—ফাইল চিত্র।
১৯২৮ সাল। গ্রামোফোন কোম্পানিতে শিল্পী, গীতিকার, সুরকারের ভূমিকায় যুক্ত হলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তখন সেখানে আছেন শিল্পী, সঙ্গীত-প্রশিক্ষক ধীরেন দাসও। কোনও গান এক বার শুনেই কণ্ঠে তুলে নেওয়ার দুর্দান্ত ক্ষমতা ছিল তাঁর। প্রতিভামুগ্ধ নজরুল ধীরেনকে বলতেন ‘শ্রুতিধর’, তাঁর গানের ‘গান্ধারী’। নজরুল গান শিখিয়ে দিতেন, ধীরেন সেই গান শেখাতেন শিল্পীদের। সুরের এই রসায়ন এসে পড়ে ব্যক্তিগত সম্পর্কেও, নজরুল আর ধীরেন দাস (উপরের ছবি) যেন অগ্রজ-অনুজ। ধীরেনই প্রথম নজরুলের গানে সুর দেন, নজরুলেরই আন্তরিক ইচ্ছায়। প্রথম গান দু’টি: ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায়’, ‘আর লুকাবি কোথায় মা কালী’।
কলেজজীবনে শিশিরকুমার ভাদুড়ির সংস্পর্শে এসে প্রথম মঞ্চাভিনয় ধীরেন দাসের, রঘুবীর নাটকে। পরে অভিনয় করেছেন সীতা, চন্দ্রগুপ্ত, প্রফুল্ল, বাসন্তী, বিদ্যাপতি, বিসর্জন, দুর্গেশনন্দিনী নাটকেও। অভিনীত প্রথম সবাক ছবি ঋষির প্রেম; প্রহ্লাদ, পথের শেষে, সোনার সংসার, হাল বাংলা, মণিকাঞ্চন ইত্যাদি ছবিও তাঁর অভিনয়ধন্য। সুর দিয়েছেন খনা, পথের দাবী ইত্যাদি ছবিতে। নজরুল-গীতি ছাড়াও রেকর্ড করেছেন রাগপ্রধান, গজল, ভাটিয়ালি, বাউল, আগমনী, স্বদেশি গান, রবীন্দ্রসঙ্গীতও। বিশিষ্ট অভিনেতা অনুপকুমারের বাবা তিনি।
সম্ভবত ১৯৩০ সালের কথা, নজরুল ও ধীরেন এক দিন দু’জনে গ্রামোফোন কোম্পানিতে। নজরুল হঠাৎ বললেন, “ধীরেন, যে দিন আমি আর তুমি কেউ আর এই সুন্দর পৃথিবীতে থাকব না, সে দিন আমাদের এই মধুর সম্পর্ক কেউ কি মনে রাখবে?” ধীরেন বললেন, “কাজীদা, আপনার আমার এই সম্পর্ক নিয়ে একটা কবিতা লিখে ফেলুন না! আমরা যখন থাকব না, তখন এই কবিতা পড়ে মানুষ আমাদের সম্পর্কের কথা জানতে পারবে।” নজরুল তৎক্ষণাৎ চার পৃষ্ঠার একটি কবিতা লিখে দিলেন, প্রথম পাতায় ‘আমার পরম স্নেহভাজন অনুজোপম শ্রীমান ধীরেন্দ্র দাস কল্যাণীয়েষু’ (মাঝের ছবি)।
শিল্পী, অভিনেতা, সুরকার ধীরেন দাসকে লেখা কাজী নজরুল ইসলামের এই দীর্ঘ কবিতার মূল পাণ্ডুলিপি এ বার প্রদর্শ হিসেবে দেখতে পাবেন নজরুলপ্রেমীরা। ধীরেন দাসের পুত্র অরবিন্দ দাস তা দিয়েছেন ‘জীবনস্মৃতি আর্কাইভ’কে। এ বছর কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে, সেই উপলক্ষে আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ, ২৫ মে জীবনস্মৃতি আর্কাইভের ‘নজরুল ভান্ডার’ বিভাগের উদ্যোগে সাত দিন তা প্রদর্শিত হবে ভদ্রকালীর ৭০ রাম সীতা ঘাট স্ট্রিটে আর্কাইভ-ঘরে। থাকবে নজরুল বিষয়ক গ্রন্থ, পত্রপত্রিকা। প্রদর্শনীর ভাবনা ও রূপায়ণে জীবনস্মৃতি আর্কাইভের অবেক্ষক অরিন্দম সাহা সরদার; তা উৎসর্গ করা হয়েছে নজরুল-সাধক গবেষক ব্রহ্মমোহন ঠাকুরের স্মরণে। আজ সন্ধ্যা ৬টায় উদ্বোধন, অন্য দিনগুলিতে দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৪টা।
অদ্বিতীয়
১৮৮৩। তরুণ রবীন্দ্রনাথ কিছু দিনের জন্য ছিলেন ‘কারোয়ারে সমুদ্র-তীরে’, মেজদাদার আস্তানায়। সত্যেন্দ্রনাথ একটি কোয়ার্টজ় পাথর দেন রবীন্দ্রনাথকে, তিনি তা হৃৎপিণ্ডের আকারে কেটে এই কয়টি পঙ্ক্তি খোদাই করে উপহার দেন সুহৃদ অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরীকে: “পাষাণহৃদয় কেটে/ খোদিনু নিজের হাতে/ আর কি মুছিবে লেখা/ অশ্রুবারিধারা-পাতে।” ছোট্ট একটি পাথর কেটে তার গায়ে খোদাই, রবীন্দ্রনাথ তখন বাইশ। ১৯৪১-এর মিউনিসিপ্যাল গেজেট-এ, অমল হোম সম্পাদিত রবীন্দ্র স্মরণ-সংখ্যায় ফোটো ছাপা হয় তার, ‘দ্য হার্ট স্টোন’ নামে। জগদীশ ভট্টাচার্যের কবিমানসী-র প্রথম খণ্ডেও উল্লেখ আছে কালের কবল থেকে ‘একটি বিস্ময়কর স্মারকচিহ্নের’ উদ্ধার পাওয়ার কথা। অক্ষয় চৌধুরীর সূত্রে এই শিল্পকর্ম পান কন্যা উমারানী, পরে দৌহিত্রী দেবযানী বসু; তিনি সেটি দিয়ে যান তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূ ইলোরা বসুকে। তাঁর কাছেই এত দিন যত্নে থাকা এই ‘রবীন্দ্র-ভাস্কর্য’ এ বার দেখতে পাবে কলকাতা, দেবভাষা বই ও শিল্পের আবাসে। প্রদর্শনীর নাম ‘হৃদয়’, প্রদর্শবস্তু একটিই (ছবি)। আজ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় উদ্বোধন, দেখা যাবে ২৭ মে পর্যন্ত, দুপুর ২টো থেকে রাত ৮টা। হবে আলোচনা; প্রকাশিত হবে একটি বইও, ইতিহাসটি ধরা যেখানে।
অনুবাদ-কথা
বাংলা সাহিত্য কেমন লেখা হচ্ছে আজকাল, কিংবা ইংরেজি ও অন্য ভারতীয় ভাষায় বাংলার ধ্রুপদী ও সমসাময়িক সাহিত্যের অনুবাদ তত নেই কেন— এ নিয়ে প্রায়ই কথার ঝড় ওঠে সমাজমাধ্যমে। পাশাপাশি এ প্রশ্নও জাগে, বাঙালিরা কি অন্য ভারতীয় ভাষার সাহিত্যের খবর রাখেন তেমন? সাহিত্য অকাদেমির নানা কার্যকলাপের মধ্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ এ কাজটিই, ভারতের নানা ভাষার সাহিত্যের অনুবাদ নানা ভাষায় করানো, এবং তা নিয়ে আলোচনা। এই সূত্র ধরেই কলকাতায় সাহিত্য অকাদেমি প্রেক্ষাগৃহে আগামী ২৯ মে বিকেল ৪টায় বাংলা অনুবাদে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারজয়ী বইয়ের আলোচনা করবেন কৃষ্ণা ভট্টাচার্য ও শ্যামল ভট্টাচার্য। ওঁরা কথা বলবেন ওড়িয়া, ডোগরী ও পঞ্জাবি চারটি ছোটগল্প সঙ্কলন নিয়ে।
নাট্য সমারোহ
এক ছাদের তলায় নানা আঙ্গিকের নাট্য। বেহালা ব্রাত্যজন তাদের দশম বর্ষপূর্তিতে কলামন্দিরে আয়োজন করেছে ‘জাতীয় নাট্য সমারোহ’। আছে টিনের তলোয়ার, শল্যপর্ব-র মতো নাটক, জাতীয় স্তরের চারটি বহুচর্চিত প্রযোজনাও। আজ দুপুর ৩টে ও সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় মকরন্দ দেশপান্ডে থাকবেন সার সার সরলা নিয়ে, আগামী কাল বিকেল সাড়ে ৪টে ও সন্ধ্যা ৭টায় কুমুদ মিশ্র পুরানে চাওয়ল নিয়ে। ২৭ মে সন্ধ্যায় উৎপল দত্তের টিনের তলোয়ার, সুমন মুখোপাধ্যায়ের পুনর্নির্মাণে। আগামী ৭-৮ জুন সন্ধ্যায় আরও দু’টি: রাজীব বর্মার চৌথি সিগারেট; রাজেন্দ্র গুপ্তা-হিমানী শিবপুরী অভিনীত জিনা ইসি কা নাম হ্যায়। রয়েছে আয়োজকদের নাটকও, আর্থার মিলারের ডেথ অব আ সেলসম্যান অবলম্বনে একটি স্বপ্নময় মৃত্যু, আর পড়ে পাওয়া ষোলো আনা-র ৭৫তম অভিনয়।
শখের বাজার
রাজা-মহারাজ আর জমিদাররাই কি শুধু শিল্পকর্মের পৃষ্ঠপোষক, সংগ্রাহক? দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে সংগ্রহ-সংরক্ষণের দিক-আঙ্গিক গেছে পাল্টে, সাক্ষী কলকাতার সংগ্রাহক-সমাজ। অতীতের নানা অভিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য-চলচ্চিত্রের পরিচয়বাহী সব কিছুই সংগ্রহের, কারণ তা ধরে রাখে ইতিহাসের সত্য। তাদের তুলে ধরতে প্রয়োজন হয় মেলা, প্রদর্শনী। তেমনই এক আয়োজন, ‘শখের বাজার’, শুরু হল শহরে। নোয়া’জ় কাফে ও দেবু’জ় দরবার-এর একত্র প্রয়াস, বিষয় চলচ্চিত্র। পোস্টার, বুকলেট, লবি কার্ড-সহ সিনেমার হরেক সংগ্রহ এক ছাদের তলায়। গতকাল শুরু হয়েছে দক্ষিণ কলকাতায় রিজেন্ট পার্ক থানার পাশেই। আগামী কাল পর্যন্ত, দুপুর ৩টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা।
ছবি দেখিয়ে
মে মাস ফুরোয়নি এখনও, সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিনের অনুষঙ্গে শহর এখনও বিভোর। ফোরাম ফর ফিল্ম স্টাডিজ় অ্যান্ড অ্যালায়েড আর্টস আগামী ২৯ মে পালন করবে সিনেমার মহারাজার জন্মদিন, সঙ্গী অরোরা ফিল্ম কর্পোরেশন। নন্দন-৩ প্রেক্ষাগৃহে অনুষ্ঠান দুপুর সাড়ে ৩টে থেকে, দেখানো হবে অপরাজিত ও জলসাঘর। দুই প্রদর্শনের মাঝের বিরতিতে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় বলবেন ‘সত্যজিতের ছবিতে বাঙালির ইতিহাস’ নিয়ে। আবার গ্যোয়টে ইনস্টিটিউট-ম্যাক্স মুলার ভবনের সহযোগিতায় ওঁরাই দেখাবেন চার জার্মান নারী পরিচালকের তৈরি এই সময়ের চারটি ছবি, ৩০ ও ৩১ মে নন্দন-৩’এ, দুপুর সাড়ে ৩টে থেকে। ৩০ তারিখ বলবেন জার্মান ফিল্ম আর্কাইভ-এর দক্ষিণ এশিয়া কো-অর্ডিনেটর উদাত্ত ভট্টাচার্য।
ডাক-সম্মান
বেশ কিছু দিন ধরে কলকাতা সোসাইটি ফর কালচারাল হেরিটেজ করে চলেছে হারিয়ে যাওয়া সুন্দরবন-পটচিত্রের সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের কাজ। এই প্রতিষ্ঠানটি সুন্দরবনের প্রান্তিক মহিলাদের প্রশিক্ষিত করে ফিরিয়ে এনেছে পটচিত্র আঁকার চর্চায়। ছবির বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে সুন্দরবনের নিজস্ব সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গ— জল, জঙ্গল, বনবিবি, দক্ষিণ রায়, বাঘ, বাগদা। পটচিত্রের পাশাপাশি কাচের বাতিল বোতল, মাটির পাত্র, ফুলদানি, টি-শার্টেও ছবি আঁকছেন ওঁরা। অতি সম্প্রতি এই পটচিত্রকে স্বীকৃতি দিয়ে ভারতীয় ডাক বিভাগের পক্ষ থেকে একটি ‘স্পেশ্যাল কভার’ (ছবি) উন্মোচিত হল কলকাতার জেনারেল পোস্ট অফিস ভবনে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পোস্টমাস্টার জেনারেল সঞ্জীব রঞ্জন, সুন্দরবন (দক্ষিণ) বন বিভাগীয় প্রধান মিলন মণ্ডল, কেএসসিএইচ-এর কর্ণধার সৌরভ মুখোপাধ্যায়-সহ বিশিষ্টজন।
সরায় ধরা
কে জি সুব্রহ্মণ্যনের শিল্পচর্চা ছিল বহুমুখী; কাগজ, ক্যানভাস, অ্যাক্রিলিক শিট ছিল তাঁর চিত্রপট, মাটির সরাও। দেশজ উপাদান আর চিত্রপটের ব্যবহারে ভারতশিল্পের সঙ্গে মগ্ন ছিলেন সতত সংলাপে। কলাভবনের ডিজ়াইন বিভাগের বাড়িতে সাদা-কালোয় করা তাঁর ম্যুরাল আজ বিশ্বভারতীরও অভিজ্ঞান। তাঁর কাজে পুরাণকল্পের কৌতুকমিশ্রিত প্রয়োগ ভারতশিল্পের আধুনিকতার লক্ষণ প্রকট করে, সরাচিত্রেও সরলতা ও কৌতুকের মিশেলে নবজন্ম লাভ করে পুরাণ-আশ্রিত চিত্রকল্প। কলকাতার পাঠভবন স্কুলের দেওয়ালে পড়ুয়ারা তাঁর সাদা-কালো ম্যুরাল মাথায় রেখে এক ভিত্তিচিত্র রচনা করেছিল। তাঁর জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের অঙ্গ হিসেবে আজ, শনিবার সন্ধ্যা ৬টায় তাঁর ছাত্র, শিল্প-ইতিহাসবিদ সৌমিক নন্দী মজুমদার কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি (কেসিসি)-তে বলবেন ‘মানিদা’র সরাচিত্র নিয়ে, তার আগে পাঠভবনের শিল্পপ্রদর্শন ‘বাদামি হলুদ’ শিরোনামে। অনুষ্ঠানের মূল আয়োজক ইমামি আর্ট। ছবিতে শিল্পীর সরাচিত্র।
তবুও লড়াই
গত বছর কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শিশির মঞ্চ উপচে পড়েছিল এই ছবি দেখতে। কারণ, শ্রীময়ী সিংহের অ্যান্ড, টুওয়ার্ডস হ্যাপি অ্যালিজ় প্রামাণ্যচিত্রটির কথা আগেই ছড়িয়ে পড়েছিল এ শহরের ফিল্মপ্রেমী মহলে, বার্লিনাল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্যানোরামা বিভাগে প্রথম দেখানো ইস্তক। ছ’বছর ধরে ছবিটা বানিয়েছেন শ্রীময়ী— খোদ ইরানের মাটিতে, নানা জায়গা ঘুরে, ইরানি সিনেমার নানা পরিচালক ও অভিনেত্রীর সাক্ষাৎকার নিয়ে। যে দেশে প্রতি পদে শুধু বারণ আর নিষেধ, রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু, শাস্তি-জেল-জরিমানার ভ্রুকুটি, সেখানে ঠিক কেমন আছেন মানুষ— শিল্পী, নির্দেশক, কবি? কেমন করে মেয়েরা রুখে দেন ক্ষমতার দমন-পীড়ন, ফরোঘ ফারোকজ়াদ-এর মতো কবি-চলচ্চিত্রকারেরা কী করে লড়ে যান জীবন দিয়ে? গ্যোয়টে ইনস্টিটিউট-ম্যাক্স মুলার ভবনের ‘ডকু ফোরাম’-এ আবার দেখার সুযোগ, আগামী ২৯ মে বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy