Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Prithviraj Kapoor

ভারতীয় চলচ্চিত্র ও হিন্দি থিয়েটারের প্রথম রাজা

গ্রিক দেবতার মতো চেহারা, গমগমে কণ্ঠস্বর। অন্তরে একনিষ্ঠ সমাজবাদী। রুপোলি পর্দা ও নাট্যমঞ্চের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব, হিন্দি সিনেমায় কপূর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা পৃথ্বীরাজ কপূর। তাঁর সিনেমার সিংহাসনে বসার কাহিনি লিখছেন সুদেষ্ণা বসু

‘মুঘল-এ-আজ়ম’ ছবির দৃশ্য।

‘মুঘল-এ-আজ়ম’ ছবির দৃশ্য।

সুদেষ্ণা বসু
শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০২৩ ০৮:৫৮
Share: Save:

১৯২৮ সাল। বর্ষা শেষের কোনও এক বিষণ্ণ বিকেলে সুদূর পেশোয়ার থেকে রওনা হয়ে ফ্রন্টিয়ার মেল দু’দিন, দু’রাত পার করে বোম্বাই (আজকের মুম্বই) শহরের কোলাবার আদি রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এসে থামল। ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণির একটি কামরা থেকে অন্যান্য যাত্রীদের সঙ্গে নামলেন বছর বাইশের এক হিন্দু পাঠান যুবক। সুঠাম, সুন্দর চোখে পড়ার মতো চেহারা।

দু’হাতে বাক্স, বিছানা, একটা হকিস্টিক আর পকেটে পঁচাত্তর টাকা। স্টেশনের বাইরে এসে তখনকার মুম্বই শহরের ঐতিহ্যময় যান ঘোড়ায় টানা ভিক্টোরিয়ার (ফিটন) এক চালকের সামনে এসে যুবকটি বললেন, “আমি সমুদ্র দেখতে চাই।” বিস্মিত, হতভম্ব চালক তাঁকে নিয়ে হাজির হল ইন্ডিয়া গেটের সামনে। সামনে বিস্তীর্ণ আরব সাগরের দিকে কিছুক্ষণ তাকালেন যুবক। তার পর মাথা তুলে অনন্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলেন, “হে ঈশ্বর, আমি অভিনেতা হতে এই শহরে এসেছি। আমাকে তুমি যদি অভিনেতা না বানাও তা হলে আমি এখান থেকে হলিউডে চলে যাব।” কোনও মানুষ তাঁর ঈশ্বরের কাছে এমন শর্ত কখনও রেখেছিলেন কি না জানা নেই, তবে ঈশ্বর সে শর্ত মেনে নিয়েছিলেন।

এ বার সেই যুবক চালককে বললেন, “আমাকে এমন একটি হোটেলে নিয়ে চলো যার কাছেই আছে একটি সিনেমার স্টুডিয়ো। কারণ, আমি অভিনেতা হতে চাই।” সম্বল বলতে গ্রিক দেবতার মতো চেহারা। চালক ভেবেছিলেন যুবকটি পাগল। কথা না বাড়িয়ে চালক মুম্বইয়ের মেট্রো সিনেমার উলটো দিকের কাশ্মীর হোটেলে পৌঁছে দিলেন তাঁকে। সে দিন তিনি কল্পনাও করতে পারেননি, যাঁকে হোটেলে পৌঁছে দিল, কালক্রমে তিনিই আত্মপ্রকাশ করবেন হিন্দি সিনেমা ও নাটকের এক প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব, সকলের ‘পাপাজি’ ওরফে পৃথ্বীরাজ কপূর হিসেবে!

কাশ্মীর হোটেল থেকে ইম্পিরিয়াল স্টুডিয়োয় যাওয়ার রাস্তাটা পৃথ্বীরাজের জানা ছিল না। কিন্তু ওই হোটেলেই ঘটনাচক্রে তাঁর সঙ্গে দুই বাসিন্দার আলাপ হল। তাঁরাই ছবি এঁকে পৃথ্বীরাজকে ইম্পিরিয়াল স্টুডিয়োর রাস্তা বুঝিয়ে দিলেন। পরদিন সকালে সেই ছবি হাতে হাঁটতে হাঁটতে পৃথ্বীরাজ পৌঁছলেন ইম্পিরিয়াল স্টুডিয়োর দরজায়। এক বিশাল চেহারার রক্ষী দরজা আগলে দাঁড়িয়ে। পৃথ্বীরাজ খেয়াল করলেন লোকটিও পাঠান জাতিভুক্ত। বুদ্ধি করে সেই পাঠান রক্ষীর সঙ্গে নিজের শহরের ভাষা ‘পশতু’তে গল্প জুড়ে দিলেন তিনি। তাঁকেও জানালেন তাঁর অভিনেতা হওয়ার স্বপ্নের কথা। ফল হল সঙ্গে সঙ্গে। রক্ষী পৃথ্বীরাজকে স্টুডিয়োর ভিতরে ঢুকতে দিয়ে বলে দিলেন, যেখানে বিনা পারিশ্রমিকে অভিনয় করার জন্য ‘একস্ট্রা’রা ভিড় জমিয়েছে সেই লাইনে দাঁড়িয়ে পড়তে।

এই ইম্পিরিয়াল ছিল ভারতীয় সিনেমার নির্বাক যুগের এক খ্যাতনামা স্টুডিয়ো। এর মালিক পার্সি চলচ্চিত্র ব্যবসায়ী খান বাহাদুর আরদেশির ইরানি। এখানেই ভারতের প্রথম টকি ‘আলম আরা’ তৈরি হয়েছিল। একস্ট্রাদের লাইনে কয়েক দিন দাঁড়িয়ে পৃথ্বীরাজ বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা সহজ নয়। এ দিকে মাত্র পঁচাত্তর টাকা সম্বল। কাশ্মীর হোটেলে বেশি দিন থাকা যাবে না। তিনি আরদেশির ইরানির সঙ্গে দেখা করলেন। কিন্তু কাজ হল না। বাধ্য হয়ে পৃথ্বীরাজ স্টুডিয়োর কাছেই একটি সস্তার ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করলেন। দেখা গেল ঈশ্বর কথা রাখলেন। একস্ট্রা হিসেবে তিনি তিনটি নির্বাক ছবিতে কাজ পেলেন। ‘বে ধারি তলওয়ার’ বা ‘চ্যালেঞ্জ’ (পরিচালক ভগবতী প্রসাদ মিশ্র) ‘ওয়েডিং নাইট’ (পরিচালক পি ওয়াই অল্টেকর) ও ‘দাও পেচ’। ভগবতী প্রসাদ মিশ্র ও পি ওয়াই অল্টেকর তখন ইম্পিরিয়াল স্টুডিয়োয় নাম করা পরিচালক।

নির্বাক যুগে গোয়ার বাসিন্দা ইহুদি অভিনেত্রী এরমেলিন বা সুধাবালা ইম্পিরিয়ালের ছবির নায়িকার চরিত্রে কাজ করতেন। তাঁর জনপ্রিয়তা তখন আকাশছোঁয়া। এরমেলিন এক দিন লাইনে দাঁড়ানো সুপুরুষ চেহারার পৃথ্বীরাজকে দেখে তাঁর নায়ক হিসেবে নির্বাচিত করে ছবি করতে অনুরোধ করলেন আরদেশির ইরানিকে। জনপ্রিয় নায়িকার আবদার কোনও প্রযোজকই কোনও কালে ফেলতে পারেননি। শুটিং শুরু হল। কিন্তু শুটিংয়ের সময় পৃথ্বীরাজ আহত হলেন। ফলে কাজ স্থগিত। স্টুডিয়োয় যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। হাতে টাকা নেই। নিজেকে অভুক্ত অবস্থায় ঘরবন্দি রেখে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠার প্রতীক্ষা করতে থাকলেন।

সেই পাড়ায় ছিল এক গণিকাপল্লি। সেখানকার এক গণিকার পৃথ্বীরাজকে মনে ধরেছিল তাঁর সুন্দর চেহারার জন্য। তিনিই প্রথম খেয়াল করলেন পৃথ্বীরাজ কয়েক দিন ঘর থেকে বেরোচ্ছেন না। কিছু আশঙ্কা করে মহিলাটি খোঁজ করতে পৃথ্বীরাজের দরজায় কড়া নাড়েন। দেখতে পেলেন আহত ও অভুক্ত পৃথ্বীরাজ শুয়ে আছেন। তিনি তখন তাঁর চিকিৎসা ও খাবারের ব্যবস্থা করলেন। শোনা যায়, মহিলাটির সাহায্য নেওয়ার আগে পৃথ্বীরাজ নাকি তাঁকে বাধ্য করেন তাঁর হাতে রাখি পরিয়ে দিতে। মহিলাটি তাই করেন ও দু’জনের মধ্যে সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শশী কপূর জানিয়েছেন, “মেয়েটি যত দিন বেঁচেছিলেন প্রতি বছর রাখি পূর্ণিমার দিন রাখি পরাতে হাজির হয়ে যেতেন আমাদের বাড়িতে।”

১৯৩০ সালে এরমেলিন ও পৃথ্বীরাজ অভিনীত ‘সিনেমা গার্ল’ ছবিটি মুক্তি পায়। অসম্ভব জনপ্রিয়তাও পায়। নির্বাক হিন্দি সিনেমার জগতে পৃথ্বীরাজ কপূর নামে নতুন এক নায়কের আগমনকে সকলেই মেনে নেয়। চলচ্চিত্র জগতে পৃথ্বীরাজের জীবন এই ভাবেই শুরু হয়েছিল, যা শুনতে সিনেমার গল্পের মতোই লাগে।

পৃথ্বীরাজ বা পৃথ্বীনাথ কপূরের জন্ম ৩ নভেম্বর ১৯০৬, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার অবিভক্ত পঞ্জাবের লায়লপুর জেলার (আজকের ফৈজ়লাবাদ জেলা, পাকিস্তান) সামুন্দরি শহরে। তাঁর শৈশব কাটে লায়লপুরে পিতামহ দেওয়ান কেশবমল কপূরের আদর যত্নে। বর্ধিষ্ণু সম্মাননীয় বিশাল কপূর পরিবার ধর্মে হিন্দু এবং ঢাই ঘর ক্ষত্রী সম্প্রদায়ভুক্ত। পৃথ্বীরাজের বয়স যখন তিন, তাঁর মা বৈষ্ণো দেবী মারা যান। কেশবমলের আশঙ্কা ছিল স্ত্রীর মৃত্যুর পর পুত্র ভস্মেশ্বরনাথ আবার বিয়ে করবে। তিনি চাননি পৃথ্বীরাজ তাঁর সৎ মায়ের কাছে বড় হোক। তাই তিনি পৃথ্বীরাজকে নিজের কাছে রেখে দেন। সামুন্দরি শহরের সহজ জীবন ও চারপাশের বিস্তীর্ণ চরাচরের মাঝে মনোরঞ্জনের জন্য কেশবমল তাঁর গোয়ালঘরে মাঝে মাঝে রামায়ণ ও মহাভারতের গল্প থেকে নাটক মঞ্চস্থ করাতেন। সেখানেই ছোট্ট পৃথ্বীরাজের প্রথম অভিনয়ের শুরু। গোয়ালঘর তাঁর প্রথম মঞ্চ।

পিতামহই ছিলেন পৃথ্বীরাজের বাবা ও মা। মায়ের অভাবে তাঁর মন কাঁদত। সেই অভাব অনেকটাই মিটিয়ে দিতেন তাঁর পিসি কৌশল্যা খন্না। এই পিসি পৃথ্বীরাজকে নিজের সন্তানের মতো ভালবাসতেন। পরবর্তী কালে পৃথ্বীরাজের মুম্বইয়ে আসার খরচের টাকা তিনিই জুগিয়েছিলেন। এই খন্না পরিবার বিপুল ধনসম্পত্তির মালিক ছিল। পৃথ্বীরাজের বাবা ছিলেন ইন্ডিয়ান ইম্পিরিয়াল পুলিশের অফিসার। তাঁর ছিল বদলির চাকরি। চাকরির সূত্রে তিনি আজকের পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখোয়ার পেশোয়ার শহরে থাকতেন। কেশবমলের আশঙ্কাকে সত্যি করে ভস্মেশ্বরনাথ দ্বিতীয় বিয়ে করেন ও চার পুত্র ও তিন কন্যার জন্ম দেন।

পৃথ্বীরাজের পড়াশোনা সামুন্দরি অ্যাংলো-ভারনাকুলার ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড মিডল স্কুল এবং লায়লপুরের খালসা কলেজে। প্রথম শ্রেণিতে ম্যাট্রিক পাশ করে পৃথ্বীরাজ পেশোয়ার শহরের কিং এডওয়ার্ড’স কলেজে ভর্তি হন। তাঁর মেন্টর ছিলেন কলেজের ড্রামাটিক সোসাইটির প্রধান জয় দয়াল এবং অধ্যাপকের পত্নী নোরা রিচার্ডস। নোরা রিচার্ডস পৃথ্বীরাজের মনে গভীর ছাপ ফেলেছিলেন। পৃথ্বীকে তিনিই পাশ্চাত্য নাটকের জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন ও অভিনেতা হতে উৎসাহ জোগান। পরবর্তী কালে নোরা রিচার্ডস পৃথ্বীরাজের যাবতীয় কাজের খোঁজ রেখে গিয়েছেন। দয়াল তাঁকে কলেজের ড্রামাটিক ক্লাবের তিনটি নাটকে অভিনয় করান। ‘দিনা কি বরাত’ (নাট্যকার আর এল সাহনি), ‘স্প্রেডিং দ্য নিউজ়’ (আইরিশ নাট্যকার ইসাবেলা অগাস্টা বা লেডি গ্রেগরি) ও ‘রাইডার্স টু দ্য সি’ (আইরিশ নাট্যকার জন মিলিংটন সিঞ্জ)। পৃথ্বীরাজকে দিয়ে তিনি নারী চরিত্রেও অভিনয় করিয়েছিলেন। ক্রমশ পৃথ্বীরাজ কলেজের অ্যামেচার ড্রামাটিক ক্লাবের সেক্রেটারি হন ও কলেজের নায়ক হয়ে ওঠেন। অধ্যাপক দয়াল লিখে গিয়েছেন, সাজঘরে একা বসে পৃথ্বী শেক্সপিয়রের বিভিন্ন চরিত্র হয়ে উঠতে চেষ্টা করতেন। তাঁর এই ধরনের অভিজ্ঞতা পরবর্তী কালে গ্রান্ট অ্যান্ডারসন কোম্পানিতে শেক্সপিয়রের নাটকে কাজ করতে খুব সাহায্য করেছিল। শাইলক ও প্রসপেরো ছিল পৃথ্বীরাজের প্রিয় দু’টি চরিত্র। তাঁর অভিনীত কলেজের নাটক ‘দ্য বয় কামস্‌ হোম’ খুব প্রশংসা পেয়েছিল।

আর্টস নিয়ে তিনি বিএ পাশ করেন ১৯২৭ সালে। ইতিমধ্যে কলেজে পড়তে পড়তেই ১৭ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় কপূর পরিবারের প্রতিবেশী অনাথ মেয়ে রামসরনির (রামা) সঙ্গে। তাঁদের প্রথম সন্তান রাজ কপূরের জন্ম ১৯২৪ সালে। বিএ পাশ করার পরে এক বছর আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন লাহৌরের ‘কলেজ অব ল’তে। প্রথম বছরের পরীক্ষায় পাশ করতে পারেননি অভিনয়ের নেশা মাথায় চেপে বসার কারণে। তাঁর অভিনেতা হওয়ার সিদ্ধান্তে পিতা ভস্মেশ্বরনাথের আপত্তি ছিল। উচ্চ বংশের ছেলে হয়ে পৃথ্বীরাজ ‘কঞ্জর’ (নিচু জাতের যাযাবর শ্রেণির শিল্পী) হবে, তা তিনি মেনে নিতে পারেননি। কড়া ধাতের পিতার চোখ এড়িয়ে পৃথ্বীরাজ মুম্বই এসেছিলেন একা। তিনি যে হিন্দি নির্বাক ও সবাক সিনেমায় সফল এক জন অভিনেতা হয়েছেন, তা ভস্মেশ্বরনাথ জেনেছিলেন অনেক পরে।

‘সিনেমা গার্ল’-এর সাফল্যের পর এরমেলিন ও পৃথ্বীরাজ কপূর জুটিকে নিয়ে নির্বাক ছবি করা শুরু হয়। ভগবতী প্রসাদ মিশ্র এই জুটি নিয়ে সাগর ফিল্ম কোম্পানির জন্য ১৯৩১ সালে আরও দু’টি ছবি করেন, ‘তুফান’ (চিল্ড্রেন অব দ্য স্টর্ম) ও ‘দ্রৌপদী’। ১৯৩১ সালেই পৃথ্বীরাজ ভারতীয় সিনেমার প্রথম মাইলস্টোন, আরদেশির ইরানি পরিচালিত প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘আলম আরা’য় অভিনয়ের সুযোগ পান সেনাপতি ‘আদিল’-এর চরিত্রে। তাঁর কণ্ঠস্বরের জাদুতে দর্শক মোহিত হয়ে যায়। সবাক চলচ্চিত্র পৃথ্বীরাজকে তাঁর চেহারার সঙ্গে তাঁর গমগমে কণ্ঠস্বরকে কাজে লাগানোর সুযোগ করে দেয় ও তাঁর জনপ্রিয়তাও বাড়তে থাকে।

পৃথ্বীরাজের জনপ্রিয়তার কারণে ইম্পিরিয়াল স্টুডিয়োয় তাঁর মাইনে বেড়ে হয় মাসে সত্তর টাকা। স্ত্রী রামসরনি ও পুত্র রাজকে পেশোয়ার থেকে নিয়ে এসে তিনি মুম্বইয়ের তারদেও অঞ্চলে ঘর ভাড়া করে থাকতে শুরু করেন। যে বছর স্ত্রী রামসরনি মুম্বই আসেন, শাম্মি কপূর তখন তাঁর গর্ভে। ১৯৩১ সালের ২১ অক্টোবর শাম্মির জন্ম হয়।

কয়েক মাস পর পৃথ্বীরাজের মাস মাইনে আরও বেড়ে হয় দুশো টাকা। ১৯৩০-৩১ সালে নির্বাক থেকে সবাক পর্বে তিনি আরও দশটি ছবিতে কাজ করেন। কিন্তু এত সব হলেও ইম্পিরিয়াল স্টুডিয়োর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে ভাঙন ধরে। ১৯৩২ সালে ইম্পিরিয়াল স্টুডিয়োর জন্য ‘দগাবাজ় আশিক’ ছবিটি করার পর তিনি স্টুডিয়ো ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। সাফল্য ও অর্থ পেলেও পৃথ্বীরাজের মন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল রকমারি পৌরাণিক পোশাক পরে রাজা বাদশাদের চরিত্রে অভিনয় করতে করতে। তাঁর মন খুঁজছিল ছাত্র জীবনের থিয়েটারের দিনগুলোর সেই শেক্সপিয়র, জর্জ বার্নাড শ-এর নাটকের চরিত্রদের। নোরা রিচার্ডস ও অধ্যাপক জয় দয়াল যেন এসে দাঁড়াতেন তাঁর সামনে। পৃথ্বীরাজ বুঝতে পারছিলেন, যে জাতের অভিনেতা তিনি হতে চান তা নির্বাক ও সবাক যুগের ছবিগুলির চরিত্র তাঁকে দিতে পারছে না।

এই সময়ে ১৯৩৩ সালে মুম্বইয়ে ছিলেন স্কটিশ অভিনেতা, লেখক ও নাট্য পরিচালক জেমস গ্রান্ট অ্যান্ডারসন। তিনি তখন ‘অ্যান্ডারসন থিয়েট্রিকাল কোম্পানি’ নামে এক ভ্রাম্যমাণ নাট্যদল পত্তন করে, ভারতীয় অভিনেতাদের খোঁজ করছিলেন। খবর পেয়ে পৃথ্বীরাজ অ্যান্ডারসনের দলের সঙ্গে যুক্ত হন ও স্ত্রী পুত্র নিয়ে ভারতের নানা শহরে নাটক করতে বেরিয়ে পড়েন। এই দলে তাঁর সঙ্গে অভিনেতা ডেভিড এবং দুর্গা খোটেও ছিলেন। ইংরেজ ও ভারতীয় অভিনেতারা শেক্সপিয়র, বার্নার্ড শ ও কালিদাসের সংস্কৃত নাটক বিভিন্ন শহরে করে বেড়াতেন। পৃথ্বীরাজ ‘হ্যামলেট’ নাটকের ‘লেয়ারটিস’, রোমিও জুলিয়েটের ‘রোমিও’, ‘জুলিয়াস সিজ়ার’ নাটকে ‘ক্যাসিয়াস’ এবং কালিদাসের ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকে ‘চারুদত্ত’র চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এই নাট্যদল তাঁর হারিয়ে যাওয়া শৈশব ও কৈশোরকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। পরবর্তী কালে গণনাট্য সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে অর্থসংগ্রহে বেরিয়ে পৃথ্বীরাজ শেক্সপিয়রের চরিত্রের সংলাপ অবলীলায় আওড়ে যেতেন। সান্ধ্য আড্ডায় তাঁর অভিনীত শেক্সপিয়রের ‘দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস’ নাটকের শাইলকের সংলাপ শুনে প্রখ্যাত রুশ পরিচালক পুডভকিন কেঁদে আকুল হয়ে গিয়েছিলেন আর অভিনেতা চেরকাশভ অভিভূত হয়ে পৃথ্বীকে জড়িয়ে ধরে আবেগের চুম্বনে ভরিয়ে দিয়েছিলেন।

মঞ্চ পৃথ্বীরাজকে এতটাই বিভোর করে রাখত যে, অভিনয়ের সময় তিনি অন্য মানুষ হয়ে যেতেন। এক বার ইন্দোরে একটি শোয়ের শেষ দৃশ্যে মৃত্যুবরণ করে মাটিতে ঢলে পড়ার কথা ছিল। মৃত্যুর পর যবনিকা পতন। সেই মতো দৃশ্যের শেষে পৃথ্বীরাজ মঞ্চের মাটিতে ঢলে পড়লেন এবং তুমুল করতালির মধ্যে যবনিকা নেমে আসতে শুরু করল। কিন্তু দেখা গেল যেখানটিতে পৃথ্বীরাজ শুয়ে আছেন, যবনিকাটি নেমে এসে ঠিক সেইখানে তার ভারী রডসহ আছড়ে পড়বে। মরিয়া হয়ে সকলে চাপাস্বরে উইংসের পাশ থেকে তাঁকে খানিকটা সরে যেতে বলে। গ্রান্ট অ্যান্ডারসন ভয় পেয়ে গিয়ে বার বার চেঁচিয়ে বলতে থাকেন। কিন্তু দেখা যায় পৃথ্বীরাজ নিথর হয়ে শুয়ে। যবনিকার পর্দা ভারী রডসহ আছড়ে পড়ল তাঁর উপরে। সকলেই ধরে নিয়েছিল পৃথ্বীরাজের মাথা হয়তো ফেটে গেল। যবনিকা পতন সম্পূর্ণ হলে সকলে ছুটে এসে দেখে পৃথ্বীরাজ অক্ষত অবস্থায় উঠে দাঁড়িয়েছেন। বিরক্ত অ্যান্ডারসন জানতে চান, বারবার বলা সত্ত্বেও তিনি সরলেন না কেন? পৃথ্বীরাজের শান্ত উত্তর ছিল, “মৃত মানুষ নড়ে না।”

‘অ্যান্ডারসন থিয়েট্রিকাল কোম্পানি’র সঙ্গে সারা ভারত ঘুরে নাটক করে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা সুখের হয়নি। অর্থাভাবে দিনের পর দিন অভিনেতাদের খাওয়া জুটত না। চিঁড়ে খেয়ে দিন কাটাতে হত। দল চালানো অ্যান্ডারসনের পক্ষে ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠেছিল। শেষে কয়েক মাস এই ভাবে চালিয়ে কলকাতা পৌঁছে গ্রান্ট অ্যান্ডারসন তাঁর দল ভেঙে দিতে বাধ্য হন। ইংরেজ অভিনেতারা দেশে ফিরে যান। ভারতীয় অভিনেতাদের বলা হয় অন্যত্র কাজ খুঁজে নিতে। পৃথ্বীরাজ তাঁর স্ত্রী রামা ও পুত্র রাজকে নিয়ে কলকাতা কালীঘাট এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে থেকে যান।

কলকাতায় পৃথ্বীরাজ ছ’বছর ছিলেন। সেই সময়কালে তিনি দেবকী বসু, প্রমথেশ বড়ুয়া, নীতিন বসু, প্রফুল্ল রায়, হেমচন্দ্র চন্দ্র প্রমুখের ছবিতে অভিনয় করেন। ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৯ এই ছ’বছরে পৃথ্বীরাজ প্রায় ১২টি ছবিতে অভিনয় করেন। ছবির চরিত্রগুলিও বিভিন্ন ধরনের। যার মধ্যে দেবকী বসুর ‘সীতা’, ‘বিদ্যাপতি’ যেমন আছে, তেমনই প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘মঞ্জিল’ ও নীতিন বসুর ‘প্রেসিডেন্ট’-এর মতো উল্লেখযোগ্য ছবিও আছে। মনে রাখা দরকার, সে কালে ভারতীয় সিনেমার মক্কা ছিল কলকাতা। নিউ থিয়েটার্সের হাতি মার্কা ছবির জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। বিভিন্ন সময়ে নায়িকা হিসেবে পৃথ্বীরাজ পেয়েছিলেন দুর্গা খোটে, কানন দেবী, সিতারা দেবী, যমুনা বড়ুয়া ও সাধনা বসুর মতো তারকাদের।

কলকাতার অভিজ্ঞতা পৃথ্বীরাজকে অভিনেতা হিসেবে খুব সাহায্য করেছিল। ইতিমধ্যে মুম্বইয়ের চলচ্চিত্র দুনিয়ায় তৈরি হচ্ছিল নামকরা বিভিন্ন চলচ্চিত্র সংস্থা বা স্টুডিয়ো। নতুন সর্বভারতীয় হিন্দি সিনেমা তৈরির প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল। সেই যজ্ঞে পৃথ্বীরাজের ডাক পড়ে স্বাভাবিক কারণে। ১৯৩৯ সালে তিনি ও স্ত্রী রামসরনি, পনেরো বছরের রাজ, আট বছরের শাম্মি ও এক বছরের শশীকে নিয়ে মুম্বই পাড়ি দেন। সেখানে গিয়ে তিনি রঞ্জিৎ মুভিটোনের সঙ্গে যুক্ত হন।

পৃথ্বীরাজ মুম্বই ফিরে আসার পর তাঁকে নিয়ে কাজ করার জন্য স্টুডিয়োগুলির মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়। ফলে বাধ্য হয়ে পৃথ্বীরাজ স্টুডিয়ো ঘরানার প্রথা ভেঙে বেরিয়ে এসে ‘স্বাধীন অভিনেতা’ হিসেবে বিভিন্ন ছবিতে কাজ করতে শুরু করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। মিনার্ভা মুভিটোনের সোহরাব মোদী পরিচালিত ও অভিনীত ‘সিকন্দর’ ছবিটির মধ্য দিয়ে পৃথ্বীরাজ সর্বভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে বিপুল সাফল্য পান। এই ছবিতে পৃথ্বীরাজ অভিনয় করেন সম্রাট আলেকজান্ডারের ভূমিকায়। পরে, ‘রুস্তম সোহরাব’, ‘ফুল’, ‘মুঘল-এ-আজ়ম’, ‘পরদেশি’, ‘দহেজ’ ইত্যাদি ছবি তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দেয়। পৃথ্বীরাজ ভারতীয় সিনেমায় নিজের সিংহাসনে আসীন হন।

সারা জীবনে হিন্দিসহ অন্যান্য ভাষার ছবি মিলিয়ে তাঁর অভিনীত ছবির সংখ্যা প্রায় ১৩০। ১৯৫৭ সালে ‘প্যায়সা’ নামে (একই নামের নাটকের উপর ভিত্তি করে) একটি ছবি তিনি পরিচালনা করেন। ‘সিকন্দর’-এর খ্যাতি যখন ছড়িয়ে পড়েছে তখন তাঁর আরও একটি সত্তার জন্ম হয়। পৃথ্বীরাজ ‘ইন্ডিয়ান পিপল’স্‌ থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন’ বা আইপিটিএ-র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে যুক্ত হন। গণনাট্য সঙ্ঘের ঋদ্ধ ইতিহাসের সঙ্গী ছিলেন পৃথ্বীরাজ কপূর। এই সঙ্ঘের নীতি ছিল, নাটকের মধ্য দিয়ে জনমানসে সামাজিক ন্যায়ের দাবিকে ছড়িয়ে দেওয়া। সেই কাজে শহর ছাড়িয়ে ভারতের বিভিন্ন গ্রামে নাট্যদল নিয়ে গণনাট্য সঙ্ঘ পৌঁছে যেত নাটক করতে। এই কাজে ভারতের বিভিন্ন শহর থেকে নানা ভ্রাম্যমাণ নাট্যদল সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল।

চলচ্চিত্রের কাজের তুমুল ব্যস্ততার মধ্যেও পৃথ্বীরাজ গণনাট্য সঙ্ঘের সভাসমিতিতে যেতেন ও অভিনয় করে অর্থ সংগ্রহ করতেন। এ বার চলচ্চিত্রের পাশাপাশি নিজের নাট্যদল তৈরি করে মঞ্চ ও পর্দায় সমান দক্ষতায় অভিনয় করে যেতে শুরু করলেন। ১৫ জানুয়ারি ১৯৪৪ সালে নিজের নাট্যদল ‘পৃথ্বী থিয়েটার’ জন্ম নিল। যা ভারতের পার্সি থিয়েটারের মতোই হিন্দি নাট্যধারার পত্তন করল। পৃথ্বীরাজ হয়ে উঠলেন সেই নাট্যধারার জনক।

পৃথ্বী থিয়েটারের ইতিহাস দীর্ঘ ও বর্ণময়। ১৯৪৪ থেকে ১৯৬০ এই ষোলো বছরে এই ভ্রাম্যমাণ থিয়েটার মোট আটটি নাটক নিয়ে, একশোরও বেশি শহর ঘুরে ২৬৬২ রজনী অভিনয় করেছিল। নাটকগুলি ছিল ‘শকুন্তলা’ (১৯৪৫), ‘দিওয়ার’ (১৯৪৫), ‘পাঠান’ (১৯৪৭), ‘গদ্দার’ (১৯৪৮), ‘আহুতি’ (১৯৪৯), ‘কলাকার’ (১৯৫১), ‘প্যায়সা’ (১৯৫৩) এবং ‘কিসান’ (১৯৫৬)। পৃথ্বী থিয়েটারের নিজস্ব অভিনেতারা যেমন ছিলেন, তেমনই ছিলেন নাট্যকার, গায়ক, সঙ্গীতকার, সঙ্গীত রচয়িতা, শিল্প নির্দেশক সব ধরনের নাট্যকর্মী, যাঁদের যৌথ উদ্যোগে ভ্রাম্যমাণ এই নাট্যদল নাটক করে বেড়াত সারা দেশে। পৃথ্বীরাজের নিজের পরিবারের সদ্যসরাও ছিলেন। মুম্বই শহরের বিখ্যাত ‘রয়্যাল অপেরা হাউস’-এ মহড়া চলত। সেই সব দিনের সুখস্মৃতি লিখে রেখে গিয়েছেন অনেকেই। পৃথ্বী থিয়েটার থেকে দিকপাল কলাকুশলীরা পরবর্তী কালে মুম্বই ও চেন্নাইয়ের চলচ্চিত্র জগৎকে ঋদ্ধ করেছেন। যেমন রামানন্দ সাগর বা এল ভি প্রসাদরা। ভারতীয় নাট্য ইতিহাসে পৃথ্বী থিয়েটার এক উজ্জ্বল অধ্যায়।

নাটকগুলির মধ্য দিয়ে পৃথ্বীরাজ তাঁর প্রিয় বিষয় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ তুলে ধরেছিলেন। তিনি ছিলেন সমাজবাদী। আট বছর তিনি রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য ছিলেন। ১৯৫৪ সালে পান সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি ফেলোশিপ। ১৯৫৬ সালে পান সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার। ১৯৬৯ সালে তাঁকে পদ্মভূষণ দেওয়া হয়।

নাটক করতে করতে তাঁর কণ্ঠস্বর এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিল যে, এক সময় তাঁর পক্ষে নাটকে অভিনয় করা বন্ধ করে দিতে হয়। ২৯ মে ১৯৭২ তাঁর মৃত্যু হয়। ওই সালেই তাঁকে দাদাসাহেব ফালকে (মরণোত্তর) দেওয়া হয়। তিনি রেখে যান মুম্বই চলচ্চিত্র মহলে তাঁর বিশাল কপূর খানদানকে, যাঁরা আজও তাঁদের পাপাজি, পৃথ্বীরাজ কপূরের উত্তরাধিকারকে বহন করে চলেছেন।

অন্য বিষয়গুলি:

Kapoor Family
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy