নাটকের একটি দৃশ্য —ফাইল চিত্র।
গত ১৩ জুন অ্যাকাডেমি মঞ্চে অনুষ্ঠিত হল ইচ্ছেমতো নাট্যগোষ্ঠীর ‘কীত্তনখোলা’। এই নাটকটি লোকপ্রসিদ্ধ বাংলাদেশি নাট্যকার সেলিম আল দীন-এর (১৯৪৯-২০০৮) যৌবনের রচনা। লেখক আয়ানল হক লিখেছেন— ‘. . . স্বদেশকে খোঁজার জন্যই সেলিম আল দীন স্বদেশীয় ভাষার দিকে মুখ ঘোরালেন। . . . ইংরেজদের উপনিবেশ পত্তনের আগে বাংলার যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ছিল এবং আজও মুমূর্ষু অবস্থায় হলেও টিকে আছে, সেখানেই তাকে পাওয়া যাবে। আর সেটা হচ্ছে বাংলার মধ্যযুগের সাহিত্য কিংবা লোক-আঙ্গিক।’ ঠিক এই দর্শন থেকেই জন্ম হয়েছে ‘কীত্তনখোলা’র, যা ‘হয়ে উঠেছে বাঙালির প্রান্তিক জনমানুষের প্রথাগত জীবনে স্থিত সাংস্কৃতিক আচার-আচরণের ইতিবৃত্ত।’কীর্তনখোলা নদীর ধারে প্রতিবছর একটা মেলা বসে। সেই মেলায় আসে বহু ধরনের মানুষ। এই মেলায় আসে চাষা, দিনমজুর, লাউয়া (বেদে), ডোমেরা। চলে বেচা-কেনা, গান-বাজনা। এই কীর্তনখোলার মেলায় ইদু কনট্রাক্টরের খুব দাপট। সে এক ক্ষমতাবান লোক যার অঙ্গুলিহেলনে সমাজ চলে। সে একদা নিজে ছোটবেলায় অন্যায় ও বঞ্চনার শিকার হয়েছে। তাই সে বুঝেছে ক্রমাগত নিজের ক্ষমতা বিস্তার করে সবাইকে হাতের মুঠোয় আনতে হবে। সোনাই একজন দিনমজুর। তার স্ত্রী সন্তান বিয়োতে গিয়ে মারা গিয়েছে। ঘরে তার অসুস্থ মা। আর রয়েছে তার কয়েক বিঘে জমি। ইদু কনট্রাক্টর সেই জমি নিয়ে নিতে চায়। আবার এই ইদুর ডাকে সাড়া দিয়ে মেলায় আসে এক যাত্রা কোম্পানি। নাম নয়াযুগ অপেরা। এই যাত্রাপালার অধিকারী হল সুবল ঘোষ। ইদুর মূল উদ্দেশ্য অবশ্য শুধু যাত্রাপালায় আমোদ করা নয়। সে চায় নায়িকা বনশ্রীবালার সঙ্গ। সে বনশ্রীবালাকে নিজের থাবার ভিতরে পেতে চায়। একা তার নাচ দেখতে চায়, নাচের পরে তাকে দেখতে চায়। যাত্রাদলের অধিকারী সুবল ঘোষের সঙ্গে তার এ বিষয়ে ভিতরে ভিতরে চুক্তিও হয়ে যায়। কিন্তু একদা পতিতাপল্লীর অন্ধকার থেকে উঠে আসা বনশ্রীবালা ভালবাসে নায়ক রবিদাশকে। অথচ রবিদাশ বনশ্রীবালার সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব রাখে। বনশ্রীবালার এই ভালবাসার কথা বোঝে যাত্রাদলের আরেক অভিনেতা—ছায়ারঞ্জন। সে একজন মেয়েলি পুরুষ। যাত্রায় নারী চরিত্রে অভিনয় করে। সে আবার খুব ভাল বন্ধু হয়ে ওঠে সোনাইয়ের। ওদিকে মেলায় চুড়ি বেচতে আসা লাউয়ার মেয়ে ডালিমনের প্রেমে পড়ে যায় সোনাই। কিন্তু এই প্রেম তো সমাজ মেনে নেবে না, ঠিক যেভাবে সমাজ মেনে নেবে না বনশ্রীবালা আর রবিদাশের সম্পর্ক। কীর্তনখোলা নদীর বাতাসে ভেসে যায় পাওয়া না-পাওয়া ঘ্রাণ। মানুষের জীবন মেলার মতোই কয়েক দিনের। সেখানে কেউ খেলনা পায়, কারও খেলনা হারায়। রবিদাশ বোঝে বনশ্রীবালার চাওয়াকে সে পূর্ণ করতে পারবে না, কিন্তু গোপনে সেও ভালবাসে তাকে। আর ভালবাসে বলেই বনশ্রীবালাকে নিয়ে ইদু কনট্র্যাক্টটর আর সুবল ঘোষের চুক্তি সে মেনে নিতে পারে না। সে প্রতিবাদ করে।
এলোমেলো হয়ে যায় বহুকালের চিরচেনা হিসেবগুলো। সোনাই সমাজ-সংস্কার সব ফেলে ছুটে যায় ডালিমনের টানে। শুধু ডালিমনকে ভালবেসে সে বেছে নেয় লাউয়াদের জীবন। ইদু কনট্র্যাক্টরের থাবার সম্মুখে ঘুরে দাঁড়ায় সে। কীর্তনখোলার মেলায় লাগে ম্লান বিষাদগোধূলির বিবর্ণ রং।সেলিম আল দীনের ‘কীত্তনখোলা’ নাটকটি যথাযোগ্য সম্পাদনা করে মঞ্চায়িত করেছে ইচ্ছেমতো নাট্যগোষ্ঠী। নাট্য সম্পাদনার জন্য প্রীতম রায়কে সাধুবাদ জানাই। এই নাটক উপস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রথমেই যেটা বলার, তা হল এর কাব্যিকতা। এই নাটকের দৃশ্যাবলির মধ্যে এক শান্ত কাব্যস্রোত অনুভব করা যায়, যা মনকে দূর কোনও সময়খণ্ডের কিনারে নিয়ে যায়। সৌমেন চক্রবর্তীর আলোর প্রয়োগ এবং সৌরভ পালোধী ও অপ্রতিম সরকারের মঞ্চভাবনা (চিত্রপট হিসেবে গ্রাম্য কিছু স্থিরচিত্র)—এই নাটকের আবহটিকে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। রবিদাশের চরিত্রে অনুজয় চট্টোপাধ্যায় সপ্রতিভ, দৃঢ় ও তীক্ষ্ণ। সোনাইয়ের ভূমিকায় কৃষ্ণেন্দু সাহা ও ছায়ারঞ্জনের চরিত্রে শান্তনু মণ্ডলের কাজ ভাল লেগেছে। সুবল ঘোষের চরিত্রে মুদাসসর হোসেন যথাযথ। পোড়খাওয়া ধান্দাবাজ ইদু কন্ট্র্যাক্টরের ভূমিকায় শঙ্কর দেবনাথ চমৎকার অভিনয় করেছেন। ইদুর চরিত্রের নানা সূক্ষ্ম পরত তিনি দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। নজর কেড়েছেন মালেকের চরিত্রে প্রসূন সোম। অন্য দিকে বনশ্রীবালার চরিত্রে সুচরিতা মান্না বলিষ্ঠ কাজ করেছেন। বনশ্রীবালার জটিলতা, অসহায়তা এবং সমর্পণ তাঁর অভিনয়ে প্রাণ পেয়েছে। ডালিমনের ভূমিকায় মানসী সাহু ভীষণ সাবলীল ও শক্তিশালী।‘কীত্তনখোলা’ নাটকে সূত্রধরের কাজ করেছে গানের দল। গানের ভিতর দিয়ে এগিয়েছে নাট্যধারা। গানের দলে শুভাশিস খামারু, স্বজন সৃজন, আকাশ, গার্গী, শ্রেষ্ঠা, অন্বয় ও আহেলীর সমবেত কাজ চমৎকার লেগেছে। দেবদীপ মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘কীত্তনখোলা’র গানে লেগে আছে বাংলার মাটির ঘ্রাণ আর নদীজলের বাতাস। ভাল লেগেছে সৌরভ পালোধী ও মুস্কান মণ্ডলের পোশাক ভাবনা।‘কীত্তনখোলা’ নাটকটি খুবই দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করেছেন সৌরভ পালোধী। মঞ্চের ‘স্পেস’কে তিনি যেভাবে ব্যবহার করেছেন এবং গানের দলটিকে যে ‘স্ট্রাকচারাল কম্পোজিশন’ প্রদান করেছেন, তা অবশ্য প্রশংসাযোগ্য। এছাড়াও এই নাটকটির দৃশ্যায়নে তিনি যে কাব্যিকতা এনেছেন, তাতে নাটকটির অন্তর্গত বিষয়বস্তু সহজ ও সাবলীলভাবে প্রবাহিত হয়েছে নাট্যমঞ্চে। ‘কীত্তনখোলা’ নাটকটির মধ্যে পরীক্ষানিরীক্ষা রয়েছে— যা ভাবনাকে উসকে দেয়। এই নাটকটি খানিক দীর্ঘ, তবে তা এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy