শিল্পসমাহার: দেবভাষা আয়োজিত প্রদর্শনী ও শিল্পমেলার চিত্রকর্ম। —নিজস্ব চিত্র।
দেবভাষা গ্যালারির তরফে শিল্পী যোগেন চৌধুরীকে সম্মান জানানো হচ্ছে গত এক বছর ধরে। প্রত্যেক মাসে তাঁর একটি করে প্রদর্শনীর আয়োজন করছে তারা। এ বারে কুড়িটি ছবির সম্ভার নিয়ে এই ধারাবাহিক প্রদর্শনী, নাম ‘যো অন যো’। তারই সঙ্গে উদ্যাপিত হল ভিন্ন স্বাদের এক শিল্পমেলা।
গ্যালারির তরফ থেকে যোগেন চৌধুরীকে বলা হয়েছিল, বহু যুগ আগে তাঁরই করা কুড়িখানা ছবি তাঁকে দেওয়া হবে এবং সেই ফেলে আসা কাজের উপরে তিনি ফের আঁকবেন, সেগুলোকে পুনরায় দেখবেন— পরিমার্জিত করবেন। এখানে যেন শিল্পী নিজেই নিজের মাস্টারমশাই। সেই ভাবে সৃষ্টি হল ‘যো অন যো’।
শিল্পীর নিজের পুরনো কাজগুলি যেন এখানে তাঁর কাছে সাদা পাতা। খুব সহজ মুখাবয়বের উপরে ক্রস হ্যাচিং দিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা সব ছবি সৃষ্টি করেছেন শিল্পী। যে পুরনো রেখাগুলি ছিল ছবির উপরে, আবার নতুন করে রেখা দিয়ে তারও উপরে রং ব্যবহার করে, অলঙ্করণ করে নতুন নতুন ছবি সৃষ্টি করলেন তিনি। কিন্তু আগের যে ইমেজটা ছিল, সেটাকে বাতিল করলেন না। পুরনো ছবির সঙ্গে তুলনা করলে বোঝা যায় যে, আগের ছবিতে মোটা পেন দিয়ে যে ড্রয়িংটি ছিল, তার উপরে নানা রকম রং ও তুলি দিয়ে, ক্রস হ্যাচিং করে, কোথাও রঙের প্যালেটটাই পাল্টে দিয়ে ছবিগুলিকে নতুন জীবন দিয়েছেন।
২০১৭ সাল থেকে শিল্পমেলার আয়োজন করছে দেবভাষা। বাংলার শিল্পজগতের অগ্রগণ্য শিল্পীদের কাজের পাশাপাশি সমসাময়িক শিল্পীদের কাজও থাকে সেখানে। সঙ্গে থাকে ছাত্রছাত্রীদের কাজও। প্রায় তিনশোর বেশি কাজ ছিল এ বারের শিল্পমেলায়। কিউরেটররা এক-এক শিল্পীকে এক-এক ধরনের কাজ করতে অনুরোধ করেছিলেন এ বার এবং কাগজের মাপও বলে দিয়েছিলেন। যে রকম কৃষ্ণেন্দু চাকীকে বলা হয়েছিল, ৭০টি ছোট মাপের ছবি করতে, মেলার কথা মাথায় রেখে। লালুপ্রসাদ সাউকে বলা হয়েছিল ক্রেয়ন নয়, শুধু পেন অ্যান্ড ইঙ্ক-এ ক’টা ড্রয়িং করে দিতে। আবার কোনও শিল্পীকে বলা হয়েছিল, বিশেষ মাপের কাগজে ক’টা ল্যান্ডস্কেপ করে দিতে। কেউ আবার কাগজে শুধু প্যাঁচা এঁকেছেন। আর এক শিল্পীর কাছে সেরামিক্সের কাজ চাওয়া হয়েছিল। কোনও শিল্পী সরার কাজ করে দিয়েছেন। এই ভাবেই সমস্ত কাজের মধ্যে সুন্দর ভাবে এক ভিন্নতা সৃষ্টি করা হয়েছে। গণেশ হালুই, লালুপ্রসাদ সাউ, রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীদের সকলেই নতুন কাজে সাজিয়েছেন এই মেলা।
এ বারের শিল্পমেলায় কে জি সুব্রহ্মণ্যমের শতবর্ষ পূর্তির আগে শিল্পীর স্মৃতিতে শ্রদ্ধা জানালেন গ্যালারির দুই কিউরেটর। মেলায় যাঁদের ছবি আছে, তাঁরা হলেন—অতুল বসু, হরেন দাস, সোমনাথ হোর, রেবা হোর, সনৎ কর, রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, গণেশ হালুই, লালুপ্রসাদ সাউ, পি আর পানেসর, যোগেন চৌধুরী, শুভাপ্রসন্ন, গৌতম চৌধুরী, অরুণিমা চৌধুরী, সুশোভন অধিকারী, চন্দন দাস, অলয় ঘোষাল, বিমল কুণ্ডু, প্রদীপ রক্ষিত, সৌমিত্র কর, কৃষ্ণেন্দু চাকী, ছত্রপতি দত্ত, অরূপ সেনগুপ্ত, ইন্দ্রপ্রমিত রায়, পার্থ দাশগুপ্ত, তন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, অতীন বসাক, ইলিনা বণিক, রজত সেন, পার্থ সাউ, অর্পিতা প্রধান, রঞ্জন সরকার, পার্থপ্রতিম গায়েন, টুম্পা চৌধুরী, সুজিত দাস, প্রণবেশ মণ্ডল, কৃষ্ণেন্দু রায়, মৈনাক চক্রবর্তী, সোমেন খামরুই এবং কৌশিক দাস।
প্রদর্শনীতে অতুল বসুর কাগজে পেন্সিল দিয়ে ১৯৩৬ সালে আঁকা কিছু অতুলনীয় ড্রয়িং ছিল। তার মধ্যে একটি ড্রয়িংয়ের নাম ‘বাবু’। কাগজে সমস্তটা ছেড়ে দিয়ে পেন্সিল দিয়ে করা। মাথা মুখ কিছু নেই, কিন্তু বাবুর দাঁড়ানোর ভঙ্গিটি লক্ষণীয়।
২০২৩ সালে গণেশ হালুইয়ের করা কাগজে কালি এবং সরু ব্রাশে একটি নিসর্গের ছবি চোখ টানে। এই ছবিতে নদী, নৌকা, গাছ, ফুল, পাতা, ঘাস... প্রকৃতির অনেক উপাদানই পাওয়া গেল। এ ছবি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী। নিসর্গের এই ছবিতে খুব সামান্যই বিমূর্তকরণ দেখা যায়। হয়তো শিল্পী কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে চেয়েছেন।
শিল্পী হরেন দাসের কিছু ছাপাই ছবি দেখা গেল। সুন্দর সব ছবির মধ্যে একটি ছবি ১৯৪৭ সালে করা, উডকাট। ছাপ নেওয়া হয়েছে কাগজে। এই ছবিতে আছে রাতের অন্ধকারে নৌকায় একটি পরিবার মাছ ধরতে যাচ্ছে। সেখানে অন্ধকার এবং নদীর জলে বিচ্ছুরিত জ্যোৎস্নার আলো। খুবই সুন্দর ছবিটি।
কৃষ্ণেন্দু চাকীর করা কাগজে গোয়াশের কাজে অনেকগুলি মুখোশ দেখা গেল। নানা অভিব্যক্তি তাদের মুখে। এ ছাড়া ছিল ছোট ছোট ল্যান্ডস্কেপ। শিল্পীর কাজের বৈচিত্র অবাক করে। ছোট ছোট সুন্দর ফিগার পেন্টিংও করেছেন। ছিল জন্তু-জানোয়ারের ছবি। একটি ঘুমন্ত বিড়ালের দিক থেকে চোখ ফেরানো যায় না। বিশেষত, কাগজে গোয়াশের কাজে জলরঙের মতো কাগজ ছেড়ে যে ল্যান্ডস্কেপগুলি করেছেন শিল্পী, কোথাও মসজিদ, কোথাও গির্জা, কোথাও বা মন্দির— সেগুলি খুবই আকর্ষক।
শিল্পমেলার আর্ট স্টলে ছিলেন বল্লরী মুখোপাধ্যায়, বাপ্পা ভৌমিক, অভি রায়, সুদীপ্ত অধিকারী, সঙ্গীতা চন্দরা। যোগেন চৌধুরীর অভূতপূর্ব এক প্রদর্শনীর সঙ্গে সঙ্গে খুবই পরিশীলিত, রুচিসম্পন্ন একটি শিল্পমেলা দেখার সুযোগ হল দর্শকের। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ছবির সমারোহ এখানে দেখা যায়নি। ছবির মনোনয়ন এবং তার পাশাপাশি ছবির মানও বেশ উঁচু দরের ছিল এই প্রদর্শনীর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy