Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Review

অনবদ্য শিল্পিত ভাষায় বিশেষ সময়ের দাবি

ছবিতে চাঁদের ভূমিকা যেমন, তেমনই দেখা যায় অগণিত আলোর ফুটকির সংশ্লেষ। মনে হয়, মশাল হাতে কিছু মানুষের উপস্থিতি, যারা জোনাকির মতো রাত্রিযাপন করে।

পিয়ালী গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০২৪ ০৯:১৬
Share: Save:

সম্প্রতি ইমামি আর্ট গ্যালারিতে তিনটি ভাগে দেখা গেল প্রতিশ্রুতিমান তিন তরুণ শিল্পীর একক প্রদর্শনী। সমসাময়িক এই শিল্পীরা হলেন যথাক্রমে ভোলানাথ রুদ্র, আলি আকবর পিএন এবং উজ্জ্বল দে।

প্রথম প্রদর্শকক্ষে পা রাখতেই চোখে পড়ে দেওয়ালে সাঁটা কবি জীবনানন্দ দাশের তিনটি স্তবকের একটি কবিতা— “এখানে বনের আলোয় ক্যাম্প আমি ফেলিয়াছি...” কবিতাটি কিছুটা মুখপত্র হয়েই প্রবেশ করেছে শিল্পী ভোলানাথ রুদ্রর নির্দিষ্ট সময়ের ছবিগুলিতে। ‘পেনসিভ মুনস’ বা বিষণ্ণ চাঁদের সাম্প্রতিক দশটি কাজে রয়েছে শিল্পীর গভীর উপলব্ধির প্রকাশ। আলো-আঁধারি মায়ার জগৎ দেখাতে চাঁদকে প্রতিরূপ ধরে এগিয়েছেন তিনি। রাতের অন্ধকারে বনে-জঙ্গলে মানুষের লালসা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে! চাক্ষুষ দেখার সাক্ষী হিসেবে রুদ্র এঁকেছেন একের পর এক নিধনের ছবি। হাতি শিকার (টাগ) এবং একটি মাত্র হরিণের কাজ ছাড়া রয়েছে চাকা লাগানো নৌকা (গোল্ডেন বোট)। ছবিগুলি বস্তুনিষ্ঠ হয়েও, শিল্পীর নিজস্ব কল্পিত ভাবনায় সম্পৃক্ত হয়ে, বিপরীত দিকের কথাও বলে।

ছবিতে চাঁদের ভূমিকা যেমন, তেমনই দেখা যায় অগণিত আলোর ফুটকির সংশ্লেষ। মনে হয়, মশাল হাতে কিছু মানুষের উপস্থিতি, যারা জোনাকির মতো রাত্রিযাপন করে। নিজেদের মতো করে তারা অগ্রগতির পথে চলে। কিছু কাজে লক্ষ করা যায় অর্ধাকৃতি বঙ্কিম ফর্ম। যেমন বালিয়াড়ির মধ্যে অর্ধচন্দ্র, হাতির দাঁত বেঁকে গিয়েছে, নৌকাটিও বেঁকে আছে। রাত্রি, যেমন সব ছবিকে বেঁধে রেখেছে, এই বাঁকা ভঙ্গিমাটিও শিল্পীর চিন্তাগুলিকে রূপকের আশ্রয়ে আগলে রেখেছে। জলরঙের অনিশ্চয়তার পদ্ধতিতে এ রকম ভাবনাকে তুলে ধরা সহজ কাজ নয়। বিশেষত বিষয়ের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে একের পর এক রঙের ওয়াশে গাঢ় বাদামি টোনাল রচনায় শিল্পী যে যথেষ্ট পোক্ত, তা প্রমাণ করে তাঁর দীর্ঘ দিনের নিরলস চর্চা।

ছবি জুড়ে ভয়, রোমাঞ্চ ফুটে ওঠার পিছনে আছে শিল্পী ভোলানাথ রুদ্রর অনিশ্চিত বাসের সংগ্রাম। তিনি ভর্তি হয়েছিলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছবির উপকরণ কেনার সামর্থ্যের অভাবে জলরংকে বেছে নিয়েছিলেন। জলরঙের অনুশীলনে যে কোমল মাধুর্য, তা পুরোপুরি আয়ত্তে এনেছেন শিল্পী। ড্রয়িং, পরিপ্রেক্ষিত ও মাত্র তিনটি রঙের টোনে মানুষের নিষ্ঠুরতা ছাপিয়ে শিল্পীর মূল ভাষা হয়ে উঠেছে সহানুভূতির বিশ্লেষণে সচেতনতার বার্তা।

দ্বিতীয় আয়তাকার কক্ষে দেখা গেল আর এক স্বতন্ত্র শিল্পী মধ্য কেরলের আলি আকবর পি এন-এর কাজ। সিরিজ়ের নাম— ‘দ্য সল্টস অব মেনি সিজ়’। অ্যাক্রিলিকে শিল্পী প্রধানত কাজ করেছেন মেমোরি, মিথ, হেরিটেজের ঐতিহ্য নিয়ে। মিউজ়িয়ামের মতোই পরপর সম্বলিত সৃষ্টিগুলি সংরক্ষণাগারের ন্যায্যতা দেয়। সময়কে ধরে রাখার চরম আগ্রহে প্রাচীন সভ্যতার ব্যবহৃত উপকরণ, ঘোড়া, মানুষ, স্থাপত্যকে ডিটেলে ধরার চেষ্টায় শিল্পী বেশ সফল। বিশেষত বিরল রঙের ব্যবহারে শিল্পীর প্রতিভাকে অস্বীকার করা যায় না। বিভিন্ন সিরিজ় অনুযায়ী সাজানোর মধ্যে রয়েছে বই, ভাস্কর্য, মানচিত্র, ডিজিটাল প্রিন্টস, ড্রয়িং, পুরনো সামগ্রী, পেন্টিং, ফোটোগ্রাফ ও একটি চলমান ভিডিয়ো।

উচ্চশিক্ষার সুযোগে বরোদায় স্থানান্তরিত হলে, আলির কাজে বিরাট পরিবর্তন আসে। কেরলের উপকূলীয় নৈতিকতার মধ্যে নিহিত সমুদ্র তাঁর কাছে শুধুমাত্র ভৌগোলিক সত্তা নয়, চূড়ান্ত ভাবে বহুমুখী ভূমিকার দিগন্ত। এখানে রচিত মানুষ, পশু এবং স্থাপত্য, ইতিহাসের ধারাবাহিকতাকে নির্দেশ দেয়। বিভিন্ন প্রেক্ষিতে নাটকীয় চিত্রায়ণে তা মুখোমুখি প্রতিফলিত হয়। প্রায় বিবর্ণ, অরৈখিক বর্ণনা এবং আপাতদৃষ্টিতে ক্ষয়িষ্ণু পৃষ্ঠতলের ঐতিহাসিক ইমারত প্রতিষ্ঠায়, শিল্পীর আখ্যানগুলি শক্তিশালী হওয়ার অভিপ্রায়ে, পিছিয়ে পড়া সামাজিক গঠনকে বাতিল করার কথা বলে।

প্রদর্শনীর তৃতীয় শিল্পী শান্তিনিকেতন কলাভবনের প্রাক্তনী ঝাড়খণ্ডের উজ্জ্বল দে। টেক্সটাইল ও কাগজ নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা ও শিল্পীর কর্মপদ্ধতি রীতিমতো চমক সৃষ্টি করে। প্রতিরোধী রঞ্জক কৌশলে ‘ডন টু ডাস্ক, আ সাইলেন্ট সিম্ফনি’ শিরোনামে নিত্য ব্যবহৃত জিনিসপত্রকে তিনি তুলে ধরার চেষ্টা চালিয়েছেন। অতীতের গৃহস্থালির বর্ণনায় যে পরিমাণ ভালবাসা এবং পরিশ্রম দেখা যায়, তাতে নির্দ্বিধায় বলা যায়, এই শিল্পীর বিকল্প পাওয়া কঠিন। প্রদর্শিত সামগ্রী ছাড়া, কোণে রাখা একটি ছোট ট্যাবে নীরবে দৃশ্যায়িত হয়ে চলেছে উজ্জ্বল দে-র রচনার পুরো কার্যপ্রণালী। তাকের উপরে সাজানো রয়েছে মৌলিক প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের ভাণ্ডার, যেগুলি শিল্পী প্রয়োজন মতো নিজস্ব পদ্ধতিতে গড়ে তোলেন। যেমন পেঁয়াজপাতা, মঞ্জিষ্ঠা— জলে ফুটিয়ে রং বার করা। বেলের আঠা, হরিতকী, আমলকী, খয়ের, খড়িমাটি, চুন, হলুদ, অপরাজিতা ফুল ইত্যাদি। সুতির কাপড়ের বেসিক সাধারণত হরিতকী দিয়ে ডাই করে নেন। এতে হালকা হলুদ ভাব আসে। বাটিকের ইম্প্রেশন কিছু কাজে দেখা যায়। সবচেয়ে বড় কথা, প্রতিটি ফর্ম, দাগ, গোলাকার ছাপ যে বিমূর্ত আঙ্গিকে পরিবেশিত হয়েছে, তা আধুনিকীকরণের প্রকৃষ্ট উদাহরণ বলা যায়।

সাধারণত রান্নায় যে সব জিনিসপত্র লাগে, যেমন বঁটি, নারকেল কুরুনি, লোহার ফলা ইত্যাদির ছাপ তোলা হয়েছে। একটি ছবির কথা না উল্লেখ করলেই নয়। মাছ কাটার পরে এলোমেলো ভাবে যে রক্ত ও আঁশ ছড়িয়ে থাকে, তার গোলাকার চিহ্ন দেখা যায় ঝুলন্ত টেক্সটাইলে। নকশিকাঁথা, সূচিশিল্প, গ্রামীণ শিল্পের নির্যাসটুকু নিয়ে তাঁর ছবিতে ফুটে উঠেছে হস্তশিল্পের নিপুণতা। ‘মাদার অ্যান্ড চাইল্ড’-এর সিরিজ়টি এই রকম— এ দেশীয় গ্রামের বাড়িতে যখন মা ষষ্ঠীর পুজো হয়, তখন প্রথম পূজিত হয় রান্নাঘরের বাটনা বাটার শিল। শিশুদের রক্ষার্থে মহিলারা এটি পালন করেন। শিল্পী এই প্রতীক কাজে লাগিয়ে মুদ্রণ রীতিতে স্থানীয় ঐতিহ্যের পরম্পরাকে জিইয়ে রাখতে একের পর এক বুনন করে গিয়েছেন। রান্নাঘরের সীমানায় নারীর নেতৃত্বাধীন উপস্থিতির নিঃশব্দ সিম্ফনি উন্মোচন করতে প্রস্তুত শিল্পী উজ্জ্বল দে। ভারতের টেক্সটাইল ইতিহাসের উপরে বিস্তৃত গবেষণা ও নিজস্ব উপায়ে সংযুক্তিকরণের পথ খুঁজে চলেছেন তিনি। ছট পুজোকে কেন্দ্র করে, সূর্যদেবতার উপরে আলোকপাতের ভঙ্গি ও বৃহৎ ঝুলন্ত কাপড়ে ঠেকুয়া ছাঁচের নৈবেদ্য ছিল অবাক করার মতো শিল্পকর্ম। ধর্মীয় সংস্কার এবং বিভিন্ন অভিজ্ঞতা মিশ্রিত ব্যক্তিগত আত্মদর্শন অনুরণিত হয়েছে তাঁর প্রতিটি সূক্ষ্ম অনুভূতির কাজে।

প্রদর্শনীর কাজগুলি আন্তরিক দায়িত্বের সঙ্গে বোঝাতে যে কিউরেটররা ছিলেন, তাঁরা হলেন ক্রমান্বয়ে অর্কপ্রভ বসু, সায়ান্থ আর এস এবং চৈতি নাথ। বস্তুত এই প্রদর্শনীর প্রতিটি কাজই স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্যতা রাখে।

অন্য বিষয়গুলি:

Art exhibition Emami Art
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy