Advertisement
১৩ নভেম্বর ২০২৪
Art

মানবিকতার শৈল্পিক প্রতিবেদন

তথাকথিত প্রতিকৃতি অঙ্কনের প্রথা প্রাচীন ভারতীয় শিল্পে নেহাৎই দুর্লভ। ভারতীয় দর্শন ও ভাবাদর্শে শিল্পীরা নিজেকে সর্বদাই জারিত করেছেন ও অনন্ত সৃষ্টিকর্তার অধীনে সঁপে দিয়েছেন।

An image of the art

মুখচ্ছবি: দেবভাষায় আয়োজিত প্রদর্শনীতে শিল্পী রবীন মণ্ডল অঙ্কিত প্রতিকৃতি। —ফাইল চিত্র।

সোহিনী ধর
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০২৩ ০৯:৩৯
Share: Save:

বরিষ্ঠ শিল্পী রবীন মণ্ডল (১৯১৯-২০১৯) বাংলার তথা ভারতের শিল্প আঙিনায় এক বিশিষ্ট নাম৷ জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত মানবিকতার বিশ্বাসে ব্রতী থেকে, অগণিত শিল্পকর্মে নিমগ্ন থেকেছেন। দেবভাষা গ্যালারিতে সম্প্রতি তাঁর ২৩টি প্রতিকৃতি চিত্রণ নিয়ে ‘ফেসেস’ নামে সুষম প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল। একাধিক মাধ্যমে অঙ্কিত রবীন মণ্ডলের ছবিগুলি একটি বিশেষ সামাজিক সচেতনতা ও কর্মনিষ্ঠার পরিচয় বহন করে।

তথাকথিত প্রতিকৃতি অঙ্কনের প্রথা প্রাচীন ভারতীয় শিল্পে নেহাৎই দুর্লভ। ভারতীয় দর্শন ও ভাবাদর্শে শিল্পীরা নিজেকে সর্বদাই জারিত করেছেন ও অনন্ত সৃষ্টিকর্তার অধীনে সঁপে দিয়েছেন। শিল্প ছিল তাঁদের সাধনা ও ধ্যানের বিষয়। তাই ব্যক্তিসত্তাকে তাঁরা প্রাধান্য দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। এই কারণে অজন্তার ভিত্তিচিত্র অথবা অগণিত উৎকৃষ্ট ভাস্কর্য ও স্থাপত্যকলায় কোনও শিল্পীর নাম উল্লিখিত হতে দেখি না। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ইংরেজদের অনুপ্রবেশের ফলস্বরূপ ও মোগল সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিকৃতি অঙ্কন বিশেষ স্থান অধিকার করে এবং ঊনবিংশ শতক থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পচর্চায় প্রতিকৃতি অঙ্কনের এক বিশেষ প্রবাহ লক্ষ করা যায়। রাজন্যবর্গ, জমিদারকুল ও ধনী ব্যক্তিরা নিজেদের প্রতিকৃতি অঙ্কনের জন্য, বিদেশি শিল্পীদেরও তখন অজুরায় নিযুক্ত করতেন। কিন্তু সে প্রতিকৃতি ছিল উপস্থিত ব্যক্তির চেহারার হুবহু প্রতিচ্ছবি অঙ্কন। মূলত তেলরঙের মাধ্যমে বাস্তবসম্মত ভাবে প্রতিকৃতি অঙ্কনের ধারা সেই থেকে এ দেশে বিশেষ মানে উন্নীত হয়।

কিন্তু আধুনিকতার হাত ধরে ভাব ও ভাবনার বহিঃপ্রকাশের নিজস্বতা যেমন যেমন উন্মোচিত হতে থাকে, প্রতিকৃতি অঙ্কনের ক্ষেত্রেও শিল্পীর নিজস্ব ভাবনা ও অভিব্যক্তি প্রকাশের গুরুত্ব তেমনই প্রাধান্য পেতে থাকে। ক্যালকাটা পেন্টার্সের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিল্পী রবীন মণ্ডল সেই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী, যিনি কোনও বিশেষ মানুষের প্রতিকৃতিকে প্রাধান্য না দিয়ে, বরং তাঁর সমাজচেতনার বিশ্বাসকে অত্যন্ত দৃঢ় ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন বারংবার। ছেলেবেলায় দেখা দেশভাগ, দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষের মতো ভয়াবহতা তাঁর জীবনবোধকে ভীষণ ভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাই তাঁর বেশির ভাগ মুখমণ্ডলের মধ্যেই আমরা দেখি, দৃষ্টি অতীব বিমর্ষ, যেন আনন্দ ও উচ্ছ্বাস-বহির্ভূত। সেই কারণেই হয়তো বা নেত্রযুগল শুধুমাত্র কালো বা আঁধার রং দিয়ে ঢাকা। চোখের তারাও সেই রকমই। এ যেন সেই সুপ্রাচীন সুমেরীয় শিল্পীর মানব-মানবীদের মতো সমকালীন সমাজের কাছে জিজ্ঞাসাধীন মানুষের ছবি। অবক্ষয় ও লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে সদুত্তরের অনন্ত প্রতীক্ষায় সব চরিত্রই যেন বাকরুদ্ধ। শিল্পী রবীন মণ্ডল আজীবন বামপন্থী, সাম্যবাদের মতাদর্শে বিচরণ করেছেন। মানবিকতার নিগ্রহ ও বঞ্চনা তাই তাঁকে খুবই পীড়িত করত। সেই জন্যই হয়তো তাঁর প্রায় প্রতিটি কাজে এক নীরব আর্তির প্রকাশ— সামাজিক অনাচার থেকে মুক্তির জন্য এক শৈল্পিক প্রতিবাদী আর্তনাদ!

খুব পুরু ও মোটা ভাবে অ্যাক্রিলিক ও তেল মাধ্যমে কাজ করতে শিল্পী পছন্দ করতেন। সুদৃঢ় রেখার মাধ্যমে মুখমণ্ডলের চিরন্তন অ্যানাটমিগত বিভাজনগুলি মোটা রঙের প্রলেপ দিয়ে ঢেকে দেওয়ার প্রথা তাঁর প্রায় সব প্রতিকৃতিরই বৈশিষ্ট্য। শুধুমাত্র দু’-একটি আত্মপ্রতিকৃতি ব্যতিরেকে কাগজ, মাউন্ট বোর্ড অথবা ক্যানভাসে চিত্রিত কাজগুলিতে এক ট্যাকটাইল ফিলিং বা স্পর্শকাতর অনুভূতি লক্ষ করা যায়।

এই প্রদর্শনীতে ১৯৮৭-২০১৯ পর্যন্ত প্রায় দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে চিত্রিত মোট ২৩টি ছবির মধ্য দিয়ে দর্শক শিল্পীর দৃঢ়প্রত্যয় ও ক্রমবিবর্তনের পরিচয় পান। তবে প্রায় সব প্রতিকৃতিতেই আধিভৌতিক, মিস্টিক ও টোটেমিক স্কাল্পচারের আস্বাদ পাওয়া যায়। তা এক আদিম প্রত্নতাত্ত্বিক তরঙ্গের প্রতিধ্বনিও জাগায়। সে তুলনায় ২০১৯-এর ‘পোর্ট্রেট অব আ কুইন’ ছবিটি বেশি রঙিন ও সজীব এবং বাইজেন্টাইন মুরালের মতো বলিষ্ঠ ও উজ্জ্বল। এ যেন শিল্পীর বিদায়বেলায় পৃথিবীর কাছে এক ব্যঙ্গাত্মক সম্ভাষণ!

নিরলস শিল্পচর্চার মধ্য দিয়ে, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রবীন মণ্ডল তাঁর আদর্শ ও বিশ্বাসকে প্রতিপালিত করেছেন। তাঁর দীর্ঘ শিল্পজীবনের এই সম্ভার, শিল্পের প্রতি একাগ্রতা ও নিরন্তর চর্চার যে প্রয়োজনীয়তা, সে বিষয়ে আগামী প্রজন্মকে উৎসাহিত করবে।

অন্য বিষয়গুলি:

Art artist Art Gallery Art exhibition
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE