Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
তাঁর কীর্তনে সজীব ভালবাসার দেশের আখর। নিঃশব্দে ১০০ বছরে পা দিলেন সাধিকা শিল্পী ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়।
Kirtan Artist Chabi banerjee

সুরে আঁকা ছবিটি

বিরহিনী রাধার উথালপাথাল দশায় শ্যামরঙা তমাল তরুমূলে আশ্রয় খোঁজার মতো মথুরায় অধিবাসকালে ব্রজস্মৃতিতে কৃষ্ণের ব্যথাতুর টানাপড়েনও ফুটিয়ে তুলছেন গীতশ্রী ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়।

কীর্তন শিল্পী ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়।

কীর্তন শিল্পী ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়।

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২৩ ০৯:৫৬
Share: Save:

তিনি রাধা, তিনিই সখীগণ, সুবল সখা, যশোদা… আবার তিনিই শ্রীকৃষ্ণ। ডান চোখ কেঁপে ওঠায় আসন্ন বিরহের অমঙ্গল সঙ্কেতে ‘আমার দক্ষিণ নয়ন’ বলে এই তো শ্রীরাধা কণ্ঠে কেঁপে উঠছিল তাঁর স্বর! সেই তিনিই শ্রীকৃষ্ণ হয়ে অক্রূরের রথ ছাড়ার আগে সখীদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন, ‘আমি আজ যাব কাল আসব ফিরে, মথুরা নয় বহু দূরে! দাও গো আমার পথ ছেড়ে’!

বিরহিনী রাধার উথালপাথাল দশায় শ্যামরঙা তমাল তরুমূলে আশ্রয় খোঁজার মতো মথুরায় অধিবাসকালে ব্রজস্মৃতিতে কৃষ্ণের ব্যথাতুর টানাপড়েনও ফুটিয়ে তুলছেন গীতশ্রী ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়। নাট্যকার শেক্সপিয়র যেমন তাঁর ছোট, বড় সব চরিত্রের সঙ্গে সহজেই একাত্ম হন, বহুস্বরা ছবি অনায়াসে ক্ষণে ক্ষণে কৃষ্ণ, রাধা, সখীগণ হয়ে ওঠেন। কণ্ঠে ছবি আঁকেন! সেই চিরসবুজ সজীব সতেজ কণ্ঠৈশ্বর্য ১০০ বছরে পা দিল। শুক্রবার, তাঁর প্রিয় ছবিদির ৯৯ বছর পূর্ণ হওয়ার জন্মদিনের আগে কত কাল আগের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল বিশুদ্ধা ব্রহ্মচারিণীর। ছবির বহু যুগের পরম সুহৃদ, আনন্দময়ী মায়ের আশ্রমের বোন ৮৬ বছরের বিশুদ্ধা কনখল থেকে ফোনে বলছিলেন, “অনেকেই জানেন না, ছবিদি আমার শ্রীকৃষ্ণ, আমি ওঁর রাধা হয়ে রাসলীলার অভিনয় পর্যন্ত করেছি।” সে না কি ১৯৬২ সালের কথা! দেহরাদূনের আশ্রমে আনন্দময়ী মা নিজে সবাইকে ফুলের গয়নায় সাজিয়ে চন্দন লেপে দিয়েছিলেন। তাতেই ছবি কৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনয় করেন, বিশুদ্ধা রাধা! আনন্দময়ী আবার ছবিকে অষ্টসখীর এক জন আখ্যা দিয়ে ‘সুদেবী’ নামও দিয়েছিলেন! ছবি চলে গিয়েছেন ১১ বছর! আজও প্রায়ই ছবির ঊষাকীর্তনে কনখলের আশ্রমের ঘুম ভাঙে।

কিন্তু এই ইনস্টাগ্রাম রিলের যুগে পদাবলি কীর্তনের বুনোট ছাড়ানো আখ্যান শোনার ধৈর্য কই! ছবির আমলেও আকাশবাণী বা এলপি রেকর্ডের দাবি মেনে কীর্তনকে কেটেছেঁটে সঙ্কলিত করার দরকার পড়ত। লংপ্লেয়িং রেকর্ডের চাকতির দু’পিঠে সাড়ে ২২ মিনিট করে পালাকীর্তনের অংশ নিপুণ হাতে আঁটাতেন নবদ্বীপ ব্রজবাসীর কাছে কীর্তন শিক্ষায় ছবির সতীর্থ, কীর্তন তত্ত্ববিদ মৃগাঙ্কশেখর চক্রবর্তী। তবু এই তাৎক্ষণিকতা সর্বস্ব অস্থির সময়ের সঙ্গে সে-যুগের তুলনাই হয় না!

শুক্রবার, তাঁর পিসির ১০০য় পা রাখার দিনটিতে যতীন দাস রোডের বাড়িতে ছোট্ট ছিমছাম অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন ছবির ভাইপো নির্মাল্য (গোপাল) ও তাঁর স্ত্রী শমিতা। গাইলেন ছবিরই ক’জন ছাত্র, ছাত্রী। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ছবির বহু দিনের কাছের জন জয়শ্রী বসু মজুমদার বা ছবির কীর্তন ঘরানার বিশ্বস্ত ধারক, আর এক ছাত্রী সীমা আচার্য চৌধুরী। দূরে বসেও অনলাইনে অনুষ্ঠানের স্বাদ নিলেন প্রবাসী কয়েক জন শিষ্যা। ছোটবেলায় মামণি বলতে পারতেন না, তাই মাননি বলে ডাকতেন, পিসিকে শেষ পর্যন্ত মাননি বলেই ডেকেছেন নির্মাল্য। বলছিলেন, “এ যুগে মাননির মনের মতো কীর্তনের শিল্পী কম! আবার মাননি থাকলে ওঁকে নিয়ে বড়সড় অনুষ্ঠানে সহজে রাজি হতেন না!”

সিদ্ধা শিল্পী ছবি বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের শিল্পী-সত্তাকে জীবনভর থোড়াই কেয়ার করেছেন। আটপৌরে পরিবারের মেয়ে বিয়ে না করে নিজের শর্তে বেঁচেছেন। গুটিকয়েক নাছোড় সাক্ষাৎকারে বার বার একই কথা, “গান আমার সাধনা, অধ্যাত্মজীবনের অঙ্গ। সাধনাই শেষ কথা! এর বাইরে গান কিচ্ছু নয়!” যতীন দাস রোডে ছবিদের ছেলেবেলার তেতলা বাড়ি ভেঙে এখন ফ্ল্যাট হয়েছে। সে-বাড়িতে সুভাষচন্দ্রকেও সম্ভবত গান শুনিয়েছেন ছবি। ওই বাড়িরই ফ্ল্যাটে জীবনের শেষ পাঁচ বছর কেটেছিল তাঁর। ছবির ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকার ঠাকুরঘরে বসে মনে হচ্ছিল, জীবনের শতক স্পর্শের এই প্রাক্-মুহূর্তে আজ তিনি থাকলেও সাধ্বী শিল্পীর নাগাল মেলা সোজা হত না! ছবি নেই! ঠাকুরঘরে রয়েছে ছবির তৈরি অপূর্ব সরস্বতী মূর্তি। নিপুণ হাতের নকশায় বোনা ঠাকুরের আসন! রয়েছেন জীবনের বেশির ভাগটা জুড়ে দেশের সর্বত্র ছবির সঙ্গী অষ্টধাতুর রাধামাধব। মা আনন্দময়ী নিজে এই বিগ্রহ ছবির হাতে তুলে দেন। জল খেলেও রাধামাধবকে নিবেদন করে খেতেন ছবি। সেই সাতসকালে উঠে ঠাকুরের সেবা, ভোগ নিবেদনের পরে দু’টি খেয়ে জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে কীর্তনের ক্লাস নিতে যেতেন। বাড়ির বাইরে জলস্পর্শেরও প্রশ্ন নেই। ফিরে এসে আবার ভোগ নিবেদন করে খাবেন। কট্টর নিরামিষাশী। মুসুর ডাল, পুঁই শাকও চলবে না! ভাইপো বৌ শমিতা বলেন, “আবার জন্মাষ্টমীতে তালের বড়া, তালক্ষীর, পিঠে, পায়েস, নোনতা, মিষ্টি নিমকিসুদ্ধ ১৭-১৮ পদ রেঁধে খাওয়াবেন! ভাজা মিষ্টি হয় না দক্ষিণ কলকাতার এমন দু’টি দোকান যাদব ও গিরিশের সন্দেশ বা রসের মিষ্টি শুধু মুখে তুলতেন!” আবার এই ছবিই ছাত্রী সীমাকে বলছেন, “কীর্তন গাস, চাকরি করিস, এত ধকল— মাছমাংস সব খাবি! এখন সময় আলাদা! আনাজপাতিতেও কেমিক্যাল! তাই মেয়েদের নিজের খেয়াল রাখতে হবে!”

মধ্য ষাট পেরিয়ে অবসরের পরেও কৃষ্ণময় জীবন! কলকাতার বাইরে গেলেও স্বপাক আহার! মা আনন্দময়ী স্বহস্তে কিছু খেতেন না। গুটিকয়েক সাধ্বী শিষ্যা তাঁকে খাইয়ে দিতেন। ছবিরও সে অধিকার ছিল। মায়ের আশ্রমে ইন্দিরা গান্ধীকেও রেঁধে খাইয়েছেন ছবি। সঞ্জয় গান্ধীর মৃত্যুর পরে কনখলে অন্তরঙ্গ বৃত্তে ছবির গান শুনে ইন্দিরার দু’চোখ টলটল করে উঠেছে।

ছোটবেলায় এই ছবিই বাবার সঙ্গে দেশপ্রিয় পার্কে গিয়ে ক্রিকেট, টেনিস খেলেছেন। বাবা নলিনীমোহন অনুশীলন সমিতির পুলিনবিহারী দাসের চেলা। মা অমলার অপূর্ব গানের গলা! বালিকা বয়সেই কংগ্রেসের সভায় ‘বন্দেমাতরম’ গানের বাঁধা শিল্পী হয়ে ওঠেন ছবি। পরে ছবি শুনিয়েছেন, সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ডাকে সোদপুরের আশ্রমে গিয়ে গান্ধীজীকে ‘বন্দেমাতরম’ শোনানোর গল্প। ভবানী দাসের সুরে ছবির অসামান্য ‘বন্দেমাতরম’ ইন্টারনেটে রয়েছে। লেক টেম্পল রোডের শিবমন্দিরে ১৩-১৪ বছর বয়সে গান শুনিয়েই আনন্দময়ীর কাছে আসেন!

নির্মাল্য বলেন, “নিজের কথা তো পারতপক্ষে বলত না মাননি! কেউ কেউ ভাবেন, ওঁর জন্মসাল ১৯২৬। রবীন্দ্রভারতীতে কীর্তন শেখাতে গিয়েই কারও ভুলে এ ধারণা তৈরি হয়।” ১৯২৪-এর ৬ অক্টোবর ছবির জন্মদিন সোমবার পড়েছিল। মা আনন্দময়ীর নির্দেশে জন্মবারে মৌনী থাকতেন ছবি। তবু সাধ্বী হয়েও মোটেই শুকনো সন্ন্যাসিনী ছিলেন না গীতশ্রী। জীবন রাধামাধবে সমর্পণ করেও ছাত্রছাত্রীদের প্রতি স্নেহ বা সময় বিশেষে মনের সরস ভাব কম পড়েনি তাঁর। ত্রিগুণা সেন, আচার্য রমা চৌধুরী স্নেহ করতেন ছবিকে। রমার কথাতেই রবীন্দ্রভারতীতে যান ছবি। ছবি কিছু খায় না বলে রমাদি তাঁকে বকাবকি করতেন! শীর্ণা রমাদিকে ছবিও মজা করে বলতেন, “আরে আপনিই তো ফুঁ দিলে উড়ে যাবেন!”

তখন বয়স অল্প।

তখন বয়স অল্প।

ছবির অন্তঃসলিলা রসিক মননেরই ছাপ মিশে বিচিত্র তালের নানা পদ, অপূর্ব আখরে ভরপুর তাঁর মনোহরশাহী কীর্তনের উপস্থাপনায়। প্রবীণ সঙ্গীত গবেষক দেবজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুগ্ধতা রয়েছে ছবি, রাধারাণী দেবী, রথীন ঘোষের কীর্তনে। তাঁর কথায়, “ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থাপনায় আদি, অকৃত্রিম কীর্তন! মরমি নিবেদনেও রাধাকৃষ্ণের লীলার দিব্য ভাবটি উজ্জ্বল।” নবদ্বীপ ব্রজবাসীর কাছে গরানহাটির কীর্তন শেখেন ছবি। রত্নেশ্বর মুখোপাধ্যায়, পঞ্চানন ভট্টাচার্যের কাছে মনোহরশাহী। শিখতে যেতেন কৃষ্ণচন্দ্র দে-র কাছেও। এ ছাড়াও ধ্রুপদ-ধামার দানীবাবু, খেয়াল-ঠুমরি সুখেন্দু গোস্বামী, বাউল-ভাটিয়ালির গুরু সুরেন চক্রবর্তী! সুরেনবাবুই আকাশবাণীতে গান গাইতে নিয়ে যান ছবিকে। সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের কাছে নজরুল-গীতি, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্র-গীতি শিখতেন রজনীকান্তের দৌহিত্র দিলীপকুমার রায়ের কাছে। সব মিলিয়ে শ’খানেক গান, রেকর্ড। তরুণীবেলায় উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, দবীর খাঁয়ের কাছে পরীক্ষা দিয়ে ‘গীতশ্রী’ পান ছবি। ৩০-৪০টি প্লেব্যাক করেছেন। ‘রাইকমল’-এর ‘দেখে এলেম তারে’, ‘বঁধূর কুশলে কুশল মানি’, ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’-এর ‘বহুদিন পরে বঁধূয়া এলে’, ‘মাথুর’-এর ‘মাধব তুহুঁ সে রহলি মধুপুর', ‘নীলাচলে মহাপ্রভু’-র ‘আজি কালি বলি গোঙাইব কাল’, ‘মহাকবি গিরিশচন্দ্র’ ছবির ‘প্রাণভরে আয় হরি বলি’র মতো কিছু গান আজও অনেক প্রবীণ ভুলতে পারেন না।

গান ও জীবন একাকার হওয়া যাপনে শেষ পর্যন্ত কিছু দুঃখও বহন করেছেন ছবি। ‘যোগাযোগ’ ছবির জন্য শান্তিদেব ঘোষের তালিমে গাওয়া তিনটি গান অনুমোদন করেননি বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। একান্তে পূজা পর্যায় বা কীর্তনাঙ্গের কিছু গান ছবির ছিল চির সঙ্গী। তবু রবীন্দ্রগান আর রেকর্ড করা হয়নি তাঁর। তা বলে ছবির প্রিয় সুচিত্রা মিত্র সস্নেহ প্রকাশ্যেই বলেছেন, ছবি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলে অনেক শিল্পীরই কিন্তু মুশকিল হত!

অনাড়ম্বর জীবনে একনিষ্ঠ ভাবে ছবি কণ্ঠে ধরে রেখেছেন ‘বাংলার ধনুকের ছিলায় ছিলায় যত টান’! হঠকারী আত্মবিস্মরণের যুগেও নিজেকে চিনতে বার বার ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেই ফেরে বাঙালি।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy