বাস্তব ও তার ঊর্ধ্বে: সিমা গ্যালারিতে আয়োজিত প্রদর্শনীর শিল্পকর্ম। Sourced by the ABP
সিমা গ্যালারির তিরিশ বছরের জন্মদিন উদ্যাপনে এ বারের প্রদর্শনী ‘ফ্যান্টাস্টিক রিয়্যালিটিজ় অ্যান্ড বিয়ন্ড’ দিয়েই যবনিকা পড়তে চলেছে। এর আগে ১২ জন ‘মাস্টার’-এর কাজ দিয়ে সাজানো হয়েছিল তিন ভাগে, তিনটি প্রদর্শনী। আমাদের দেশের আধুনিক শিল্পকলা চর্চায় কী ধরনের কাজ হচ্ছে, তার একটা সম্যক পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল সেখানে। আলোচ্য প্রদর্শনী ‘ফ্যান্টাস্টিক রিয়্যালিটিজ়...’-এর সুর আবার অন্য রকম।
যুদ্ধোত্তর ইউরোপে বীভৎসতা এবং বিশৃঙ্খলার ফলে পঞ্চাশের দশকের শেষে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা শহরে এক শিল্প আন্দোলন শুরু হয়। পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল সেটি। যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি এবং নারকীয়তার ছবি যেমন নিজেদের কাজে ধরে রাখতে চেয়েছেন সে সময়ের শিল্পীরা। আবার অন্য দিকে, এলোমেলো অবস্থা থেকে কিছুটা যেন বাঁচতে চেয়ে, নিজেদের কল্পনাকে বাস্তবতার স্পর্শ দিয়েও ছবি এঁকেছিলেন তাঁরা। সেই রকমই কিছু ভাবনাকে মনে রেখে সিমা গ্যালারি চলতি প্রদর্শনীর নামকরণটি করেছেন।
প্রদর্শনীতে প্রবেশ করলে প্রথমেই দেখা যায় কিংশুক সরকারের বিশাল কাজ ‘বারুদ’। ক্যানভাসের উপরে পশু-সৃজিত আঠা এবং কার্বন পলিমার দিয়ে রক্তের ছিটের মতো কালো রঙের উপস্থিতি। টুকরো টুকরো কালো রঙের অনুভূতি দিয়ে যেন তৈরি এ কাজ। আর তার পাশে বোমা ফাটার মতো শব্দ আসছে একটি ভিডিয়ো থেকে। এটি একটি নাটকীয় কাজ। ঠিক এই সুরেই মানুষের অদেখা, অচেনা জিনিস নিয়ে, শিল্পীরা মানসপটে যা দেখেছেন, তা-ই এঁকেছেন বা গড়েছেন। সেই ধরনেরই সব কাজ এখানে দেখতে পাবেন দর্শক।
গণেশ পাইনের ‘নরক’ কাজটিতে শিল্পী নরক যে ভাবে কল্পনা করেছেন, তা বেশ অন্য রকম। চারকোল এবং ক্রেয়নে আঁকা কাগজের কাজ।
চিত্রভানু মজুমদারের ক্যানভাসের উপরে অ্যাক্রিলিকে করা ছবিটির বিষয় হল, হাসপাতালে বা মর্গে রাখা একটি মৃতদেহ। কিছুটা যেন তারই চোখ দিয়ে পারিপার্শ্বিক জগৎটা এঁকেছেন শিল্পী।
অশোক মল্লিকের ‘পেট্রিফায়েড সিটি’ ছবিতে শান্ত এক শহুরে জীবনে দু’টি বিশালায়তন অজানা পাখির ছায়া। এই ছায়া যেন সেই শহরে অদ্ভুত এক ভীতির আবহ তৈরি করেছে।
চিন্তন উপাধ্যায়ের জনসংখ্যা বিস্ফোরণের অদ্ভুত প্রেরণা নজর কাড়ে। এটি ফাইবার গ্লাসে করা, নাম ‘ক্লাউড’। শুধু মনুষ্য অবয়বের সমারোহে তৈরি এ কাজ। এখন যেমন আই-ক্লাউড-এ সব কিছু জমিয়ে রাখা যায়, সেখান থেকেই হয়তো শিল্পীর এমন চিন্তা এসেছে যে, জনসংখ্যা এতই বাড়ছে দিনে দিনে যে, শেষকালে মানুষের বসতি হবে মেঘ। কাজটির ঠিক নীচে একটি আয়নায় এই মনুষ্য-ক্লাউডের প্রতিচ্ছবি। অনবদ্য কাজ।
কেজি সুব্রহ্মণ্যনের ‘ইন্টিরিয়র’ কাজটি তাঁরই স্বাক্ষরবাহী। এটি অ্যাক্রিলিক শিটের উপরে রিভার্স পেন্টিং। অন্দরমহলের ছবি হলেও এটি ঠিক বাড়ির অন্দরমহল নয়। বরং মানবমনের অন্তর-মহল। খুবই রঙিন একটি ছবি, গোয়াশ এবং তেলরঙের মিশ্রণে সৃষ্টি।
সুদর্শন শেট্টির ‘আ পোস্টকার্ড ফ্রম ইন্ডিয়া’তে পুরনো একটি থামওয়ালা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। সেখানে একটি আচ্ছাদিত গাড়ি পার্ক করা আছে, সামনে টবের ভিতরে কিছু গাছ। এ পোস্টকার্ডে কোনও পরিবর্তন ধরা পড়ে না। সমস্তটাই অতীত নিয়ে পড়ে থাকার গল্প।
কুসুমলতা শর্মা এঁকেছেন ‘দ্বারকা’। ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক ও ইঙ্কে করা ছবি। শ্রীকৃষ্ণের শহর দ্বারকা, যেটি সমুদ্রের নীচে চলে যায়, তারই ছবি নিজের কল্পনায় এঁকেছেন শিল্পী।
ধর্মনারায়ণ দাশগুপ্তের ‘ভায়োলেন্স’ ছবিতে এক মহিলার প্রেক্ষাপটে হাঁড়িকাঠ, তলোয়ার ইত্যাদির আবছায়া দেখতে পাওয়া গেল এবং বোঝা গেল, কত বিমূর্ত ভাবে নারীদের উপরে হওয়া অত্যাচারের কথা বলতে
চেয়েছেন শিল্পী।
মন্দাকিনী দেবীর ‘নাগকন্যা’ একটি লেন্টিকুলার প্রিন্ট। এখানে নাগকন্যার এক অদ্ভুত রূপ দিয়েছেন শিল্পী।
জয়া গঙ্গোপাধ্যায়ের ক্যানভাসে মিশ্রমাধ্যমের ছবি শিরোনামবিহীন। কল্পনাপ্রসূত এক নারীচরিত্র যেন পুরুষকে দিয়ে পুতুল নাচাতে আগ্রহী। অন্য পুরুষটি এই নাটকের সাক্ষী।
জিতীশ কল্লটের ‘রিকশাপলিস’ দু’টি ব্রোঞ্জ মূর্তির উপরে অ্যাক্রিলিকে করা একটি ক্যানভাস। শিল্পী দেখিয়েছেন, সাধারণ জীবনের দুঃখ, কষ্ট, শ্রম... সব যেন এক বহমান স্রোতের মতো ভেসে চলেছে।
কাশ্মীরি খোসার ‘ইনট্রোস্পেকশন’ ছবিটি ক্যানভাসে তেলরঙে করা। এখানে যেন নিজেকে পরতে পরতে চিনতে পারা ফুটে উঠেছে। ছবির মানুষটি দাঁড়িয়ে আছে এক অচেনা গহনে।
পঙ্কজ পানওয়ারের ‘এলিফ্যান্ট অন ফার্স্ট ট্র্যাক’-এ যেন বলা আছে, মানুষের দঙ্গলকে হাতির পিঠে চড়েই বাঁচতে হবে। রোলার কোস্টারে চড়িয়ে হাতি বহু দূরে নিয়ে চলেছে মানুষকে, মনুষ্যজাতিরই সংরক্ষণের জন্য।
কবিতা নায়ারের ‘রেমিনেশনস’ ছবিটি কাগজে প্যাস্টেলের কাজ। পুরনো চিন্তা করতে ব্যস্ত এক মানুষ। বিখ্যাত আমেরিকান লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের স্মরণে করা এই কাজ।
আবীর কর্মকারের তেলরঙে করা নগ্ন আত্মপ্রতিকৃতিগুলি একটু ব্যঙ্গাত্মক বলে মনে হয়। তিনি যেন কোথাও দর্শকের প্রতিক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জ করছেন।
শ্রেয়সী চট্টোপাধ্যায় ক্যানভাসে অ্যাপ্লিক এমব্রয়ডরি ও অ্যাক্রিলিকে করা ‘কোএগজ়িস্ট্যান্স’ ছবিতে দিল্লি শহরটিকে বেশ অন্য ভাবে দেখিয়েছেন। সেখানে কোনও হতাশার ছায়া পাওয়া যায় না।
অঙ্কন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সুন্দরবন থেকে সোনারপুর’ ছবিতে শহরতলির বিভিন্ন জায়গা নানা ভাবে দেখাতে চেয়েছেন। যেন একই অঙ্গে এত রূপ! বেশ মজাদার সিটিস্কেপ।
রেশমী বাগচি সরকারের ট্রিপটিক ছবি ‘হোপ ফর আ ফ্লাওয়ার ফ্লোট’-এ আশার আলো ফুটছে সব অন্ধকার সরিয়ে। দূরে একটি প্রাসাদোপম বাড়ি আলোয় উদ্ভাসিত।
সুমন চন্দ্রের অ্যাক্রিলিক, চারকোল, কয়লার গুঁড়ো, ইটের গুঁড়ো, মাটি, বালি ছাড়াও কালি কলমে ও পাতলা কাপড়ে করা ছবিটির আটটি ভাগ আছে। যেখানে প্রকৃতির কথা বলা হয়েছে, আপাতদৃষ্টিতে তা মৌন বলে মনে হলেও আসলে তার অন্তরের মুখরতার কথা বলেছেন শিল্পী।
কিছু বর্ষীয়ান শিল্পীর সঙ্গে নতুন প্রজন্মের অনেক শিল্পীর কাজ নিয়ে আয়োজিত এই প্রদর্শনী দর্শককে ভাবায়। আমাদের দেশের বিভিন্ন আঙ্গিকের শিল্পকলা, শিল্পচিন্তা সম্পর্কে সম্যক একটা ধারণা জন্মায়। সিমা গ্যালারির ‘ফ্যান্টাস্টিক রিয়্যালিটিজ় অ্যান্ড বিয়ন্ড’ প্রদর্শনীতে শিল্পরসিকরা অন্য এক জগতের সন্ধান পাবেন বলেই আশা।
শমিতা বসু
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy