Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Sukumar Roy

বলব যা মোর চিত্তে লাগে

১৮৮৭-১৯২৩। মাত্র ৩৬ বছর বয়স। এটুকু সময়ের ভিতরেই বাংলা সাহিত্যকে এমন এক ঝাঁকুনি দিলেন সুকুমার রায়, যে ধাক্কা আজও সামলাতে বাঙালি হিমশিম।বাংলা সাহিত্যকে এমন এক ঝাঁকুনি দিলেন সুকুমার রায়, যে ধাক্কা আজও সামলাতে বাঙালি হিমশিম।

সুকুমার রায়(বাঁ দিকে)। স্ত্রী সুপ্রভা দেবীর সঙ্গে(ডান দিকে উপরে)। বিয়ের পরে স্টুডিয়োয় তোলা ছবি। (ডান দিকে নীচে) মা বিধুমুখী, বাবা উপেন্দ্রকিশোর ও ভাইবোনদের সঙ্গে সুকুমার।

সুকুমার রায়(বাঁ দিকে)। স্ত্রী সুপ্রভা দেবীর সঙ্গে(ডান দিকে উপরে)। বিয়ের পরে স্টুডিয়োয় তোলা ছবি। (ডান দিকে নীচে) মা বিধুমুখী, বাবা উপেন্দ্রকিশোর ও ভাইবোনদের সঙ্গে সুকুমার।

আবাহন দত্ত
শেষ আপডেট: ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

ক্ষণজন্মা। শব্দটা আমরা বেশ আলগোছেই বলে থাকি। বেশি না ভেবে অনেকের সম্পর্কেই প্রয়োগ করে ফেলি। কিন্তু সত্যিই কিছু মানুষ আছেন, যাঁদের দেখলে-জানলে ওই শব্দটার অর্থোদ্ধার করা যায়। তাঁরা যেন শব্দখানাকে সংজ্ঞায়িত করেন। বাঙালি সমাজে তেমন মানুষ সুকুমার রায়। স্বল্প দৈর্ঘ্যের জীবন এবং বিপুল ও বৈচিত্রময় কর্মভাণ্ডার। সামান্য সময়ে প্রতিভার শতপুষ্প বিকশিত।

টুনি মণি খুসী তাতা

১৮৮৭ সালে ‘রাজর্ষি’ নামে একটি উপন্যাস লেখেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেখানে হাসি ও তাতা নামে দুই চরিত্র ছিল। সেই অনুসারে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর বড় মেয়ে সুখলতা আর বড় ছেলে সুকুমারের ডাকনাম ঠিক হয়। কেন? একখানা সমাজেই মিলেমিশে তাঁদের থাকা। ব্রাহ্ম সমাজ।

মধ্য কলকাতার ঠনঠনিয়া অঞ্চলে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের যে উপাসনা মন্দির ও সমাজ ভবন আছে, তার ঠিক উল্টো দিকে একটি বিশাল বাড়ি। এক কালে তা ‘লাহাবাবুদের বাড়ি’ নামে পরিচিত ছিল। ঠিকানা: ১৩ নং কর্নওয়ালিস স্ট্রিট। সুকুমারের পরের বোন পুণ্যলতার (খুসী) স্মৃতিকথায় পাওয়া যায়— “যে বাড়িতে আমাদের জন্ম হয়েছিল আর শিশুকাল কেটেছিল সেটা ছিল একটা বিরাট সেকেলে ধরনের বাড়ি। তার বাইরের অংশে আমাদের স্কুল হত, ভিতরের অংশের দোতলায় আমরা থাকতাম আর তিনতলায় আমাদের দাদামশাইরা থাকতেন।” দাদামশাইরা বলতে দ্বারকানাথ ও কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়, আর তাঁদের সন্তানেরা। বহু ব্রাহ্ম পরিবারের বাস ছিল সেই বাড়িতে। আশপাশের এলাকার নাম ছিল ‘সমাজ-পাড়া’ বা ‘ব্রাহ্ম-সমাজ পাড়া’। এমনই এক ব্রাহ্ম কর্মক্ষেত্রে, আন্দোলনে, আদানপ্রদানে, সাহচর্যে সুকুমারের বড় হয়ে ওঠা। জীবনের প্রথম আট বছর কাটে এই বাড়িতেই।

উপেন্দ্রকিশোরের সব ছেলেমেয়ের মধ্যেই আশ্চর্য সাহিত্যপ্রতিভা বিকশিত হয়েছিল। ‘আরো গল্প’, ‘গল্প আর গল্প’, ‘নিজে লেখ’, ‘নিজে পড়’র লেখক সুখলতা রাওকে ছোটরা বেশ চেনে। পরের মেয়ে পুণ্যলতা চক্রবর্তীর ‘ছেলেবেলার দিনগুলি’ বইটি সে কালের রায়বাড়িকে এবং কলকাতাকে চেনায়। সে সময়ে বাংলার বাইরে যে ‘বাংলা’ ছিল, যেখানে সম্ভ্রান্ত বাঙালি পরিবারগুলি চেঞ্জে যেত, সেই সমস্ত কাহিনিও ধরা আছে বইখানায়। আবার ‘সন্দেশ’ পত্রিকার পাতায় পুণ্যলতার খুদে গল্পগুলি মাতিয়ে রাখত খুদে পাঠকদের। পরের ভাই সুবিনয় (মণি) কয়েক বছর ‘সন্দেশ’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। মজার গল্প লিখতেন, খেলাধুলো আর ধাঁধা নিয়ে বই প্রকাশ করেন। ছোট ভাই সুবিমলও লেখক। তাঁর ‘বেড়ালের হারমোনিয়াম’ তো সবার মন ভাল করা একখানা গল্প। সবচেয়ে ছোট বোন শান্তিলতাও (টুনী) ছোটবেলায় ‘সন্দেশ’-এ কবিতা লিখেছিলেন। তবে বলতেই হয়, এঁদের সকলের চেয়ে প্রতিভায় আলাদা ছিলেন সুকুমার।

প্রবল চঞ্চল, ফুর্তিবাজ। সব কিছুতে উৎসাহ, খেলাধুলোর পাণ্ডা। কলের খেলনা ঠুকে ঠুকে দেখত সে, কী করে চলে। বাজনা ভেঙে দেখত, কোথা থেকে আওয়াজ বেরোয়। অসীম কৌতূহল যে! ও দিকে, ছোট লাঠি হাতে ছাদময় তাড়া করে বেড়াত বোর্ডিংয়ের মেয়েদের। বিশাল তিনতলার ছাদের উঁচুতে একটা গোল ফুটো ছিল, এক বার সেটা গলে কার্নিসে নামার চেষ্টা করেছিল! সেই বয়সেই চমৎকার গল্প বলতে পারত তাতা। উপেন্দ্রকিশোরের প্রকাণ্ড একটি বই থেকে জীবজন্তুর ছবি দেখিয়ে টুনি, মণি আর খুসীকে আশ্চর্য মজার গল্প বলত। বই শেষ হয়ে গেলে জীবজন্তুর গল্প বানাত— মোটা ভবন্দোলা কেমন দুলে থপথপিয়ে চলে, ‘মন্তু পাইন’ তার সরু গলাটা কেমন গিঁট পাকিয়ে রাখে, গোলমুখে ভ্যাবাচোখ কম্পু অন্ধকার বারান্দার কোণে দেওয়ালের পেরেকে বাদুড়ের মতো ঝুলে থাকে ইত্যাদি। হেমন্তকুমার আঢ্য লিখছেন, “অসূয়াশূন্য, আঘাতশূন্য, উজ্জ্বল হাস্যরস সৃষ্টিতে আপামর বাঙালীকে যিনি মুগ্ধ করেছেন বাল্যকালের একটি নির্দোষ ক্রীড়া-কৌতুকের মধ্যে তাঁর ভাবী পরিচয় ফুটে ওঠে।”

‘রাগ বানাই’ বলে একটা খেলা ছিল তাতার। তার নিজেরই তৈরি। হয়তো কারও উপরে রাগ হয়েছে, কিন্তু শোধ নেওয়ারও উপায় নেই। তখন সে ‘আয়, রাগ বানাই’ বলে সেই লোকটার সম্পর্কে অদ্ভুত অদ্ভুত সব গল্প বানিয়ে বলতে থাকত। তার মধ্যে বিদ্বেষ বা হিংস্রভাব থাকত না, অনিষ্ট করার কথাও থাকত না, কেবল মজার কথা। তার মধ্য দিয়েই রাগটাগ জল হয়ে যেত। ‘হ য ব র ল’র হিজিবিজবিজের কথা মনে পড়তে পারে। উদ্ভট সব কল্পনা করে নিজেই হেসে গড়িয়ে পড়ত হিজিবিজবিজ!

মজা করতে যেমন পারত, তেমনই নানা বিষয়ের— বিশেষত ভাষার উপরে অসামান্য দখল ছিল ছোটবেলা থেকেই। ‘কবিতায় গল্প বলা’ নামে এক খেলা চলত তাদের বাড়িতে। বড়রাও যোগ দিতেন। কোনও একটা জানা গল্প কেউ কবিতায় বলবে, শুধু প্রথম লাইনটা। পরের জন দ্বিতীয় লাইন। এ রকম ভাবে চলতে থাকবে। না পারলে ‘পাস’। এক দিন হচ্ছে ‘বাঘ ও বক-এর গল্প’— “একদা এক বাঘের গলায় ফুটিয়াছিল অস্থি।/ যন্ত্রণায় কিছুতেই নাহি তার স্বস্তি।/ তিনদিন তিন রাত নাহি তার নিদ্রা।/ সেঁক দেয় তেল মাখে লাগায় হরিদ্রা।” কিন্তু সুন্দরকাকা মুক্তিদারঞ্জন রায় যেই বললেন ‘ভিতরে ঢুকায়ে দিল দীর্ঘ তার চঞ্চু’, অমনি সবাই চুপ। চঞ্চুর সঙ্গে মিল দিয়ে কী শব্দ হয়? ‘পাস’ হতে হতে তাতার পালা আসতেই সে বলল, “বক সে চালাক অতি চিকিৎসক চুঞ্চু।” ভাইবোনরা রাগারাগি করল, ভাবল তাতা শব্দ বানাচ্ছে। কাকা ওর পিঠ চাপড়ে বললেন, “চুঞ্চু মানে ওস্তাদ, এক্সপার্ট।”

প্রবোধচন্দ্র সেনের মত, “কবি মধুসূদনের পর বাংলার প্রধান ছন্দশিল্পী তিনজন— রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১), দ্বিজেন্দ্রলাল (১৮৬৩-১৯১৩) এবং সত্যেন্দ্রনাথ (১৮৮২-১৯২২)। এই তিন ছন্দ শিল্পী কবির পরেই উল্লেখ করতে হয় কবি সুকুমার রায়ের (১৮৮৭-১৯২৩) নাম।” মাত্র আট বছর বয়সে শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘মুকুল’ পত্রিকায় তাতার ‘নদী’ কবিতা প্রকাশিত হয়। পরের বছর দ্বিতীয় কবিতা ‘টিক্ টিক্ টং’ (মুকুল, জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৪)।

শিবনাথ শাস্ত্রীর পরিকল্পনা করা ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়ে ১২ বছর বয়স অবধি পড়তে পারত ছেলেরাও। সব ভাইবোনের মতো তাতাও ওখানেই পড়ত। পুণ্যলতা লিখছেন— “বাড়ির মধ্যেই স্কুল। এ দরজা দিয়ে বেরিয়ে ও দরজা দিয়ে ঢুকলেই হল।” সে কেমন স্কুল? শিবনাথ শাস্ত্রীর ভাবনায়— “ব্রাহ্ম পাড়ায় ছোট ছেলেমেয়েদিগকে সর্বদা সমাজের মাঠে খেলিতে দেখিয়া মনে চিন্তা করিতে লাগিলাম, ইহাদিগকে বেথুন স্কুল প্রভৃতি বিদ্যালয়ে না পাঠাইয়া এদের জন্য একটি ছোটো স্কুল করা যাক্।” দ্বারকানাথের পুত্র তথা সাংবাদিক প্রভাতচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় (জংলী গাঙ্গুলী), দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, বিজ্ঞানী তথা বসু বিজ্ঞান মন্দিরের প্রাক্তন অধ্যক্ষ দেবেন্দ্রমোহন বসু প্রমুখ এই স্কুল থেকে পাশ করেছেন।

লাল গানে নীল সুর

১৮৯৫-এ উপেন্দ্রকিশোরেরা সপরিবার বাড়ি বদল করে ৩৮/১ শিবনারায়ণ দাস লেনের বাড়িতে চলে এলে তাতা ভর্তি হল সিটি কলেজিয়েট স্কুলে। তাতা বড় হল, ‘সুকুমার’ নামটা পরিচিত হতে শুরু করল। লীলা মজুমদার লিখছেন, “তাই বলে যে তিনি হাঁড়িমুখো গম্ভীর হয়ে উঠবেন, সে-আশা করলে ভুল হবে। বরং তাঁর রসবোধ আরও পাকাপোক্ত সুদূরব্যাপী হতে থাকল।” পণ্ডিত বলতেই যে ভারিক্কি বোঝায় তা তো নয়, তা নির্ভর করে জ্ঞান-বুদ্ধির উপরে। এ সময় থেকেই সুচিন্তিত মতামত তৈরি হল সুকুমারের।

তাঁর এক মাস্টারমশাই ছিলেন বড় ভাল মানুষ, কিন্তু কড়া বায়োস্কোপ-বিরোধী। একদিনের ক্লাসে সে বিষয়ে নিজের যুক্তি সাজানোর পরে প্রিয় ছাত্র সুকুমারকেও কিছু বলতে অনুরোধ করেন মাস্টারমশাই। সুকুমার বলেন, কিছু ছবি খারাপ, সেগুলো না দেখাই ভাল, কিন্তু ভাল ছবিও আছে, আর সে সব দেখলে অনেক কিছু শেখা যায়। মাস্টারমশাই মনঃক্ষুণ্ণ হন। সুকুমার জানতে চান, আপনি বায়োস্কোপ দেখেছেন? “আমি ওসব দেখি না”— কড়া জবাব। জোর করে মাস্টারমশাইকে নিয়ে একটা ভাল ছবি দেখতে যান সুকুমার। ছবিশেষে মাস্টারমশাই জানান, “তুমি আমার একটা মস্ত ভুল ভাঙিয়ে দিলে।”

বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুকুমারের নাটকের শখ বাড়ে। ছেলেবেলায় অন্যের লেখা কবিতা বা গল্পের নাট্যরূপ দিয়ে ভাইবোন, আত্মীয়, বন্ধুদের নিয়ে অভিনয় করা হত, এ বার নিজে নাটিকা লেখা ধরলেন। শেখাতে লাগলেন অভিনয়ও। ঘরোয়া জিনিসপত্র দিয়েই দিব্যি তৈরি হয়ে গেল প্রপ— কম্বলের ধারের ঝালর, ছেঁড়া মোজা, ধোপার পুঁটলি, খড়ি, গোমাটি, চুনকালি ইত্যাদি। আর নাটিকার বিষয়? কৈশোরে রচিত ‘রামধন-বধ’ নাটকের বিষয় ছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম। ‘নেটিভ নিগার’ দেখলেই নাক সিঁটকানো র‌্যাম্‌প্‌ডেন সাহেবকে কী করে পাড়ার ছেলেরা জব্দ করল, সে গল্পই হল ‘রামধন-বধ’। তাকে দেখলেই ছেলেরা ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি দেয়, আর সাহেব তেড়ে মারতে আসে, বিদ্‌ঘুটে গালি দেয়, পুলিশ ডাকে। আবার স্বদেশি জিনিস নিয়ে বাড়াবাড়িতেও ঠাট্টা করতে ছাড়েননি সুকুমার। ভাই সুবিনয় যখন অলিগলি, বাজার খুঁজে জাপানি বা বিলিতি দ্রব্যের চেয়ে বেশি দাম দিয়ে দেশি জিনিস কিনছে, তখন দাদা গান বাঁধলেন— “আমরা দিশি পাগলার দল,/ দেশের জন্য ভেবে ভেবে হয়েছি পাগল!/ (যদিও) দেখতে খারাপ, টিকবে কম, দামটা একটু বেশি,/ (তা হক না) তাতে দেশের-ই মঙ্গল!”

ছাত্রাবস্থাতেই লিখছেন ‘ঝালাপালা’, ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’। অভিনয়ের লোক জোগাড় করতে হবে, অতএব বন্ধুবান্ধব নিয়ে তৈরি হয়ে গেল ‘ননসেন্স ক্লাব’। সাদাসিধে অনাড়ম্বর ভাবে আয়োজিত নাটকগুলি স্রেফ নাটকের গুণেই উতরে যেত। প্রায় প্রত্যেকটি নাটকেরই কেন্দ্রে থাকত কিঞ্চিৎ হাঁদা-প্রকৃতির একটি চরিত্র, যে আসলে নাটকের খুঁটি। ওই ভূমিকায় সুকুমার নিজেই অভিনয় করতেন। ‘তত্ত্বকৌমুদী পত্রিকা’র বিমলাংশুপ্রকাশ রায়ের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, “তাঁর দল গড়ে উঠেছিল অতি সহজ, স্বাভাবিকভাবে, যেমন জলাশয়ের মধ্যেকার একটা খুঁটিকে আশ্রয় করে ভাসমান পানার দল গিয়ে জমাট বাঁধে। সত্যই তিনি খুঁটিস্বরূপ, আমাদের অনেকের আশ্রয়।”

ক্লাবের একটি হাতে লেখা পত্রিকাও বার করেছিলেন সুকুমার: ‘সাড়ে-বত্রিশ ভাজা’। বত্রিশ রকমের ভাজাভুজি আর তার উপরে আধখানা লঙ্কা বসানো, তাই সাড়ে বত্রিশ। অতি উপাদেয়। সম্পাদক সুকুমার, মলাট ও অধিকাংশ অলঙ্করণ তাঁর, বেশির ভাগ লেখাও। সম্পাদকের পাতা ‘পঞ্চতিক্তপাঁচন’ বড়রাও আগ্রহ নিয়ে পড়তেন। ঠাট্টা থাকত, তবে খোঁচা নয়। মজা আর নির্মল আনন্দ।

ও দিকে, সিটি স্কুল পাশ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলেন সুকুমার। গম্ভীর লেখাতেও হাত দিলেন। বাঁধলেন দেশপ্রেমের গান: ‘টুটিল কি আজি ঘুমের ঘোর’। ১৯১০ সালে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম যুবসমিতির মুখপত্র ‘আলোক’ প্রকাশ করলেন। কিন্তু বেশি দূর এগোনোর আগেই জীবন অন্য দিকে বাঁক নিয়ে নিল। ফিজ়িক্স ও কেমিস্ট্রিতে ডাবল অনার্স নিয়ে বি এ পাশ করার পরের বছর গুরুপ্রসন্ন বৃত্তি পেলেন সুকুমার। ফোটোগ্রাফি ও ছাপাখানার প্রযুক্তিবিদ্যায় উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেতযাত্রা করলেন। ১৯১১ সালের অক্টোবর মাসে ‘এরেবিয়া’ স্টিমারে চড়ে ইংল্যান্ডের উদ্দেশে রওনা হলেন সুকুমার।

এর আগে বাড়ি বদলের কথা বলা হল। তার প্রধান কারণ ছিল উপেন্দ্রকিশোরের ফোটোগ্রাফি ও ছাপাখানার প্রযুক্তি নিয়ে উৎসাহ। বঙ্গদেশে তিনিই প্রথম হাফটোন প্রযুক্তিতে ছবি ছাপার ব্যবস্থা করেন। তার সরঞ্জাম সাজানো এবং তা নিয়ে কাজকর্মের মতো করেই বাড়িটার পরিকল্পনা ছিল। তবে শিবনারায়ণ দাস লেনের বাড়িতেও পাঁচ বছরের বেশি থাকা হয়নি তাঁদের। ১৯০০ সালে উঠে যান ২২ নং সুকিয়া স্ট্রিটে। ১৩ বছর পরে আবার ১০০ নং গড়পার রোডে।

এ সময়ে লন্ডন থেকে নিয়মিত চিঠি লিখছেন সুকুমার। বোঝা যায়, তাঁর ভাবনাচিন্তার ধারা তখনও পাল্টায়নি। দু’-একটি চিঠির দিকে চোখ রাখতে হয়। মাকে লিখছেন— “এখানে মাঘোৎসব হয়ে গেল। শুক্রবার ওয়ালডর্ফ হোটেলে মস্ত পার্টি হল। প্রায় ২৫০ লোক হয়েছিল। আমি চোগা চাপকান পরে গিয়েছিলাম। তাই দেখে অনেকে আমাকে পাদ্রি মনে করেছিল।” দিদি সুখলতাকে লিখছেন— “গত দু’বার মেল ভেতে আর্ট গ্যালারি আর মিউজিয়ম দেখতে বেরিয়েছিলাম।... খ্রীস্টমাসের ছুটিতে খুব ফুর্তি করা গেল।” আরও অনেককে লিখছেন কাজের কথা, পড়াশোনার কথা, কলেজের কথা, নতুন কাজ শেখার কথা। বাড়ির সকলের কুশল নিচ্ছেন। সে কালে বাঙালি ছেলেরা ইংল্যান্ডে পড়তে গিয়ে কেমন জীবন যাপন করতেন, সুকুমারের চিঠিগুলিতে তার একটি স্পষ্ট ছবি পাওয়া যায়।

বিলেতে গিয়ে ছাপার প্রযুক্তি বিষয়ে বিশেষজ্ঞতা অর্জন করেন সুকুমার। ১৯১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ‘ফেলো অব দ্য রয়্যাল ফোটোগ্রাফিক সোসাইটি’ উপাধি নিয়ে দেশে ফেরেন। এমনই চেয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। সুকুমার বাংলা সাহিত্য জগৎকে সমৃদ্ধ করেছেন, সে আমরা জানি। কিন্তু বাংলা মুদ্রণ জগৎকেও অনেকখানি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল বিলেত থেকে তাঁর অর্জিত পাঠ।

ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর

বিলেত থেকে ফেরার পরে ১৯১৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর ঢাকানিবাসী সুপ্রভা দেবীর সঙ্গে বিয়ে হয় সুকুমারের। ফের কলকাতায় থিতু হয়ে বসা। ১০০ নং গড়পার রোডে জমে ওঠে আড্ডার ঠেক। কখনও রসের আলাপ, কখনও গম্ভীর কথাবার্তা। তবে বাধ্যতামূলক ছিল ভাল খাওয়াদাওয়া। সোমবারে আসর বসত তাই নাম ‘মান্ডে ক্লাব’। খাওয়ার বাহার দেখে কেউ একটু বেঁকিয়ে বলতেন ‘মণ্ডা ক্লাব’। কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের লেখায় পাওয়া যায়— “Monday Club নামে তিনি এক সাহিত্য-আসর প্রতিষ্ঠা করেন। বহু গণ্যমান্য লোক এই ক্লাবের সভ্য ছিলেন। যেমন: সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, নির্মলকুমার সিদ্ধান্ত, অতুলপ্রসাদ সেন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, কালিদাস নাগ, অজিতকুমার চক্রবর্তী, সুবিনয় রায়, জীবনময় রায়, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, কিরণশঙ্কর রায়, ইত্যাদি।” মান্ডে ক্লাব নিয়ে লীলা মজুমদার লিখছেন, “একটা প্রবাদ আছে যে যারা সবচাইতে বেশি কাজ করে, তাদেরই হাতে বাড়তি ফালতু কাজ করার সবচাইতে বেশি সময়ও থাকে। এ-কথাটি যে কত সত্যি, সুকুমারের জীবনই তার প্রমাণ।”

এ বার শেষের কথা বলতেই হয়। বিলেত থেকে ফেরার পরে আর মাত্র দশ বছর বেঁচেছিলেন সুকুমার। তার মধ্যেই কত কাজ করে গিয়েছেন, হিসেব রাখা মুশকিল। ১৯১৪-য় ‘সন্দেশ’, ‘প্রবাসী’ ও ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় লেখালিখির শুরু। পরের বছর ২০ ডিসেম্বর ডায়াবিটিসে উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যু। সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের সহ-সম্পাদক নির্বাচিত হলেন সুকুমার। সঙ্গে কাঁধে তুলে নিলেন ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স, প্রিন্টার্স অ্যান্ড ব্লক মেকার্স’-এর সমস্ত দায়িত্ব; ‘সন্দেশ’ সম্পাদনার দায়িত্বও।

এর পরের কয়েক বছর প্রাথমিক ভাবে ব্রাহ্ম সমাজের বিপুল ব্যস্ততা নিয়ে কাটে। কয়েকটি ঘটনা আলাদা করে উল্লেখ্য। ১৯১৭ সালের ৯ এপ্রিল ব্রাহ্ম যুবকমণ্ডলীর উৎসব উপলক্ষে উপাসনায় ‘যুবকের জগৎ’ নামে একটি ভাষণ দেন সুকুমার। পরের বছর দু’টি ব্রহ্মসঙ্গীত লেখেন— ‘প্রেমের মন্দিরে তাঁর আরতি বাজে’ এবং ‘নিখিলের আনন্দ গান’। ১৯১৯-এ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুদিবসে মহর্ষির জীবন ও সাধন নিয়ে একটি বক্তৃতা দেন। অন্য দিকে চলতে থাকে সাহিত্যসৃষ্টি। সেই সব অমর সাহিত্যকীর্তি, যা আজও বাঙালি পাঠক সমাজকে আলোড়িত করে। ‘হ য ব র ল’, ‘হেশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরী’, ‘আবোল তাবোল’-এর লেখাগুলি জীবনের শেষ পর্যায়েই তৈরি। এই সব লেখায় গভীর অন্তর্দৃষ্টির ছাপ, পরিণত শিল্পীর ছোঁয়া। ‘অসম্ভবের ছন্দ’ প্রবন্ধে শঙ্খ ঘোষ লেখেন— “ছোটদের জন্য লেখা তাই খুব শক্ত কাজ। লেখক যদি মনে করেন চলতি সমাজের মূল্যগুলিকে ভাঙতে চান তিনি, ছোটোদের মন থেকে সরিয়ে দিতে চান ভুল সংস্কারগুলিকে, আর এইভাবে তার সামনে সাজিয়ে দিতে চান জীবনযাপনের একটা স্বাস্থ্যময় ছবি, তাহলে কীভাবে সেটা করবেন তিনি?... তাই অনেক সময়ে তাঁকে খুঁজে নিতে হয় হাসির চাল, খেয়ালখুশির হালকা হাওয়ায় তিনি করতে পারেন সেই কাজ...” ঠিক এই কারণেই সুকুমারের লেখা বিশেষ ভাবে সাবালকপাঠ্য বলে মনে করতেন বুদ্ধদেব বসু। ছন্দমিল, চরিত্রসৃষ্টি, কবিকল্পনায় তিনি সাবালক। এবং অবশ্যই ‘সিরিয়াস’ ভঙ্গি করা বহু সাহিত্যিকের চেয়ে তাঁর কলম অনেক বেশি সাবালক। কথাটা চমৎকার ভাবে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ— “তাঁর স্বভাবের মধ্যে বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির গাম্ভীর্য ছিল।”

শেষ দু’বছর রোগশয্যাতেও ‘সন্দেশ’-এর জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন সুকুমার। এ সময়েই লেখেন ‘আকাশবাণীর দল’ প্রবন্ধটি। প্রথম প্রকাশিতব্য বই ‘আবোল তাবোল’-এর অলঙ্করণ এবং পুরনো ছবিগুলির সংস্কারও তখনই। মাঘোৎসবে ছোটদের জন্য লেখেন বৃহৎ কাব্য ‘অতীতের ছবি’।

১৯২১ সালের ২ মে পুত্র সত্যজিতের জন্ম হয়। সেই মাসের শেষের দিকেই অসুস্থ হন সুকুমার। কালাজ্বর। চিকিৎসার্থে নিয়ে যাওয়া হয় দার্জিলিংয়ের লুইস জুবিলি স্যানাটোরিয়ামে। কিন্তু এই দুরারোগ্য অসুখের ওষুধ তখনও আবিষ্কৃত হয়নি। ক্রমশ স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে। সত্যজিতের ‘যখন ছোট ছিলাম’ বইয়ে সে সময়ের কথা কিছু পাওয়া যায়। আড়াই বছর বয়স অবধি অসুস্থ বাবাকে নিয়ে যেটুকু কথা তাঁর মনে ছিল, তা-ই লিখেছেন সত্যজিৎ। ১৯২৩ সালের ২৯ অগস্ট তখন খুবই অসুস্থ সুকুমার। গান শুনতে ভালবাসতেন। ২৯ অগস্ট রবীন্দ্রনাথ এসে তাঁকে ন’টি গান শোনান। তবে শরীর দ্রুত খারাপ হচ্ছিল। কয়েক দিন পর ১০ সেপ্টেম্বর মৃত্যু হয় সুকুমারের।

***

এমন পরিবারে সুকুমারের জন্ম, যে পরিবারের কথা ফিরে ফিরে আসবেই। কেননা, উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁর রক্তে মিশে ছিল বিজ্ঞানচেতনা ও সাহিত্যরস সাধনার বোধ। পিতা উপেন্দ্রকিশোর তো বটেই, তাঁর মাতামহী হলেন কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়— প্রথম মহিলা বাঙালি ডাক্তার। পিসেমশাই হেমেন্দ্রমোহন বসু ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসুর ভাগিনেয় ও ‘ফনোগ্রাফ’ ও ‘কুন্তলীন’-এর আবিষ্কর্তা। এই সমস্ত ধারা মিলেমিশেই তৈরি হয়েছিলেন সুকুমার— ফোটোগ্রাফি নিয়ে গভীর লেখাপড়া ও জ্ঞান, দক্ষ পত্রিকা সম্পাদক, দুই ক্লাবের সংগঠক, আজব লেখালেখির সৃষ্টিকর্তা। সবই এক আধারে।

ঋণ: প্রস্তুতি পর্ব বিশেষ সংখ্যা: সুকুমার রায়, নানা সুকুমার: কোরক সংকলন, সুকুমার: লীলা মজুমদার, সুকুমার রায় জীবনকথা: হেমন্তকুমার আঢ্য

অন্য বিষয়গুলি:

Sukumar Roy Writer Upendrakishore Ray Chowdhury Bidhumukhi Devi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy