বাঙ্ময়: রেবা হোরের একক প্রদর্শনী ‘লাইট অব স্প্রিং’।
মানুষকে নিয়ে তাঁর এই অন্বেষণের গহন আলো-আঁধারের বিস্ময় যেমন কোলাহলমুখর, কখনও বড্ড নির্জনও। একাকী মানুষ বা একগুচ্ছ, সবেতেই তিনি দ্বিমাত্রিক পটের রং-রেখায় নিজেকে বিপুল ভাবে উজাড় করেছেন। মানুষের সমাজজীবনের প্রেক্ষাপটের যাবতীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব থেকে উচ্ছ্বাস, বিষাদগ্রস্ততা থেকে কর্মোদ্যোগী জীবন, দৈনন্দিন বাস্তবতা থেকে উদ্যমী প্রয়াস, এ সব কিছুই তাঁর শিল্পীমনের এক গভীরতর পর্যবেক্ষণ। তিনি রেবা হোর। সম্প্রতি দেবভাষা গ্যালারিতে শেষ হল তাঁর বিভিন্ন মাধ্যমের ড্রয়িং, পেন্টিং ও টেরাকোটার একক প্রদর্শনী ‘লাইট অব স্প্রিং’।
ব্রাশেই হোক বা প্যাস্টেলে, তাঁর ঝোড়ো গতির টানটোন, অজস্র রেখার আঁকিবুকির মধ্যে চোখ খুঁজে চলে, ঠিক কোন জায়গাটি থেকে ওই শরীরী অবয়বের গঠনটিকে তিনি আঁকতে শুরু করেছিলেন? আর আশ্চর্য যে, মূল অংশটি খুঁজেও পাওয়া যায়। কারণ, ওই সব লাইনের পার্শ্ব বা মধ্যবর্তী অংশে অতি যত্নে যেন বর্ণ-বিচ্ছুরণের একটি সঙ্কেত রেখে, তিনি দ্রুত চলে যান পটভূমির অন্যান্য স্থানে। সেখানে ড্রয়িংকে ছড়িয়ে দেন স্পেসকে আপাত-অক্ষত রেখে, আশ্চর্য এক আলোর সূক্ষ্মতা থেকে আরও বেশি আলোর দ্যুতিকে জাগ্রত করে। এই যে তাঁর কম্পোজ়িশনের স্টাইল-টেকনিক, সেখানেই চোখ ঘুরে চলে সমস্ত জায়গায়। কখনও মনে হয় না, কোথাও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল রেখা, ড্রয়িং বা বর্ণকেও। আবার অতিকথনও নয়, যেন ওখানেই শেষ করার কথা ছিল।
তাঁর ছবি জমাট সংগঠনের কথা বলে। কিছু কাজ আবার মনে হবে খুব স্কেচি, আসলে সেখানে ওই টানটোনের দ্রুততার স্টাইলই কাজটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ ছবিতে রূপান্তরিত করেছে। মেলবন্ধন ঘটেছে ড্রয়িং ও টেকনিকের। একাকিত্বের রচনাতেও বর্ণের হৃৎপিণ্ড ভেদ করা রেখার বল্লম বা রেখার ঝড়ের শরীরে নির্বিঘ্নে ঢুকে যাওয়া বর্ণের ব্রহ্মাস্ত্রে ছবিতে অচিরেই ঘটে যায় তুলকালাম। কিন্তু আশ্চর্য, একই সঙ্গে অতি সংহত এক সামগ্রিক চেহারায় তা হয়ে ওঠে এক নীরব চিত্রনাট্য। বহু ছবিতে কিন্তু বর্ণ ও রেখার বিস্ফোরণে এক নীরব আর্তনাদ বেজে ওঠে। এই স্টাইলাইজ়েশন তাঁকে ওই একই ছবিতে কখনও এক নীরবতার প্রেক্ষাপট তৈরি করতে সাহায্য করেছে। পাশাপাশি এমন সংযত আবার বর্ণ ও রেখার দ্বৈত ঝোড়ো বিচ্ছুরণও ওই ছবিকেই পরিয়েছে মহার্ঘ অলঙ্কার।
অবয়বী ছবিতে যখন গড়নের মূল ড্রয়িংকে রেখেও তাকে ভাঙছেন, অন্য রূপ বা অনুষঙ্গের সঙ্গে অদ্ভুত ভাবে মিশিয়ে দিচ্ছেন, সেখানেও ওই রেখার নির্দিষ্ট প্যাটার্নগুলি চরিত্রের সঙ্গে যেন গভীর সংলাপে ওতপ্রোত। আসলে প্যাস্টেলের ইচ্ছাকৃত ভীষণ স্বাধীন এই রেখাসমূহের আন্দোলন যেন একই সঙ্গে স্বেচ্ছাচারী ও সংগঠিত একটি সুদৃঢ়, জমাট অথচ সুরম্য এক বাঁধুনির ইঙ্গিতই দেয়। তিনি একই সঙ্গে এই দ্বৈত সংলাপ বারবার তৈরি করেছেন। রেখাপ্রধান ছবিতে বর্ণের উচ্ছ্বাস কখনও রেখাকেও অস্বীকার করছে। বিপরীতে বর্ণের বিপুল বিস্ময়ের মধ্যে আচম্বিতে প্রবেশ করে রেখার ভয়ঙ্কর চঞ্চলতা বর্ণকেই নস্যাৎ করে দিচ্ছে। এই প্রতিযোগিতা তিনি অত্যন্ত সচেতনেই তাঁর ছবিতে চেয়েছিলেন। দুইয়ের দ্বন্দ্ব ও অন্তরঙ্গতা, তুফান ও তন্ময়তা, বিন্যাস ও বৈচিত্র, প্যাটার্ন ও প্যাশন, আলাপচারিতা ও মনোমালিন্য, সংগঠন ও সঙ্কটকে তিনি অধিকাংশ কাজেই নাটকীয় রূপ দিয়েছেন। এক ছন্দহীন ছন্দ তৈরি করে, তাদের ছিঁড়ে ফের নতুন রূপে বুনেছেন কৌশলী অথচ কৌতূহলোদ্দীপক এক অত্যাশ্চর্য চিত্ররূপ। যেন সুচের রেখায় বর্ণের সুতো প্রাণ পেয়েছে, অথবা রঙের সুতোই সুচের লাইনকে দিয়েছে আসন পেতে।
তাঁর টেরাকোটার ছোট্ট ভাস্কর্যগুলি প্রত্নরূপে মত্ত হয়ে থাকা এক-একটি প্রাচীন ফর্মের রিয়্যালিজ়ম থেকে ফসিল হয়ে যাওয়া কোনও রূপের কথা বলে। কোথাও ডিটেলের সঙ্কেত দিয়ে হঠাৎ সরে গিয়েছেন অদ্ভুত এক বিমূর্ততায়। ফর্মের রিয়্যালিজ়মকে সেখানে ভেঙে, গড়েছেন আরও এক গভীর ফর্মের অনিশ্চিত রূপকে। এই বিবর্তিত বিশ্লেষে উচ্চাবচের জ্যামিতি এক অনন্য নির্মাণকে অনুভূত করায়। যা বিমূর্তায়নের মধ্য দিয়ে কখনও বিস্ফারিত হয়েও সেই রূপ এক নির্দিষ্টতার দিকে চলে যেতে চাইছে। সে মনুষ্যমুখ বা পশু যা-ই হোক। কোনওটিই পৌত্তলিকতার কথা বলে না।
কাগজে মিশ্র মাধ্যম বা কাগজে অয়েল বা ক্যানভাস সবেতেই মুহূর্তটিকে প্রখর রেখেও, বর্ণের ঘষামাজা ও রেখার সাবলীলতা, দ্রুততম টানগুলি যেন প্রতিটি ছবিকেই কথা বলাচ্ছে। এ আধুনিকতা তাঁর নিজস্ব। তবে তাঁর নিরলস সাধনার মধ্যেই কিন্তু দুর্লভ প্রাপ্তির অভিজ্ঞতার মতো রসোপলব্ধি দিব্য অভিজ্ঞতাই পেয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy