বাস্তবিক: সিমা গ্যালারিতে আয়োজিত প্রদর্শনীর শিল্পকর্ম। ছবি সৌজন্য: সিমা গ্যালারি, কলকাতা।
সিমা গ্যালারির ৩০তম অ্যানিভার্সারি শোয়ের দ্বিতীয় পর্ব ‘নিও রিয়্যালিজ়ম টু সোশ্যাল রিয়্যালিজ়ম’-এর প্রথমেই লিখতে হয় শিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্যের কথা, যাঁকে আমরা অকালে হারিয়েছি। অল্প বয়সেই সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ এবং পরে ভিত্তোরিও ডি সিকা’র ‘বাইসাইকল থিভস’ চলচ্চিত্র দেখে তাঁর জীবনদর্শন পাল্টে যায়, আর তার ছাপ পড়ে তাঁর ছবিতে। একটা সময়ে যখন বাস্তববাদী ছবি এবং সারস্বত শিল্প লুপ্তপ্রায় হতে বসেছিল, তিনিও চেষ্টা করেছিলেন কিছু দিন সম্পূর্ণ বিমূর্ত ছবি আঁকতে। কিন্তু বিকাশ ভট্টাচার্য শেষ পর্যন্ত ফিরেছিলেন বাস্তবধর্মী ছবিতে। কারণ, সে সময়কার কলকাতার মধ্যবিত্ত মানুষের দ্বিচারিতা, নকশাল আন্দোলনে প্রশাসনের নিষ্ঠুরতা, নিপীড়িত গ্ৰাম্য মানুষের অসহায়তার কথাই তিনি বলতে চেয়েছিলেন। নিজের ঈর্ষণীয় অ্যাকাডেমিক শিক্ষাকে শিল্পী সারা জীবন ব্যবহার করেছেন সমাজে ঘটা অত্যাচার-অবিচারকে ব্যঙ্গ করতে। সেগুলি তাঁর মনের গভীর প্রতিফলনের ফসল। তাঁর ‘দ্য টোটেম’ এবং ‘ডল সিরিজ়’ দেখিয়ে চমকে দিয়েছেন ভারতীয় শিল্পজগতকে।
প্রদর্শনীতে বিকাশ ভট্টাচার্যের ক্যানভাসের উপরে তেলরঙে ১৯৯০ সালের আঁকা ‘জলিল’স ফ্যামিলি’ দেখা গেল। ছবিতে দেখা গেল বর্ষার কলকাতার বুকে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, তার মধ্যেই তিনজন মানুষ যেন বিচ্ছিন্নতাবোধে ভুগছেন। অনবদ্য ভাষ্য।
এর পরের ছবিটির নাম ‘দ্য বেদার’। এটি ১৯৯৫ সালে মিশ্রমাধ্যমে কাগজে করা কাজ। এখানে দেখা যায় তাঁর কল্পনার বিচ্ছুরণ। স্নানরতা এক নারীর যৌনতাময় স্বপ্ন। কিন্তু পুরো ছবিটিতে আবেগের একান্ত অভাব। শুধুই বিরহ এবং বিচ্ছিন্নাবস্থা। বিকাশ ভট্টাচার্যকে এখানে অন্য রূপে পাওয়া গেল। ছবি থেকে চোখ ফেরানো যায় না।
প্রদর্শনীতে বিকাশ ভট্টাচার্যের যে আত্মপ্রতিকৃতি দেখা গেল, সেটিও বেশ অন্য স্বাদের। বাস্তবসম্মত কাজ, কিন্তু মাথাটা যেন শরীরের চেয়ে একটু আলাদা। আবারও সেই বিচ্ছিন্নতাবোধের ছোঁয়া লাগা। তিনি যেন অন্তর্দৃষ্টিতে নিজেকেই দেখতে পেরেছেন এখানে।
তাঁর ‘ডল সিরিজ়’-এর একটি মাত্র ছবি দর্শক প্রদর্শনীতে দেখতে পাবেন। এই সিরিজ়ের ছবিগুলি এই অর্থে গুরুত্বপূর্ণ যে, এখানে পুতুলের মাধ্যমে ইতিহাস ধরে রেখেছেন বিকাশ। নকশালবাড়ি আন্দোলনে মৃত বন্ধুর সন্তানের পড়ে থাকা একটি পুতুল তাঁর বহু ছবিরই প্রধান চরিত্র হয়ে রইল।
এ ছাড়াও নানা ধরনের প্রতিকৃতি, বিশেষ করে রামকিঙ্করের প্রতিকৃতি নজরকাড়া। বিকাশ ভট্টাচার্যের অধিকাংশ ফিগারেটিভ ছবির ভিতর দিয়ে তাঁর গভীর ধ্যানধারণার এবং সমাজচেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।
পূর্ববঙ্গে জন্ম যোগেন চৌধুরীর। দেশভাগের পরে কলকাতায় আসা, জমিদারবাড়ি ছেড়ে উদ্বাস্তু কলোনিতে থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছিল শিল্পীর। কিন্তু গ্ৰামের ত্রিনয়নী দুর্গাপ্রতিমা বানানোর শিল্প তাঁকে কখনও ছেড়ে যায়নি। যোগেনকে লতাপাতা, ফুল, ব্রততী রেখায় আঁকতে ও দেশীয় স্টাইলে ছবির কম্পোজ়িশন তৈরি করতেও শিখিয়েছিলেন ধীরেন ব্রহ্ম (নন্দলাল বসুর ছাত্র)। খুব অল্প সময়ে নিজের চিত্রকলার ভাষা খুঁজে পেয়েছিলেন যোগেন। ছোট থেকেই তাঁর ড্রয়িং-এর হাত খুব ভাল ছিল এবং ছবিতে নাটকীয়তা তখন থেকেই আনতে পারতেন। পরে তাতে এসে মেশে তাঁর পাশ্চাত্য শিক্ষা। সিমা-র প্রদর্শনীতে যোগেনের একটি ছবি আছে, যার নাম ‘উয়োম্যান আন্ডার দ্য কুইল্ট’। এটি কালিতুলি এবং প্যাস্টেলের মিশ্রমাধ্যমে করা। অতুলনীয় ক্রস হ্যাচিংয়ের ব্যবহার দেখা যায় এই ছবিতে।
‘হেড’ নামে একটি মাথার ড্রয়িং দেখা যায়, যা শুধুই রেখানির্ভর নয়। ভিতরটা ক্রস-হ্যাচিংয়ে ঢেকে প্যাস্টেল ঘষে দিয়েছেন উপর থেকে। অভিব্যক্তিটি বেশ।
শিল্পী মীরা মুখোপাধ্যায়ের আধুনিকতা তাঁকে পৃথিবীর সর্বত্র ভাস্কর্যের উপাদান খুঁজতে বাধ্য করেছে। এক দিকে ইলোরার রাজকীয় ছন্দের স্থাপত্যের সঙ্গে চোলের ব্রোঞ্জ স্থাপত্য মিলিয়েছেন মীরা। একাধারে নটরাজের নৃত্যরত চলনে অনুপ্রাণিত হয়েছেন, অন্য দিকে তিনি লক্ষ করেছেন জনজাতির যাপনে অপরিশীলিত ভাব। এই সব মিলে মীরা তাঁর ভাস্কর্যে সৃষ্টি করলেন নিজস্ব ভাষা, ব্রোঞ্জকে মাধ্যম করে। এ ভাষায় মার্জিত সৌন্দর্য ছিল না। ছিল দেশজ কথা, ভারতীয় সভ্যতার হৃদ্স্পন্দন।
প্রদর্শনীতে দেখা গেল ‘উল গ্যাদারার’ নামে একটি মূর্তি। ব্রোঞ্জে করা এই কাজে গ্রাম্য মেয়ের উল ছাড়িয়ে বল পাকিয়ে রাখার এক বলিষ্ঠ ভাবমূর্তি ফুটে উঠেছে।
আর একটি ভাস্কর্য, নাম ‘উয়োম্যান ব্রেকিং হাস্ক’-এ দেখা যায়, একটি মেয়ের ধান ঝাড়ার অনবদ্য ভঙ্গিমা। ব্রোঞ্জে করা। পরিশ্রম করার মুহূর্তেও সেই মেয়ের সারা অঙ্গে লালিত্যমাখা। বড় মনোরম এই কাজ।
জয়া গঙ্গোপাধ্যায়ের পুরো যাত্রাটিই যেন পুরুষশাসিত সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ইন্ডিয়ান কলেজ অব আর্টস অ্যান্ড ড্রাফ্টম্যানশিপের ছাত্রী জয়া ছিলেন রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে। তাঁর কাছে শিল্পজগতের দরজাও সহজে খোলেনি। লড়াই করে জয়া এখন যে জায়গায় পৌঁছেছেন, সেখানে তিনি এখন নিজস্ব আঙ্গিকে, নিজের মনোজগতের প্রতীকী ছবি আঁকেন। শিল্পীর অন্তর্জগতে প্রেম, ভালবাসা, উদারতা ইত্যাদি প্রচ্ছন্ন ভাবে থাকলেও বেশির ভাগটা জুড়েই রয়েছে পুরুষের আধিপত্যবোধ এবং হিংস্রতা। খুব বলিষ্ঠ রেখায় ছবি আঁকেন, আঙ্গিক সাররিয়াল, রঙের খেলাও অনেক সময় কমপ্লিমেন্টারি এবং চোখে পড়ার মতো।
তাঁর একটি ছবি মিশ্রমাধ্যমে কাগজের উপরে করা, শিরোনামহীন। সমাজে উপেক্ষিত এবং ঘৃণিত মেয়েদের ছবি। সেই বারবণিতাদের চোখেমুখে অসম্ভব হতাশা এবং সমাজের একটা বীভৎস চেহারা এই ছবিতে ধরা পড়ে। আর একটি ছবিতে দু’টি মেয়ে পানশালায় বসে আছে। পোশাকের আড়ালে তাদের স্বরূপ লুকোনো। এই ছবিটির অন্তর্নিহিত বক্তব্যও অসম্ভব ভাল।
শিল্পী জয়া গঙ্গোপাধ্যায়ের যে ছবিটি সবচেয়ে মনোগ্রাহী, সেখানে অবচেতন মনকে শিল্পী রূপ দিয়েছেন একটি আকৃতিতে। এতেও শিরোনাম রাখেননি। ক্যানভাসে মিশ্রমাধ্যমে করা এক নারীচরিত্র, যেন বেদনায়, বঞ্চনায় বিবস্ত্র, বিব্রত।
সিমা গ্যালারিতে আয়োজিত ‘টুয়েলভ মাস্টার্স’ শোয়ের দ্বিতীয় পর্বের প্রদর্শনীটি নতুন প্রজন্মের শিল্পীসহ শিল্প-অনুরাগীদের সকলের কাছেই লোভনীয়, যা পরের পর্বের আশা আরও বাড়িয়ে দেয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy