পরম্পরা: চারুবাসনায় আয়োজিত প্রদর্শনীতে হরেন দাস ও সুশান্ত চক্রবর্তীর চিত্রকর্ম। —নিজস্ব চিত্র।
বাংলার ছাপাই ছবির কিংবদন্তি শিল্পী হরেন দাসের প্রত্যক্ষ ছাত্র সুশান্ত চক্রবর্তী। শিক্ষক সম্পর্কে তিনি বলছিলেন, ‘‘মাস্টারমশাইকে উৎসর্গ করে একটা প্রদর্শনী করার ইচ্ছে হয়েছিল। প্রস্তাব শুনে যোগেন চৌধুরী খুশি হন। কখনও ভাবিনি, ওঁকে পাশে রেখে আমার নিজস্ব শৈলীকে তুলে ধরতে পারব।’’ সম্প্রতি চারুবাসনার সুনয়নী চিত্রশালায় গুরু-শিষ্য বাহিত যুগ্ম কাজের ছাপচিত্র নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন চিত্রশিল্পী সুশান্ত চক্রবর্তী। হরেন দাসের দুর্লভ ছবি জোগাড় করার পিছনে ছিল, শিল্পীর পুত্র প্রিন্টমেকার চন্দন দাসের অকুণ্ঠ সহযোগিতা।
আয়তাকার গ্যালারির প্রথম অংশটি ছিল বাংলার ঐতিহ্যবাহী ছাপাইচিত্রের অন্যতম ধারক হরেন দাসের চোদ্দোটি গ্রামীণ জনপদের অসাধারণ সরল চিত্র। ভিতরের দিকে ছিল সুশান্ত চক্রবর্তীর নিজস্ব ভুবনের মোট চোদ্দোটি নতুন বাঁকের গল্প।
শিল্পী হরেন দাস যে সময়ে পল্লিগ্রাম নিয়ে আঁকছেন, সেটা দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তরের সময়। এই হাহাকারের প্রতিধ্বনি ফুটে উঠেছিল শিল্পজগতের প্রায় প্রতিটি স্তরে। কিন্তু উনি সেই বিষয়ের মধ্যে যাননি। প্রত্যন্ত গ্রামবাসীদের শ্রমকে দিনের পর দিন অনুভব করেছেন। ফলে তাঁর রচনায় বিভিন্ন প্রান্তর থেকে নিংড়ে নেওয়া সব মুহূর্ত উঠে এসেছে।
১৯৬২ সালে করা একটি অসামান্য ছবির শিরোনাম, ‘কিয়ারোস্কুরো’। পড়ন্ত এক বিকেলে উজ্জ্বল ও অনুজ্জ্বল সমাবেশে, সাদা কালোর নির্বাক বসতির উক্ত ছাপচিত্রটি ভীষণ ভাবে নাড়া দেয়। পরিপ্রেক্ষিত, স্পেস, নিখুঁত ড্রয়িং ও বিস্ময়কর বুলির (উডকাটার যন্ত্র) আঁচড়ে সৃষ্টি এই কাজ দেখে শিল্পীর কাছে আজও নত হতে হয়।
আর একটি প্রবল ভাবে নাড়া দেওয়ার মতো ছবি, ‘ফিশিং ৩’ (১৯৮৬)। রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে দুই নারীর বয়ে নিয়ে যাওয়া মৃদু আলোয়, একই ছন্দে মাছ ধরার সতর্ক ভঙ্গিটির মধ্যে রয়েছে শ্রমের অভ্যাস। মিহি খোদাইকৃত ‘অ্যাট দ্য পন্ড’ (১৯৯১) ছাপচিত্রটি কুটির-লাগোয়া জলাশয় থেকে সদ্য উঠে আসা সিক্ত রমণীর কেশচর্যায় সমস্ত গ্রামের মেয়ের সৌন্দর্যকে যেন স্বাগত জানায়।
এক দিকে ’৪৭-এর দেশভাগের সন্ত্রাস। আর এক দিকে শিল্পীর সূক্ষ্ম বুলির ছোঁয়ায় পড়ন্ত বিকেলে গরুর পাল চলেছে গৃহমুখে। অনবদ্য রিলিফের নির্মাণে ছবিটির নাম ‘হোমওয়ার্ডস’ (১৯৪৭)। একের পর এক ছবিতে তিনি সৌন্দর্যের মোড়ক খুলেছেন। যেমন, বাজার অভিমুখী গ্রামীণ জনপদের ‘টুওয়ার্ডস মার্কেট’ ছবিটি। প্রতিটি ছবিতে আলোর ব্যবহার বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। শৈল্পিক অন্তর্দৃষ্টির গুণে, গ্রামের অমলিন, মেঠো সুর ছড়িয়ে পড়েছে, সরলতার মাধুর্য নিয়ে। কোনও জটিলতা প্রকরণের দিকে তিনি যাননি। হরেন দাস এবং ছাপাই চিত্রকে আলাদা করা সম্ভব নয়। একে অপরের ছায়ায় তারা পরিবৃত।
মূলত একই ছবির প্রতিলিপি পাওয়ার জন্য ছাপাই ছবির উদ্ভব। পদ্ধতি হিসেবে উডকাট, লিনোকাট, ধাতব প্লেটে এচিং, এনগ্রেভিং, লিথোগ্রাফ ইত্যাদি প্রচলিত। প্রদর্শনীতে দেখা গেল দুই শিল্পীর পরম্পরায় উডকাটের কাজ। আগ্রহী শিল্পীরা এই কর্মধারার সঙ্গে পরিচিত অনেক দিনই। কিন্তু পেন্টিং যতটা সহজে আয়ত্তে আনা যায়, প্রিন্ট পদ্ধতির নির্মাণ একেবারেই সহজ নয়। একবার ভুল হয়ে গেলে, ঠিক করা মুশকিল। রিলিফ প্রিন্টের পদ্ধতি হল কাঠ খোদাই। যে অংশটি ছাপা হবে, সেটি অবিকল রেখে, যে অংশটি ছাপা হবে না, তা উডকাটার যন্ত্র বা বুলি দিয়ে সাবধানে কেটে ফেলা হয়। এর পরে সমস্ত জায়গায় হ্যান্ড রোলার দিয়ে ছাপার কালি লাগাতে হয়। একাধিক ছবি পাওয়ার জন্য, প্রতি বারই খোদিত কাঠে কালি বুলিয়ে ছাপ নেওয়া যায়। কেটে ফেলা অংশে যেন রং না লাগে, সে দিকে খেয়াল রাখতে হয়। বাংলায় ছাপচিত্রকে শিল্পের অন্যতম অগ্রণী মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার শীর্ষে রয়েছেন নন্দলাল বসু, মুকুল চন্দ্র দে, রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী প্রমুখ শিল্পীরা।
সুনয়নী চিত্রশালার ভিতরের দেওয়ালে সাজানো ছিল বিশিষ্ট চিত্রকর ও মুদ্রণরীতির শিল্পী সুশান্ত চক্রবর্তীর সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী কাজ। এ বারের প্রদর্শনে নিবেদিত হল তাঁর ’৮২ থেকে ’৯০ সাল পর্যন্ত প্রিন্টমেকিংয়ের আধুনিক নমুনা।
ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে ঢোকার পরে অধ্যাপক দিলীপেশ্বর ভট্টাচার্যের নজরে পড়ে যান সুশান্ত। সেই প্রসঙ্গ টেনে শিল্পী বলেন, ‘‘আমার পেন্টিংয়ে গ্রাফিক্স কোয়ালিটি আছে, এ কথা জানান উনি। দিলীপবাবুর কথাতেই আমি বেহালায় হরেন দাসের বাড়িতে গিয়ে ব্যক্তিগত ভাবে শিখতে শুরু করি। উনি তখন গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক।’’ গ্রাফিক্সের যাবতীয় পাঠ গ্রহণ করলেও, সুশান্তর ছবিতে কোনও ভাবেই তাঁর মাস্টারমশাইয়ের ছাপ পড়েনি। তিনি যদি সম্পূর্ণ অনুসরণকারী হতেন, তা হলে সুশান্তের নিজস্ব সৃষ্টির কোনও সুযোগ থাকত না।
হরেন দাস ছাড়াও সুশান্ত বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট ছিলেন শিল্পী সোমনাথ হোর, সনৎ কর, শ্যামল দত্ত রায়ের কাজের প্রতি। বলা যেতে পারে, বিবর্তনের নিয়মে, অন্নদাপ্রসাদ বাগচী থেকে রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এবং হরেন দাস পর্যন্ত কাঠ খোদাইয়ের ধারাবাহিকতার অন্যতম উত্তরসূরি সুশান্ত চক্রবর্তী।
দেশভাগের ফলে জন্মভূমি ছেড়ে চলে আসা শিল্পীর পরিবার হাওড়ায় বসবাস শুরু করেছিলেন। সেই যন্ত্রণা, নতুন শহরের পরিবেশ তাঁর ছবিতে প্রতিফলিত হয়। কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেলেও, সৃষ্টির গঠনগত ভারসাম্যকে সুন্দর ভাবে তিনি উপস্থাপন করেছেন।
গ্যালারিতে প্রদর্শিত ছবিগুলির মধ্যে প্রথমেই যেটি আকর্ষণ করে, সেটি হল চিত্রপট জুড়ে নিয়ন্ত্রিত ফর্ম। ছবির ভাষা সরাসরি বুঝিয়ে দেয় বিষণ্ণ সুর এবং অব্যবস্থার পৃথক স্থিতি। যেমন উড এনগ্রেভিংয়ের জমাট নিদর্শনে ‘ভিলেজ কাউন্সিল’ ছবিটি চরম বাস্তবতার প্রতিলিপি। সময়ের অবসরে মায়াবী আলো-আঁধারির প্রেক্ষিতে, মধ্যবয়সিদের আড্ডাশিবিরে ফুটে ওঠে সাত নারীর ভিন্ন ভিন্ন সমালোচনার অভিব্যক্তি। ‘নাট সেলার’ বা বাদাম বিক্রেতার পরিমিত কম্পোজ়িশনে বাল্যশ্রমের চেহারায় অতিরিক্ত সাদার ব্যবহার বিত্তবান শ্রেণির প্রতি তির্যক দৃষ্টি হানে।
উডকাটের ‘ফ্যামিলি গেট টুগেদার’ (১৯৮৮) ছাপচিত্রে, সূক্ষ্ম আলঙ্কারিক খোদাইয়ে, সুশান্তের মূল ধারা থেকে সরে আসার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। অতি সাধারণ একটি মুহূর্তের দুর্দান্ত ব্যতিক্রমী কম্পোজ়িশন ‘ব্রেকফাস্ট’। সামান্য ভাঙচুরের চেষ্টায়, সময়কে ধরে রাখার অভিপ্রায়ে ফর্মটিকে একটি ঘড়ির কন্টুর মনে করা বিচিত্র নয়। আর একটি নতুনত্বের আমেজে চলার ছবি ‘পিচার’ বা কলস। জ্যামিতিক ফর্মের আবিষ্কারে কাজটির রৈখিক ভিন্নতা মনে দৃঢ় ভাবে দাগ কাটে।
নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির অনুধাবনে প্রখ্যাত শিল্পী হরেন দাস দেশীয় ছাপশিল্পের জগতে অতীতেই নিজ স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন। ফের বিরল নমুনার সাক্ষী এই প্রদর্শনীর সংগ্রহ। পাশাপাশি আশির দশকে হরেন দাসের উদীয়মান ছাত্র ও শিল্পী সুশান্ত চক্রবর্তীর সাল অনুযায়ী প্রিন্টের মৌলিকত্ব নিয়ে আয়োজিত প্রদর্শনীটি শিল্পরসিকদের বিশেষ আনন্দ দেয়।
পিয়ালী গঙ্গোপাধ্যায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy