ডাইভার্সন ১৮-র চিত্র প্রদর্শনী।
কেন যে প্রদর্শনী করার আগে শিল্পকলার ক্ষেত্রে এক-একটি দল কোনও হোমওয়র্কই করেন না, তা ভেবে ও দেখে আশ্চর্য হতে হয়। বহু শিল্পীর প্রচুর কাজ, ভাল-মন্দের বাছবিচার নেই, দেওয়ালে যেমন-তেমন ভাবে ঝুলিয়ে দিলেই যেন তাঁরা সার্থক। এই নিয়ন্ত্রণহীন শৃঙ্খলার অভাব যথারীতি সে সব প্রদর্শনীকে কোনও নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আবদ্ধ হতে দেয় না। ডাইভার্সন ১৮-র ‘মিরর অব মিরাজ’ নামে সদ্য শেষ হওয়া অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের প্রদর্শনীটিও তেমনই বার্তা দিল। অথচ আশ্চর্য এটাই যে, কয়েক জনের মধ্যে যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও একটি সুশৃঙ্খলার অভাবে ছবির গুণমান নির্ধারণের স্থানটিকেই তাঁরা অবিন্যস্ত করলেন। না ছিল ভাল-মন্দের নির্বাচন, না ছিল প্রদর্শিত শিল্পবস্তুর যথাযথ অবস্থানের ভাবনা। এত বেশি কাজ রাখতেই হবে? অতি দুর্বল, অপ্রয়োজনীয় ছবিও?
তবে এঁদের বাইশ জনের সকলেই চিত্রকর। একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, অবয়বকে বেশির ভাগ শিল্পীই যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু অবয়বী ছবির রচনার দিকটিতে অন্যান্য অনুষঙ্গের অবস্থান, চাহিদা, প্রয়োজনীয় স্পেস, পটভূমির শূন্যতা এমন নানা জায়গায় বিবিধ দুর্বলতার দিকটি প্রকট হয়েছে। এর ফলে একটি ছবি সেই স্টাইল ও টেকনিকের চমৎকারিত্ব থেকে হঠাৎ সরে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। শিল্পী সেখানে হয় তাড়াহুড়ো করে ফেলেছেন, না হয় ঠিক মতো এগোতে পারেননি, বুঝতেই সমস্যা হয়েছে। কিছু কাজে কিন্তু একটি পরিকল্পনা ও যথাযথ ভাবে ছবিটিকে ফিনিশ করার প্রবণতাও ছিল। দুর্বল কিছু কাজেও নিষ্ঠার একটি ছাপ পাওয়া যায়। ছবি তৈরির প্রাথমিক কিছু প্রয়োজনীয় শর্ত সম্পর্কে ভাবতে হবে, জানতে হবে সমগ্র স্পেসের স্পষ্ট একটি কম্পোজ়িশনের নিয়ন্ত্রণ।
মোনালিসা সরকার মিত্রর কাজগুলিতে ড্রয়িং, রিয়্যালিজ়ম, রচনার বাঁধুনি, বর্ণের ঔজ্জ্বল্য ও নমনীয়তার সুন্দর ভাবে বিশ্লেষণ ভাল লাগে। তাঁর ট্রিটমেন্ট ও টেকনিকে যথেষ্ট মুনশিয়ানা লক্ষণীয়। রতন দাস সম্পর্কেও প্রায় একই কথা বলা যায়। খুবই কাব্যিক রচনা, বর্ণের লাবণ্য ও স্বল্পবর্ণের সমন্বয়ে বেশ প্রাণবন্ত। লাবণী চট্টোপাধ্যায়ের দুর্বল রচনা, ড্রয়িং চোখে লাগে। মৌমিতা বণিকের ‘ডাইভার্সিটি অব লাইফ’ কিছুটা ইলাস্ট্রেটিভ হলেও মন্দ নয়। শর্মি সেন দে নিজস্ব একটি স্টাইল তৈরি করেছেন, কিন্তু সব ক্ষেত্রে অমন লালের আধিক্য ও বিস্ফারিত চোখ মানায় না। সুমন নস্কর মন্দ নয়, একটু বেশি আলঙ্কারিক। উত্তম ভট্টাচার্যর কাজ ভাল, অতি ফিনিশিংয়ে কিছুটা কাঠিন্য এসে গিয়েছে। চারকোলের ‘টাইনি ড্রিমস’ মনোরম। পায়েল মিত্র সরকারের ‘কলকাতা ডায়েরি’ বড্ড ইলাস্ট্রেটিভ। তুলনায় ‘কলকাতা মাই সিটি’ মন্দ নয়। দেবব্রত বিশ্বাসের মিশ্র মাধ্যম ‘ফাইন্ডিং মেমোরিজ়’ বেশ ভাল। ভাস্কর্যের তুলনায় পাথর, বালি, সোনালি রাংতা ব্যবহার করে ‘মেন্ডিং পার্সপেক্টিভ’-এর রচনাটিতে অতিরিক্ত সাদা পটভূমির বাহুল্য ছবির অসম্পূর্ণতাকে স্পষ্ট করে। হাত ভাল, ভাবনাও, তবে সুদেষ্ণা সাহাকে আরও বেশি সহজ করে চিন্তা করতে হবে, বিশেষত কম্পোজ়িশনে। শুভঙ্কর ভদ্রের ‘চেকমেট’ অন্য রকম বার্তা দেয়। অন্যটি দুর্বল। প্রিয়ঙ্কা দে যৌন নিগ্রহের বিরুদ্ধে ছবিতে প্রতিবাদী হতে গিয়ে খবরের কাগজের ছবির ও সংবাদের ইমেজকে দুর্বল ভাবে কাজে লাগিয়েছেন। বহু নারীমুখের বিচিত্র অভিব্যক্তিময় মিশ্র মাধ্যম ‘ট্রান্সফার’ চমৎকার। ২০টি ছোট প্রতিকৃতিতে অতিরিক্ত বর্ণবাহুল্যে স্মিতহাস্য ও আপাতবিষণ্ণ মুখগুলির নীরব অভিব্যক্তির রূপটি বেশ ধরেছেন সুতপা দে।
রিমঝিম সিংহ দাশগুপ্তের রঙিন ক্যানভাসের অ্যাক্রিলিক বড্ড কাঠিন্যময়। সুস্মিতা সিংহরায়, দীপান্বিতা বিশ্বাস, রণিতা দেবনাথ, শ্রীলেখা দাস প্রমুখ চেষ্টা করেছেন একটি নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছতে। কিন্তু কিছুটা দোলাচল লক্ষ করা গেলেও, লড়াইটা জারি রেখেছেন। সেটি একটি সদর্থক দিক। ভাবনাচিন্তার প্রসার ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ধ্রুপদী ঐতিহ্য থেকে পরবর্তী শিল্পকলার বিবর্তনকে বুঝতে হবে। অস্মিতা বিশ্বাস আহামরি নয়, ছবির দুর্বলতা বড্ড প্রকট। অনির্বাণ সর্দারের আলোকচিত্রের ব্যবহারে কোনও মুনশিয়ানাই ধরা পড়ে না।
সৃজিতা সরকার, লীনা দস্তিদারের কাজে কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ পরিস্ফুট হয় না। দুর্বলতর দিকগুলি নিজেদেরই খুঁজে, চিহ্নিত করে, পরিহার করতে হবে। ছবি তৈরির উল্লিখিত শর্তকে সব দিক থেকেই বুঝে নিয়ে, নতুন চিন্তাভাবনার প্রসার ঘটানোই লক্ষ্য হওয়া উচিত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy