শৈল্পিক: সোসাইটি অব কনটেম্পোরারি আর্টিস্ট আয়োজিত প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। —নিজস্ব চিত্র।
ছবি, ভাস্কর্য ও গ্রাফিক্স নিয়ে সম্প্রতি সোসাইটি অব কনটেম্পোরারি আর্টিস্টস গ্রুপের ৬৫তম প্রদর্শনী হয়ে গেল। দলের অন্যতম সদস্য প্রয়াত চিত্রশিল্পী বি আর পানেসরের নামাঙ্কিত গ্যালারিতে আয়োজিত হয়েছিল এই প্রদর্শনী।
১৯৬০ সালে বাংলার কিছু উদীয়মান শিল্পীর স্বাধীন সত্তার শাসনে গড়ে উঠেছিল সোসাইটি অব কনটেম্পোরারি আর্টিস্টস। উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী শ্যামল দত্ত রায়, সনৎ কর, অনিলবরণ সাহা, নিখিল বিশ্বাস, শৈলেন মিত্র, সুনীল দাস প্রমুখ। পরবর্তীতে আরও কিছু দিকপাল শিল্পী যুক্ত হয়েছিলেন। দলের প্রতিষ্ঠা দিবস প্রতি বছর উদ্যাপিত হয় বার্ষিক প্রদর্শনীর পরিকল্পনায়। এ বারেও একসঙ্গে দু’ভাগে আয়োজিত হয়েছিল সেই বার্ষিক প্রদর্শনী, কলকাতার পাশাপাশি বেঙ্গালুরুর ‘টাইম অ্যান্ড স্পেস’ গ্যালারিতেও।
মোট ১৭ জন শিল্পীকে নিয়ে এ বারের প্রদর্শনীটির নাম ছিল ‘সামার সং’। শিল্পীদের কাজের তালিকায় উঠে এসেছে বিমূর্ত দর্শনের শীর্ষে থাকা শিল্পী গণেশ হালুইয়ের ছবি। নীল-সাদার জলপথ ধরে মহানির্বাণের পথে যেন চলেছেন তিনি। বাস্তবিকই এই ধ্যানীর মননে অবিরত চলতে থাকে আভরণহীন, বর্ণহীন, জীবনের মূলস্রোতের খোঁজ। যেখানে বস্তুবাদ পরিবর্তিত হয় অতি সরল, অথচ গভীর প্রত্যয়ের কিছু সাঙ্কেতিক চিহ্ন নিয়ে।
সৌন্দর্য ও সম্পর্কের সংশ্লেষী চিন্তায় বার্ন্ট সায়নায় ব্রাশ ডুবিয়ে, অবয়বী রূপান্তরে আধুনিকতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ রেখেছেন প্রখ্যাত শিল্পী মনু পারেখ। ছাপাই ছবির নামী চিত্রশিল্পী অতীন বসাকের এচিং (‘ইনট্রোস্পেক্ট’) আত্মদর্শনের স্বীকারোক্তিতে উঠে আসে— ‘নিজেকে না শুধরালে, সমাজের শুদ্ধিকরণ হবে কোত্থেকে?’ ‘টোটাল মরালিটি’ থেকে সরে যাওয়ার অস্থিরতায় শিল্পীর বার্তা উপস্থাপিত হয় আলোর চমৎকার নিয়ন্ত্রণে, শৈল্পিক ব্যবচ্ছেদের মর্মকথায়।
চিত্রকর আদিত্য বসাকের ‘ভিক্টিম’ নিয়ে কাজ দু’টিতে ছিল জলরং ও ওয়াটারপ্রুফ ইঙ্কের অসাধারণ লেপন। নাটকীয় আলোছায়ার ঘেরাটোপে বিশেষ দৃশ্যকে বেছে নিয়ে তুলে ধরেছেন শিল্পী। নিদারুণ মনন সহযোগে, রূঢ় বাস্তবের আহত সময় তুলে ধরেছেন মধ্যবর্তী ফোকাসে। বিশিষ্ট ভাস্কর অখিলচন্দ্র দাসের ব্রোঞ্জ নির্মিত ‘দ্য গোট’ সরল আকারে ব্যঞ্জিত হলেও, লক্ষ করলে বোঝা যায়, পায়ের ভঙ্গিমা এবং ঘুরে তাকানোর দৃষ্টিতে সমসাময়িক অবস্থার ভাষা ফুটে উঠেছে।
আর এক অন্তর্ভেদী ছবির নাম ‘সলিটিউড’। চেতন ও অবচেতনের ক্রমাগত দ্বন্দ্বে আকার নেয় শিল্পী অতনু ভট্টাচার্যের এই ছবি। জমির কিছু কিছু জায়গা ভিজে অবস্থায় ছাড়ার পরে ফর্ম আপনাআপনি শেপ নিয়েছে গহ্বরের মতো। কোথাও কোথাও তুলির টান পড়েছে সহায়ক-ভূমিকায়। শিল্পী তাঁর এই সিরিজ়ের কাজগুলিতে, বিশেষত রঙের আশ্রয় ও অস্বচ্ছ স্বপ্নকে ধরতে যে ভাবে বিমূর্ত টেক্সচার এনেছেন, সেখানে মনে হতে পারে, হয়তো অবচেতন স্তরের খোঁজে, আত্মখননের এক অনন্ত পরিক্রমায় চলেছেন শিল্পী।
সুপরিচিত ভাস্কর বিমল কুণ্ডুর ‘হেরিটেজ’ ব্রোঞ্জের একটি মনোগ্রাহী ভাস্কর্য। ভারতীয় শৈলীর প্রতি পুরোপুরি অনুগামী না হয়ে তিনি স্বীয় অনুভবে গড়ে তুলেছেন এক ত্রিভঙ্গ গঠন। পাশাপাশি আশিস চৌধুরীর সেরামিকের (‘জাস্টিস’) প্রায়ান্ধকার রচনায় হাইকোর্টের পিছনে আলোর আভাস শিরোনামের দাবিতে মুখর হয়ে ওঠে। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের মতো এখানে ছিল পঙ্কজ পানওয়ারের অনামা একটি ব্রোঞ্জ-নির্মাণ।
সাহসী জলরঙের তরুণ চিত্রকর ভোলানাথ রুদ্রর নির্দিষ্ট স্থানচিত্রে, নিশিযাপনের ভয়াবহ রহস্য ভেদ করে, শীর্ণ ঘাসের আগলানো আলোয় শয্যাভূমি প্রাণ পায়। আর এক শিল্পী ডেভিড মালাকার মধ্যরাতের নীরবতাকে ধাপে ধাপে তুলে ধরেছেন সনাতন ধর্মের আখ্যানে। মোনোক্রমিক মোহময় রঙের আবেশ ধরতে শিল্পীর ব্যবহার্য উপাদান ছিল হ্যান্ডমেড পেপারের উপরে চারকোল, ক্রেয়ন আর অ্যাক্রিলিক প্রয়োগ।
ষাটের দশকের ভাস্কর নিরঞ্জন প্রধানের ফাইবার গ্লাস-নির্মিত ‘মাদার অ্যান্ড চাইল্ড’ কাঠামোর ক্লাসিক নিবেদনে দর্শক সহজেই শিল্পীমনের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে পারেন। জলরং নিয়েও যে অভীষ্টমূলক রূপের বর্ণনা দেওয়া যায়, তার খ্যাতি বহু পূর্বেই লাভ করেছেন শিল্পী প্রদীপ মৈত্র। এখানেও শিল্পীর নামহীন ছবিটিতে ‘জলরং’ শব্দটির চলতি ব্যবহার ছাপিয়ে যায় তাঁর ন্যূনতম রেখার হালকা ছোঁয়ায়। সেই রেখায় জরাজীর্ণ দালানকোঠা আবছা অথচ গভীর বিমূর্তায়নে নিয়ে যায় ছবিটিকে। শিল্পী রাজেন মণ্ডলের ‘দ্য থ্রাস্টি বার্ড’ নামাঙ্কিত এচিংয়ে অনিবার্য দু’টি ফর্মে উঠে এসেছে সামাজিক সঙ্কটের ছায়া।
প্রদর্শনীতে প্রবীণ চিত্রকর মনোজ মিত্রের মিশ্র প্রতিনিধিত্বের বলিষ্ঠ প্রকাশ ছিল ‘পাপেট’-এর সংবেদী কম্পোজ়িশন। টেম্পারার ধোঁয়াটে ফিনিশ এবং হালকা কিউবিজ়ম আঁচের আকৃতিতে অনুমান করা যায়, সৌমেন খামুরাইয়ের নস্টালজিক ভাবনার ইতিকথা। শিল্পী শ্রীকান্ত পালের ইকো প্রিন্টের বর্তুলাকার প্যাটার্নে দেখা যায় চরম সত্যের শিরা-উপশিরার অনুবন্ধ।
বাস্তবিকই এই প্রদর্শনীটিকে মৌলিক ভাবনার প্রকৃত ধারক বলে চিহ্নিত করা যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy