বাদনরত আমান আলি খান ফাইল ছবি।
অনেক দিন পরে পুরাতনকে নূতনের আলিম্পনে এঁকে তৈরি হল বিশ্ব বাংলা কনভেনশন সেন্টারে ‘পরম্পরা’ নামক একটি সরোদ-বিকেল, সরোদ-সন্ধ্যা। অনুষ্ঠান শুরুর কথা ছিল বিকেল ৪টেয়। শুরু হল খানিক দেরিতে। কারণ, তখনও দর্শক-শ্রোতা প্রেক্ষাগৃহে ঢুকে চলেছেন। পর্দা উঠতেই চমক! দাঁড়িয়ে প্রায় ৩০ ফুট উচ্চতার উস্তাদ হাফিজ আলি খানের প্রসন্ন ছবি। চিত্রশিল্পী বিমল দাসের আঁকা সেই ছবির বর্ধিত উপস্থাপনার পাশে রজনীগন্ধার শিকলে গাঁথা বিশালাকার অনুপম আলপনা। মুহূর্তে ‘মহল’ তৈরি হল দর্শক-হৃদয়ে। গ্বালিয়র রাজদরবারের সঙ্গীতকার সেই কিংবদন্তি শিল্পীর ছবির নীচে আসন পাতা হয়েছে অনুষ্ঠানের শিল্পীদের। একে একে মঞ্চে ঢুকলেন সঙ্গত-শিল্পী অনুব্রত চট্টোপাধ্যায়, ঈশান ঘোষ। এবং তার পরেই এলেন আমান আলি খান। এ বিকেলে তাঁরই সরোদ-পরিবেশনা। পিতামহের ছবিতে ফুল দিয়ে আসনে বসলেন এবং অল্প কথায় সকলকে শিবরাত্রির শুভকামনা জানিয়ে ধরলেন ভীমপলেশ্রী বা ভীমপলাশি।
ভীমপলেশ্রী— বিকেলের রাগ, কাফি ঠাট, রসশৃঙ্গার। সহজ আলাপে রাগরূপ বিস্তার করলেন আমান। তার পরে জোড়-ঝালার পর্ব। এ পর্যন্ত রূপক তালে বাঁধা পরিবেশনা। সাত মাত্রার বিষমপদী তালে কেটে গেল প্রায় আধঘণ্টা। শুরু থেকেই কেলাসিত উপস্থাপনা। মনে হচ্ছিল, যেন এই পরিবেশনা আগে থেকেই ঘটে চলছিল। রূপক ছেড়ে আমান এলেন মধ্য তিনতালে এবং শেষে দ্রুত তিনতালে। গোটা উপস্থাপনায় অবরোহণের সব স্বর সুস্পষ্ট বুনটে নিবদ্ধ। মধ্যে পরিসর দিলেন তবলা-শিল্পী অনুব্রত আর ঈশানকে। আমানের গায়কি অঙ্গের সুঠাম পরিবেশনায় নববসন্তে শৃঙ্গারের, প্রেমের আবেশ তৈরিহল মঞ্চে।
প্রথম পরিবেশনা সাবেকিয়ানা বজায় রেখে নিখুঁত পেশকারি। অন্য চমকের শুরু দ্বিতীয় পরিবেশনা থেকে। আমান ধরলেন ললিতা গৌরী। ললিত আর গৌরীর সংমিশ্রণ। এই সঙ্কর রাগিণীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে রয়েছে অনেক কিংবদন্তির নাম। যাঁদের মধ্যে রয়েছেন কেশরবাই কেরকর, ভীমসেন জোশী, আলি আকবর খান এবং স্বয়ং শিল্পীর বাবা আমজাদ আলি খানের মতো বহু গুণিজন। তবে আমান এ দিন চমকে দিয়ে ব্যতিক্রমী হলেন। ললিত দুই মধ্যমের মাধুর্যে ফুটে ওঠা কাকভোরের রাগ। কোমল ঋষভ আর কোমল ধৈবতের ব্যবহারে কখনও পূর্বী ঠাটের, আবার কোমল ঋষভ আর শুদ্ধ ধৈবতের প্রয়োগে মারোয়া ঠাটের। অন্য দিকে, গৌরী মূলত ভৈরব ঠাটের রাগিণী। অনেকাংশেই বাঁকা চলনের উপসুরের সমষ্টি। তা কখনও পূর্বী-অঙ্গ গৌরী, কখনও ভৈরব-অঙ্গ, কখনও-বা শ্রী-অঙ্গের। ললিতা গৌরীতে এই দুই প্রকরণেরই ছাপ। সেখানে দুই মধ্যম, গান্ধার, নিষাদের খেলাধুলোর মাঝে পঞ্চম বিশ্রাম নেয়। সূর্যান্তের এই মিশ্র রাগিণীর পূর্বী ঠাটের চলনই বেশি শুনতে পাওয়া যায়। আমান সেখানে আচমকা কোমলে রঙিন সকাল প্রস্ফুটিত করলেন বাসন্তী ভৈরবী বিভা ছড়িয়ে। যে কম্পোজিশনটি পেশ করলেন শিল্পী, তা তাঁর বাবা আমজাদ আলি খানের। মিনিট-সাতেকের আলাপের পরে ১৪ মাত্রার আড়া চৌতাল। বাদন মিনিট-পঁচিশের। রেশ বহু ক্ষণের।
শিল্পী এ দিন বড় করে আর বাজাননি কিছু। বরং পরিবেশনায় বৈচিত্র এনেছেন নানা রাগরূপ চয়নে। পরের পরিবেশনা বিলম্বিত তিন তালে নন্দকোশ। সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তীর তৈরি এই রাগ আমানের পরিবেশনায় আগেও বহুবার শোনা গিয়েছে। এ দিনও সুন্দর, ছিমছাম এবং বাহুল্যবর্জিত উপস্থাপনা। শিল্পী এই পর্বের পরিবেশনায় দাঁড়ি টানলেন আচমকা লয় ঢিমে করে দিয়ে। তাতে নাটকীয়তা আলাদা মাত্রাও পেল।
দশ মাত্রার দ্রুত ঝাঁপতালে রাগেশ্রী ধরলেন আমান। খাম্বাজ ঠাটের শান্তি স্বয়ম্প্রকাশ হল একহারা তানের মাধুর্যে। এই শিল্পীর রাগেশ্রীর পরিবেশনাও বহু বার শোনা। এবং প্রতিবারই একটাই জিনিস মনে হয়, আর পাঁচ জনের মতো বাগেশ্রী থেকে রাগেশ্রী আলাদা করতে আমানতীব্র গান্ধারের প্রয়োগে অতি-সচেতন হন না ইচ্ছাকৃত ভাবে। তাতে অকারণ চাঞ্চল্য তৈরি হয় না। এ দিনও স্পষ্ট সপাট সপাট তানে-ধ্বনিতে সমের ঘরে ফিরলেন যত বার, মনে হল প্রতিবারই একটা দ্রুত গতির নিখঁুত অভিযাত্রা তৈরি হচ্ছে। পঁচিশ মিনিটের পঞ্চম-বর্জিত রাগেশ্রী পরিভ্রমণের মধ্যে ছ’মিনিট ছেড়ে দিলেন সতীর্থ দুই তবলা-শিল্পীকে।
সন্ধ্যায় শেষ উপস্থাপনা, খানিকটা চমকে দিয়েই, কিরওয়ানি। কর্নাটকী সুরগন্ধী এই রাগের গায়ে প্রেমের আস্তরের পাশাপাশি বিষাদের আনন্দঘন সুবাস। আমান তার পুরোটা আদায় করে ছাড়লেন। কিরওয়ানি একটু বড় করেই বাজালেন শিল্পী। প্রায় আধ ঘণ্টা। তার মধ্যে পিলুর স্ফুলিঙ্গ আগুন জ্বলে উঠল যেন, যেন উঁকি মেরে গেল দরবারি আর জৌনপুরির মুহূর্তেরাও। পাওয়া গেল আরও একটি বিষয়— তারে-আঙুলে স্পর্শ-কম্পনের মাদকতা। উপচে পড়ল মিড়। সব চেয়ে বড় বিষয়, প্রায়-অশ্রুত নয় মাত্রার মত্ত তালে পরিবেশনা। তাল নির্বাচনে ছবিটাই বদলে গেল। পরে শিল্পী এলেন তিনতালে এবং চরম দ্রুতির ঝালা-ঝঙ্কারে এ সন্ধ্যার পরিবেশনার পরিসমাপ্তি ঘটালেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy