস্থা যখন মানুষকে মানসিক ভাবে অস্থির করে তুলেছে, সেই সময়ে এই নাটক বদ্ধ অবস্থার মধ্যেই মুক্তির পথ দেখায়। অভিনয়ে ঠাকুরদার ভূমিকায় শান্তিলাল মুখোপাধ্যায় চরিত্রটিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর চলাফেরা, কথা বলার ঢং মনে রেখাপাত করে। অমলের চরিত্রে ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়ের অভিনয় বেশ ভাল, তবে মাঝেমাঝে মানানসই মনে হয়নি, সম্ভবত বয়সের কারণে। মাধব দত্ত, প্রহরী, মোড়ল, সুধা— প্রত্যেকেই নিজ নিজ ও চরিত্রের প্রতি সুবিচার করেছে। ছেলের দলকে বাদ দিতে হয়েছে সম্ভবত বিধিনিষেধের জন্য।
বিভিন্ন চরিত্রের ক্ষেত্রে পশ্চাদপট হিসেবে রাস্তার ব্যবহার প্রশংসনীয়। পঞ্চাশের দশকের সিনেমার পশ্চাদপটশিল্পী রামচন্দ্র শেন্ডের কথা মনে করিয়ে দেয়। কপিরাইট চলে যাওয়ার পর থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিচ্যুতি মন খারাপ করে দেয়। কিন্তু এই নাটকে মূল নাটক থেকে তেমন কোনও সরে আসার প্রবণতা দেখা গেল না। এর জন্য পরিচালক ধন্যবাদ পাবেন অবশ্যই। নাটকটি বাংলায় না হয়ে ইংরেজিতে হওয়ার বিশেষ কারণ আছে নিশ্চয়ই। তবে খুব সহজ ভাবেই উচ্চারিত বলে অধিকাংশ জায়গাই বুঝতে অসুবিধে হয় না। কিন্তু মাঝে মাঝে নাটকের গতি শ্লথ বলে মনে হয়েছে। অনুবাদ করার সময়ে এ ব্যাপারে নজর দিলে হয়তো এই অবস্থা পরিহার করা যেত। রবীন্দ্রনাথের রচনা স্থান-কালের ঊর্ধ্বে। বহু দেশে বহু ভাষায় অনুবাদ হয়েছে তো বটেই—অনেক দেশে অভিনীতও হয়েছে। তবে তা সেই দেশের ভাষাতেই। এখানে কোনও কোনও চরিত্রের মুখে হঠাৎ এক-একটি বাংলা শব্দ শুনে খটকা লাগে। এটি অনিচ্ছাকৃত, নাকি পরিচালক কিছু ইঙ্গিত করতে চাইছেন ? দ্বিতীয় ক্ষেত্রে অবশ্য বলতে দ্বিধা নেই, সেই প্রচেষ্টা সফল হয়নি।
এই নাটকে কথা বলার সময়ে সকলকেই ভাবতে হয়েছে যে, সামনের চরিত্র হল ক্যামেরা। আর তাই দিক বা অ্যাঙ্গল ভুল হলে নাটকের মূল সুর নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু এই নাটকে প্রত্যেক কলাকুশলী নির্ভুল ভাবে অভিনয় করেছেন। এ জন্য তাঁদের এবং পরিচালককে সাধুবাদ জানাতেই হয়। নাটকে সঙ্গীতের চয়ন ও প্রয়োগ যথাযথ।
পরিশেষে অভিনন্দন জানাই হোল নাইন ইয়ার্ডস নাট্যদলকে— এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও নাটককে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। নাট্যশিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এ এক মহান প্রয়াস। এই মাধ্যমে আরও ভাল কাজ করবে তারা— মনেপ্রাণে এই আশা করি। যদিও আমাদের মন পড়ে আছে আমাদের চিরপরিচিত নাট্যমঞ্চের দিকেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy