বিড়লা অ্যাকাডেমিতে সদ্য শেষ হল ‘সোসাইটি অব কনটেম্পোরারি আর্টিস্টস’-এর ৬২তম প্রদর্শনী। সেখানে চারজন প্রয়াত শিল্পীর কাজ পৃথক ভাবে ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’ নামে প্রদর্শিত হয়েছিল।
টেম্পারার কাজগুলিতে গণেশ হালুই যেন ফিরে গিয়েছিলেন ২০১১ ও ২০১৯-এ ‘আকার প্রকার’ গ্যালারিতে তাঁর একক প্রদর্শনীতে গোয়াশে নেপালি পেপার ও কাগজে করা কাজগুলির স্মৃতিতে। বর্ণ ও অন্যান্য অনুষঙ্গ, বিশেষত কিছু রূপারোপের অবস্থানগত স্টাইলাইজ়েশনে যেন সেই পেন্টিংগুলিরই দোসর এই কাজগুলি। এ বারের কম্পোজ়িশন যেন অন্যরকম নীরবতা ও বাঙ্ময় আবহে নস্ট্যালজিক। সনৎ করের টেম্পারায় চার দশকের বেশি আগের কাজগুলিতে বর্ণের আধিক্য, উজ্জ্বল বর্ণের পটভূমির আঁধার ও লাল রেখার টানটোন-সহ রচনা বড় অর্থবহ। লালুপ্রসাদ সাউয়ের ‘বাবু-বিবি’ রচনা-স্টাইলে একই রকম। মানু পারেখ ক্যানভাস বোর্ডে অ্যাক্রিলিকে ‘দেবী’-কে তিন রকম আধাবিমূর্ত রূপারোপে চমৎকার স্টাইলাইজ় করেছেন। মনোজ মিত্রর ছোট জলরংগুলির সংবেদনশীল উপস্থাপনা অসাধারণ। ছোটদের গল্পের সচিত্রকরণের মতো ভাবনায় পেন্টিংগুলিতে সেই রকম চিত্রগুণ রেখে, বাস্তবতার সঙ্গে পশুপাখি, জন্তু ও মানবের সম্পর্ক ও মুহূর্তগুলিকে অসাধারণ আবেদনময় করেছেন টেকনিকের দক্ষতায়। আদিত্য বসাকের ছবিতে একটা মেসেজ থাকে। ঐতিহাসিক স্মৃতির আলোড়ন ও মুহূর্তের সঙ্গে তাঁর নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলনে ব্রাউন-ইয়ালো-সিপিয়া-ব্ল্যাকে এক প্রত্ন-আবহে রাজনৈতিক মেসেজ, সমাজব্যবস্থা, যন্ত্রণা, মৃত্যু ইত্যাদির এক অমোঘ বার্তার অভিঘাত তাঁর পেন্টিংয়ে বারবার নানা প্রশ্ন তুলে দেয়। ১৬-১৭ বছর আগের কাজ। মনোজ দত্ত টেম্পারায় ছোট পোস্টারধর্মী টুকরো ফর্মে ‘খেলার খেলা’ করেছেন। বিভিন্ন মুখ সমতল বর্ণ, জ্যামিতিক ভারসাম্য রাখা রূপবন্ধের এক-একটি অংশ। কিছুটা শিশুসুলভ ভাবনা। বিমল কুণ্ডুর ব্রোঞ্জের ‘ডগ’, ‘হেড’-সহ প্রতিটি কাজই মনোমুগ্ধকর। আনকাট পেপারে ভার্টিকাল কাজ প্রদীপ মৈত্রর। পটভূমিতে পাতাকাঠের ভাঙা টুকরো ব্যবহার করে, তাতে সাদা সরু লাইন ড্রয়িং, অন্য কাঠের ছিন্ন অংশ পেস্ট করা, ইংরেজি-বাংলা বর্ণ, কাগজে হালকা জলরং, ব্রাউন পেপার সরু করে মুড়ে, তাকে দড়ির আকারে দু’টি কাগজের সঙ্গে সন্নিবদ্ধ করা। তালা, শেকল, কেটলি, ডেকচি, উনুন... বিমূর্ততা-আধা বিমূর্ততার অন্যতম উজ্জ্বল উদাহরণ এই জলরং ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সিরিজ়’। পঙ্কজ পানোয়ারের ব্রোঞ্জ, ফাইবার গ্লাসের ‘হাউসবোট’ বেশ। নিরঞ্জন প্রধানের ভাস্কর্যও চমৎকার।
অতীন বসাকের ‘মাইসেল্ফ’ সিরিজ়, অতনু ভট্টাচার্যের ‘আনটাইটেলড’, সৌমেন খামরুইয়ের জ্যামিতিক উপস্থাপনে স্থাপত্য-কাঠামোর সন্নিবেশিত অবস্থানে ক্যানভাসে টেম্পারা ‘আনটাইটেলড’ বেশ ভাল কাজ। ভোলা রুদ্র আহামরি নয়। ডেভিড মালাকারের চারকোল, প্যাস্টেল, ক্রেয়নে করা ‘গুডনাইট ক্যালকাটা’ গায়ে গায়ে ডিসপ্লে করাতে এক-একটি ছবির একক অস্তিত্বের বক্তব্য ও গভীরতা জটিল হয়েছে। স্পেস দরকার ছিল। তাঁর ‘লকডাউন সিরিজ়’টি যথেষ্ট প্রতিশ্রুতিময়। অখিলচন্দ্র দাশের ভাস্কর্য বরাবরই একটি দীর্ঘস্থায়ী রেশ রেখে যায়। এখানেও তার অন্যথা হয়নি।
কাগজে পেন-ইঙ্ক ও ব্রাশে সামান্য বর্ণের ব্যবহারে শ্রীকান্ত পাল ‘ফেয়ারি টেল’-এর সিরিজ় এঁকেছেন। নানা ঘটনা ঘটছে। এ সব ছবি কখনও হিয়েরোনিমাস বস, কখনও পিটার ব্রুগেলকে মনে পড়ায়। সেই সঙ্গে ‘ঠাকুমার ঝুলি’র নীল এনগ্রেভিংয়ের সচিত্রকরণকেও। যদিও নিজস্ব একটি স্টাইল অচিরেই তৈরি হয়ে গিয়েছে। একসময় পেন্টিং থেকে গ্রাফিক্স প্রিন্টমেকিংয়ে শ্রীকান্তর দীর্ঘ জার্নির ধারাবাহিকতা তাঁর নানা সময়ের আবহকে মাধ্যম ও কাজের নিরীক্ষামূলক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে নিয়ে গিয়েছে। এই সময়গুলিতে শিল্পী তাঁর কাজের কম্পোজ়িশন থেকে শুরু করে স্টাইল, টেকনিক, ফর্ম, ন্যারেশন নিয়েও ভাবছিলেন। বর্তমান কাজগুলি সে সবের অসামান্য প্রতিফলন। ড্রয়িং, সূক্ষ্মতা, অদ্ভুতত্ব, বৈচিত্রের কল্পনা, উদ্ভট দৃশ্য...এ সবের মধ্যেই লুকিয়ে আছে নানা সোশ্যাল-পলিটিক্যাল মেসেজ, যা গভীর অর্থবহ।
ভাবনায়, ট্রিটমেন্টে, স্টাইলে, কম্পোজ়িশনে, বর্ণের আকাশ-পাতাল তফাতে আর একরকম সোশ্যাল-পলিটিক্যাল মেসেজ দিয়েছেন রাজেন মণ্ডল, তাঁর ছোট দশটি এচিংয়ের কাজে। ‘ভয়েস অব ডেমোক্রেসি’ সিরিজ়ে গণতন্ত্রের এক-একটি দিক অত্যন্ত সঙ্কেতময় উপস্থাপনে ব্ল্যাক ও সেরুলিন ব্লু-তে প্রিন্টগুলি নিয়েছেন। গণতন্ত্রের এ কোন ভয়েস? এক ধরনের আর্তনাদ যা অপেক্ষাকৃত নীরব, যন্ত্রণা ও মৃত্যুর একরকম জার্নি। তক্ষণপাতের পটভূমি শৈলীগত অ্যাকোয়াটিন্টের বিবিধ দক্ষতায় ক্ষতচিহ্নের আবহ তৈরি করে। নরকরোটি, মাউথপিস, কাঁকড়া বিছে, অদ্ভুত যান ও মানুষ, বিষাক্ত কীট, কামান, দাঁতের নীচের পাটি-সহ অর্ধেক স্কাল, বিশ্রামরত ঘুমন্ত মানুষ, পোকামাকড়ের মৃত শরীর ইত্যাদির রূপারোপে প্রতিটি কাজই এক-একটি বার্তা, যা সহজেই গেঁথে যায় মনে। রাজেনের ট্রিটমেন্ট ও এচিং প্লেটটির নির্মাণপর্ব অত্যন্ত গভীর। কাজ হিসেবে এই ‘ভয়েস অব ডেমোক্রেসি’ সিরিজ়টি বহু দিন মনে থাকবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy