Advertisement
১৩ নভেম্বর ২০২৪
Art Gallery

বহু ক্ষেত্রেই কাঠিন্যের বহিঃপ্রকাশ, বর্ণ-ছন্দ-বিন্যাস-বৈচিত্রে

‘রিদম অব কালারস’ নামে একটি ছোট প্রদর্শনীর প্রায় কুড়ি-বাইশটি কাজ দেখতে দেখতে কোথায় যেন ব্যানার পেন্টিংয়ের তথাকথিত স্টাইলের কিছু মুহূর্ত ভেসে উঠছিল।

অতনু বসু
শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০২২ ০৭:৩১
Share: Save:

ভারতীয় ব্যানার চিত্রকলারও একটা ইতিহাস আছে। বহু ঐতিহাসিক ঘটনার প্রেক্ষাপটকে শিল্পীরা যত্নে সূক্ষ্মতায় রাঙিয়েছিলেন। সে প্রতিকৃতিই হোক বা ইতিহাসের কোনও ঘটনা। এমনকি স্থাপত্য, বিশিষ্ট সব ব্যক্তিত্ব, পুরাণের চরিত্র বা ঘটনা, ভিত্তিচিত্রের কপি, মন্দির-মসজিদ থেকে নিসর্গ ও অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত নাম-না-জানা সব চিত্রকরের পরিচিত ছবির নকলও দেখা যেত। এ সব কাজে বর্ণকে তাঁরা ব্যবহার করেছেন নানা আঙ্গিকে। কুশলী তুলির টান ও একটা টেকনিক বা স্টাইল লক্ষ করা যায়। যদিও সচিত্রকরণের ছায়াও ছিল অনেক কাজে। আজকাল প্রদর্শনীতেও কিছু কিছু ছবি দেখলে ব্যানার পেন্টিংয়ের কথা মনে পড়ে। এক সময়ে নতুন চলচ্চিত্র (বাংলা, হিন্দি বা অন্য ভাষায়) কোনও প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেলে বিশালকায় ব্যানার চিত্রে সে ছবির নায়ক-নায়িকা-সহ অন্যান্য কিছু দৃশ্য আঁকা হত। মোটা রং চাপিয়ে সে ছিল এক ধরনের স্টাইল। অয়েল পেন্টিং নয়, আঠা মেশানো গুঁড়ো রং এবং এনামেল রঙেও আঁকা হত ব্যানার। আজও হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যানার পেন্টিং ব্যবহার করা হয় বহু ছবিতেই। বাংলা চলচ্চিত্রে তুলনায় কম। তবে ব্যাকগ্রাউন্ডের সে সব পেন্টিং বাস্তবের দৃশ্যরূপের সঙ্গে ফোরগ্রাউন্ড, সমগ্র স্থাপত্য ও অন্যান্য জায়গার সঙ্গে মিল রেখেই করা হত, এখনও যা বিদ্যমান।

‘রিদম অব কালারস’ নামে একটি ছোট প্রদর্শনীর প্রায় কুড়ি-বাইশটি কাজ দেখতে দেখতে কোথায় যেন ব্যানার পেন্টিংয়ের তথাকথিত স্টাইলের কিছু মুহূর্ত ভেসে উঠছিল। শিল্পী অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকের অধিকাংশ কাজগুলি কিন্তু ওই সব ব্যানার পেন্টিংয়ের স্টাইল, টেকনিক, ব্রাশিংয়ের অনুসরণে নয়। তাঁর কাজগুলি লক্ষ করলে ওই সামগ্রিকতার একটি ফ্লেভার পাওয়া যায়। কয়েকটি কাজে কালার পেন্সিল, মিশ্র মাধ্যমও আছে। অধিকাংশই যেন রঙিন সচিত্রকরণের অপেক্ষাকৃত বৃহৎ ছবি। পুরাণ, বিশেষত দেবদেবী, ধুনুচি নাচ, রাসলীলা, ধ্যানমগ্নতা, রাধাকৃষ্ণ, পূজারিণী... এমন ধরনের ছবি এঁকেছেন। অ্যাকাডেমিতে শেষ হল প্রদর্শনীটি।

যে অর্থে এক-একটি পেন্টিংয়ের চিত্রগুণ বিশ্লেষণ করতে গেলে ছবির সমস্ত দিকটিকে যেমন সিরিয়াস পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তেমনই কম্পোজ়িশন, অ্যারেঞ্জমেন্ট, ফর্ম, স্টাইল, স্পেস, কালার, ব্যালান্সের দিকগুলিও পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়। সব মিলিয়েই তো বর্ণকে সেই অনুযায়ী শিল্পী তাঁর নিজস্ব টেকনিকের সাহায্যে সৃষ্টি করেন। কী করতে চেয়েছেন, সামগ্রিক ভাবে তা ঠিক কতটা উতরে গিয়েছে বা যেতে পারেনি, বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে, সেগুলোও মাথায় রাখতে হয়। দুর্বলতা যাতে বাধা না হয়, নজরে রাখতে হবে।

দর্শক তাঁর পেন্টিং ও ড্রয়িংয়ে কোথাও ওয়েস্টার্ন স্টাইলের ‘এসেন্স’ খুঁজে পাবেন না, সে তিনি ব্রোশিয়োরে যতই উল্লেখ করুন। ভারতীয় শৈলী হয়তো খানিকটা পাওয়া গেলেও যেতে পারে, তবু তার মধ্যেও অনেকটাই গলদ। সচিত্রকরণের মতো তো বটেই। অতি উজ্জ্বলতা, গাঢ় ও চোখে লাগার মতো জ্বলজ্বলে বর্ণ ব্যবহার করেছেন। ড্রয়িংয়ে রিয়েলিজ়ম বিদ্যমান হলেও, সমগ্র পটেই অনুপুঙ্খময় রূপারোপে একটি ডিজ়াইন ও নকশাময় রচনাকে বিন্যস্ত করেছেন। কিন্তু ভারতীয় ধ্রুপদী শৈলীর প্রধান দিকগুলির সঙ্গে কোথাও মেলে না তাঁর শৈলী। কোনও স্বল্প জায়গার কথা মনে হলেও। অতি উগ্র বর্ণবিন্যাসে মারও খেয়েছে কিছু জায়গা। সমতল টকটকে লালের আধিক্য, বিকাশ ভট্টাচার্যের ‘নারী’দের ব্যর্থ অনুকরণ-প্রয়াস, ‘পূজারিণী’র হাতের দুর্বল নৈবেদ্যর ড্রয়িং, হঠাৎ হঠাৎ গণেশের শুঁড়ে প্রকট লাল বর্ণের বাহুল্য, মন্দির স্থাপত্যের ভিত্তি-ভাস্কর্যের ড্রয়িং, পদ্মপাতা, হঠাৎ কোথাও অনাবশ্যকীয় পাখি উড়িয়ে বা বসিয়ে দেওয়া, ছবির পটভূমির বিভিন্ন নকশা ও নারীশরীরের অলংকার এবং শাড়ির গোটা অংশের সাদাকালো আলঙ্কারিক রূপারোপ... সর্বোপরি অতিরিক্ত ফিনিশিং ছবিগুলিতে ভীষণ রকম কাঠিন্য এনেছে। তাঁকে রচনা, সামগ্রিকতায় কিছু রূপের গ্রহণ-বর্জন, স্পেস ইত্যাদি নিয়ে ভাবতেই হবে। সব জায়গায় কাজ করলেই ছবি উতরে যাবে না। ভাবতে হবে বর্ণের ব্যবহার, বাহুল্য ও বিশেষত ফিনিশিং নিয়ে তো বটেই! কম্পোজ়িশন, অ্যারেঞ্জমেন্ট নিয়েও।

অভিজিতের কাজে নিষ্ঠা আছে, কিন্তু অতিরিক্ত কাজ সব ক্ষেত্রে ছবিকে মার খাইয়ে দেয়। কোথায় থামতে হবে, জানতে হয়। প্রদর্শনীর নাম ‘রিদম অব কালারস’ হলেও এই ছবিগুলিতে রঙের সেই ছন্দ কিন্তু অনেকটাই ছন্দহীন। রঙের ব্যবহার ও নির্বাচনকেও সে ভাবেই গুরুত্ব দিতে হয়।

অন্য বিষয়গুলি:

Art Gallery Art Oil Painting
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE