সম্মিলিত: সোসাইটি অব কনটেম্পোরারি আর্টিস্টস আয়োজিত প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম
বিড়লা অ্যাকাডেমিতে সম্প্রতি কলকাতার অন্যতম প্রাচীন শিল্পীদল সোসাইটি অব কনটেম্পোরারি আর্টিস্ট-এর ৬৪তম প্রদর্শনী হয়ে গেল। ব্যক্তিগত সৃজনশীলতা নিয়ে এই শিল্পীরা একত্রিত হয়েছিলেন। সোসাইটি তৈরি হয়েছিল ১৯৬০ সালে। প্রতি বছর একটি করে বার্ষিক প্রদর্শনী উপস্থাপন করতে শুরু করলেন তাঁরা। এত বছরে বহু শিল্পী দল ছেড়েছেন, আবার নবীন শিল্পীরা এসে এই দলকে আরও শক্তিশালী করেছেন।
এ বারের প্রদর্শনীতে যে সব শিল্পীর কাজ দর্শক দেখতে পেলেন, তাঁরা হলেন আদিত্য বসাক, অখিলচন্দ্র দাস, অতনু ভট্টাচার্য, অতীন বসাক, বিমল কুণ্ডু, ভোলানাথ রুদ্র, ডেভিড মালাকার, গণেশ হালুই, লালুপ্রসাদ সাউ, মনোজ মিত্র, মানু পারেখ, নিরঞ্জন প্রধান, পঙ্কজ পানোয়ার, প্রদীপ মৈত্র, রাজেন মণ্ডল, সোমেন খামরুই এবং শ্রীকান্ত পাল।
আদিত্য বসাক এই দলের সঙ্গে অনেক দিন ধরে আছেন। সরকারি আর্ট কলেজের এই প্রাক্তনী ছবিতে বাস্তবতার সঙ্গে কিছুটা কল্পনার জগৎকে মিশিয়ে সুন্দর একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন। সীমিত রঙের প্যালেটে কাজ করেন, যেখানে উজ্জ্বল রং প্রায় দেখা যায় না। সাধারণত নেপালি হ্যান্ডমেড কাগজের উপরে আর্থ কালার, ওয়াটারপ্রুফ কালি এবং ক্রেয়নে, অনেক সময়েই মিশ্র মাধ্যমে ছবি আঁকেন। এখানে দেখা গেল তিনটি কাজ, ক্যানভাসের উপরে, মিশ্রমাধ্যমে করা। ছবিগুলির নাম ‘অ্যাপ্রোচিং দ্য আননোন টেরিটরি’— এক, দুই এবং তিন। অবচেতন মন থেকে বেরোনো পরাবস্তুবাদী সাররিয়্যাল সিরিজ়। প্রতীকের ব্যবহারে আদিত্য বসাক দক্ষ। তাঁর ওই ছবি তিনটি খুবই মনোগ্রাহী।
বিমল কুণ্ডু সরকারি আর্ট কলেজের প্রাক্তন ছাত্র। তিনি একজন ভাস্কর। বহু মাধ্যমে কাজ করলেও তাঁর প্রিয় মাধ্যম কাঠ এবং ধাতু। এই প্রদর্শনীতে তাঁর যে সব কাজ দেখা গেল, সেগুলো পিতলের প্লেটের উপরে চারটি মুখ। শিল্পকে তিনি সমতল ভূমি, বাঁকা রেখা, আলো, কালো এই সমস্ত কিছু ছাড়িয়ে একটা সম্পূর্ণতায় দেখাতে চান। চূড়ান্ত ফলাফলটি তাঁর লক্ষ্য। চারটি মুখ ছাড়াও অপর একটি কাজের নাম বাপুজী। পিতলের ফলকের উপরে মা কালীর মুখশ্রী এঁকেছেন। সম্পূর্ণ অন্য, অনবদ্য এক আঙ্গিকে। লালুপ্রসাদ সাউ বহু বছর ধরে এই দলের সঙ্গে আছেন। এখানেও তাঁর স্বাক্ষরবাহী দু’টি ছবি দেখা গেল— ‘বাবু’ এবং ‘বিবি’। যে দ্বিমাত্রিক সরলীকরণ তিনি সম্পূর্ণ ভাবে আয়ত্ত করেছেন, সেই ভাবেই করা এই দু’টি কাজ। ফ্ল্যাট রঙের দু’টি পার্শ্বমুখ, প্রেক্ষাপটও ফ্ল্যাট রঙে করা এবং বিংশ শতকের
উত্তর কলকাতার বনেদি ঘরের ‘বাবু এবং বিবি’ চরিত্র অল্প কথায় বলেছেন।
দলের বর্ষীয়ান সদস্য গণেশ হালুইয়ের ছবিও দেখা গেল প্রদর্শনীতে। তিনটি ছবি। কাগজের উপর গোয়াশের কাজ। তিনটিই শিরোনামহীন। গণেশ হালুই আপাতগ্রাহ্য জগত থেকে নানা উপাদান নিয়ে মনের রন্ধনশালায় তাকে পরিবর্তন এবং পরিবর্ধন করে যেটা মানুষকে উপহার দেন, প্রায় রূপকথার মতো। তাঁর দ্বিমাত্রিক সমতলের ছবিগুলো শুধুমাত্র প্যাটার্নেই নির্ভেজাল আনন্দদায়ী। এর মধ্যে ‘আনটাইটেলড ১’ ছবিটি বড় সুন্দর।
মনোজ মিত্রর ছবিতে সাধারণত মানুষকেই প্রধান পাত্র হিসেবে দেখা যায়। কিন্তু এখানে আটটি মিশ্র মাধ্যমে করা ছবি দেখা গেল। আটটি ছবিই করা হয়েছে কালো কাগজে। এই কাজগুলিতে মানুষ, পশুপাখি, নিসর্গ সব কিছুই ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। সবই স্বপ্নময়তায় মোড়া। খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপিত হলেও ভিতরে ব্যথা, অসহায়তা, প্রকৃতির উপরে মানুষের অত্যাচার, একাকিত্বের বেদনা প্রকাশ পায়। ছবির রঙে হালকা নীল এবং ছাই রঙের প্রাধান্য।
শিল্পপ্রেমীরা জানেন, ভাস্কর নিরঞ্জন প্রধানের কাজে ফর্ম বা আঙ্গিক আপাত দৃষ্টিতে বাস্তবধর্মী হলেও শিল্পী তার ভিতরে প্রাণ সঞ্চার করতে পারেন। বিষয়বস্তুর উপরে নির্ভর করে তিনি মাধ্যম পছন্দ করে থাকেন। কাঠ, ব্রোঞ্জ কিংবা মার্বেল। এখানে দর্শক দেখতে পেলেন ব্রোঞ্জে করা ‘মাদার অ্যান্ড চাইল্ড’। মায়ের কোলে শিশু কিন্তু মায়ের অবয়ব অতিরিক্ত সম্প্রসারিত বা ইলঙ্গেটেড। তিনি হয়তো বলতে চেয়েছেন যে, তাঁর কোলের শিশুর কাছ থেকে আজ তিনি অনেক দূরে।
সোসাইটির পুরনো সদস্য মানু পারেখের দু’টি ছবি দর্শক দেখতে পেলেন। মানু পারেখ মুম্বইয়ের স্যর জে জে স্কুল অব আর্টসের প্রাক্তনী। এখানে ক্যানভাস বোর্ডের উপরে তেলরঙের দু’টি অসামান্য কাজ দেখা গেল তাঁর। একটি ‘ফ্লাওয়ারভাস উইথ আ ডিফারেন্স’। খুব সুন্দর নীল রঙের প্রেক্ষাপটে ফুলদানির ছবিতে ফুল বা পাতা থাকলেও ভিতরে আছে অন্য কথা। আছে প্রকৃতির অন্যান্য প্রাণিজগতের সঙ্গে গলাগলি। কবিত্বময় সুরেলা ছবি।
সৌমেন খামরুই এখানে একটি ছবি বড় ক্যানভাসে টেম্পেরায় এঁকেছেন এবং অপর ছবিটি বোর্ডের উপর টেম্পেরায় করেছেন। অপেক্ষাকৃত ভাবে ছোট ছবিটি বেশি চোখ টানে। টেম্পেরায় তাঁর দক্ষতা এবং তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় লক্ষণীয়। শুধু জ্যামিতিক ডিজ়াইনের মাধ্যমে এত কিছু বলার জন্যও ক্ষমতার প্রয়োজন। তা-ও আবার টেম্পেরায়। এই মাধ্যমে ছবি আঁকার জন্য শিল্পীদের নিজেদেরই অনেকাংশে রং তৈরি করে নিতে হয়। জ্যামিতির নানা আকারের বিমূর্তকরণ করে, দ্বিমাত্রিক সমতল ভাবে রং লাগিয়ে, তাকে সম্পূর্ণ অন্য এক রূপদান করেছেন সৌমেন খামরুই।
এ ছাড়া বাকি শিল্পীরা সকলেই প্রশংসার দাবিদার। এঁরা সকলেই শহরের অন্যতম প্রাচীন শিল্পীগোষ্ঠীর যোগ্য উত্তরসূরি, যার ছাপ দেখতে পাওয়া গেল তাঁদের সাম্প্রতিক প্রদর্শনীতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy