Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Devbhasha Gallery

‘সিন্ধু সভ্যতার ভাঙা মৃৎপাত্রের মতো যেন ঝুলে আছে চাঁদ’

শেখরের অধিকাংশ ছবিতে চাঁদ এক অনিবার্য ফর্ম, প্রতীক হিসেবে, এমনকি খোলা আকাশের নীচে বা জানালায় যেন লেগে থাকা তার আশ্চর্য আলোর উন্মাদনায়।

নিসর্গ: দেবভাষা গ্যালারিতে শেখর রায়ের কাজ

নিসর্গ: দেবভাষা গ্যালারিতে শেখর রায়ের কাজ

অতনু বসু
শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০২০ ০১:৩৮
Share: Save:

নিসর্গের মধ্যে ডুবে যেতে যেতে, নিসর্গ ভেদ করে অনির্দেশের দিকে চলে যেতে যেতে, নিসর্গের মধ্যে ধ্বংস হতে হতে, নিসর্গকে জাপটে জড়িয়ে নিংড়ে, তাকে নিয়ে মন কেমন করা রহস্যের অতলে তলিয়ে যেতে যেতেও ওই রম্য, রূপসী চাঁদ তাঁকে ছাড়েনি। তিনি অন্ধকার-আলোর তরলায়নে যে-নিসর্গকে চিনেছেন, তা একান্তই নৈঃশব্দ্যের তেপান্তর। আকাশ, বাতাস, মৃত্তিকা, বৃক্ষ, জল, জীব, পক্ষী, পর্বত, নৌকো, তরঙ্গ, পুষ্প... সবই অলৌকিক এক আলোর আবহে আশ্চর্য কবিতা! নিশ্চিত ভাবেই তাঁর আপাত-উজ্জ্বল ও প্রায়ান্ধকার সব ল্যান্ডস্কেপই কবিতার কাছে মগ্ন চৈতন্যে লীন হওয়া এক লিপিবদ্ধ ভ্রমণকাহিনি। কী ছিল সে সব লিপি ? তার ভাষা, অক্ষর, বর্ণমালার চৈতন্য-চেতনারহিত আঁধারালোকের অন্তর্ভেদী অবলোকন? রূপ ছিল, অরূপের শরীরছোঁয়া তরল আলোর আড়ালে সে ছিল একা, নিঃসঙ্গ, অলৌকিক। আকাশ তার আর এক রকম বিভায় আসন দিয়েছিল। এ সব নিসর্গ-ভ্রমণ শিল্পী শেখর রায়ের জলরং, মিশ্র মাধ্যম, অ্যাক্রিলিকের উপাখ্যান। রঙিন রাত্রি-দিনের এমন কবিতাই তিনি কাগজে রচনা করেছেন। দেবভাষা গ্যালারিতে তাঁর ল্যান্ডস্কেপ প্রদর্শনীটি সম্প্রতি শেষ হল।

শেখরের অধিকাংশ ছবিতে চাঁদ এক অনিবার্য ফর্ম, প্রতীক হিসেবে, এমনকি খোলা আকাশের নীচে বা জানালায় যেন লেগে থাকা তার আশ্চর্য আলোর উন্মাদনায়। নিঃসন্দেহে এই চাঁদ তাঁকে আচ্ছন্ন করেছে, চাঁদের অনুপস্থিতির নিসর্গ শিল্পী চাননি। চন্দ্রহীন নিসর্গ আরও অন্য এক অনুভূতিপ্রবণ। বারবার সে-সব ল্যান্ডস্কেপ ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল কবিতার কল্পিত কার্পেটের কাছে। শেখর কি পড়েছিলেন সেই কবিতার লাইন? নিশ্চিত উত্তর ‘না’। তবুও কী সাংঘাতিক সাদৃশ্যের প্ল্যাটফর্মে হারিয়ে যাওয়া রং, রেখা, রূপ, আলো, অন্ধকার, হাওয়া-বাতাস মিলেমিশে যাওয়া এই অনুভব। তিনি রিয়্যালিজ়মকে দ্বিমাত্রিকতার প্রেক্ষিতে রেখেও কখনও তাঁর দেখা ও না-দেখা রূপের অন্তর্নিহিত সত্যকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। মূর্ততা-বিমূর্ততা নক্ষত্রায়িত তরল ও জমাট দুই বিপরীত আলো-আঁধারের সংঘাতকে এ ভাবেই চিনিয়েছেন। এখানেই জন্ম নিচ্ছে অলৌকিক আলো অথবা অনির্দেশের এক দরজার আহ্বান। রঙের তছনছ করা এক বিস্ফোরক আকাশ-বাতাস যেন গাইছে কোনও এক অতল জলের গান, অথবা নিশ্ছিদ্র আঁধারের দিকে নেশাতুর হয়ে ছুটে যাওয়া কোনও চাঁদকে স্পর্শ করার বাসনা-সঙ্গীত। তিনি এত কাল যে-ধরনের কাজ করেছেন, এ নিসর্গ তা থেকে বহু যোজন দূরের। আসলে তিনি কখনওই এ ভাবে ল্যান্ডস্কেপ রচনা করেননি। তাঁর কাজে যে-সব বস্ত্রবিন্যাসের প্রতিচ্ছায়াময় বুনটের জালিকা অনেকটা অংশ জুড়ে বিরাজ করত, এখানে তা অদৃশ্য। ব্রাশিং ও ফর্ম, স্পেস ও ডিভিশন, টেকনিক ও স্টাইলাইজ়েশন একেবারেই অন্য রকম। প্রয়োজনে রূপবন্ধ ও তার বিবর্তিত বিমূর্ততা অথবা শূন্যতা ও পরিসরের মধ্যবর্তী অংশে অকস্মাৎ প্রবেশ করা অন্য এক রূপ। পুষ্প ও বৃক্ষের পরিচিত ধারণার মধ্যেও এক অনন্য রূপের বিন্যাস ও রঙিন অন্ধকারের ছায়াময় রহস্যময়তা ছবিগুলিকে মহার্ঘ করেছে, সন্দেহ নেই। আবার কোনও কাজ অ্যান্ড্রু ওয়াইথের ল্যান্ডস্কেপের মতো।

তাঁর কাজ দেখতে দেখতে মনে পড়ে বিভিন্ন কবির সেই সব অমোঘ লাইন। চাঁদ তো কাব্যে অজস্রতায় আচ্ছন্ন। কিন্তু ওই ছবির সঙ্গে সাদৃশ্যের ক্ষেত্রেও অবাক হতে হয়। জীবনানন্দের ‘দিনের আলো ঝিমিয়ে গেল,— আকাশে ওই চাঁদ!’ অথবা ‘চাঁদ জেগে আছে আজো অপলক— মেঘের পালকে ঢালিছে আলো!’ আবার অনির্বাণ দত্তের ‘চন্দ্রমল্লিকার মতো মুখ তুলে অন্ধকারেও জেগে রয়েছে চাঁদ’— শেখরের ছবি কি ফিরিয়ে দেয় না পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘চাঁদ ওঠে শিমুলের মহুয়ার শালের মাথায় / চাঁদ যেন পঞ্চাশের মন্বন্তরে মরা কোনো মুখ’। ফিরিয়ে দেয় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কাছেও, ‘মাথার উপর অ্যালুমিনিয়াম চাঁদ, এখানে ফাঁদ পাতা আছে...।’ আবার ‘কোথাও যাবো না / শুধু একা একা সারারাত / জ্যোৎস্না বুকে করে আমি পাথরেরই মতো শুয়ে রব।’ অমিতাভ দাশগুপ্তের ‘পাথরের গান’ ফিরে আসে শেখরের ছবিতে। এ সব লাইন কি শেখরের সাম্প্রতিক ল্যান্ডস্কেপ সিরিজ় দেখতে দেখতে মনে পড়েনি? ভীষণ ভাবেই পড়েছে। তাই তো নানা ভাবেই নিসর্গের কবিতা লিখেছেন শিল্পী তাঁর ‘নিজ হাতে নিজস্ব ভাষায়’।

অন্য বিষয়গুলি:

Devbhasha Gallery Painting Exhibition
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy