আজ আমি ঈশ্বর বিশ্বাসী। এক সময়ে ছিলাম না। আমার বাড়িতে কখনও পুজো হতে দেখিনি। আমার বাবা ছিলেন কড়া কমিউনিস্ট। মা তো একটা প্রদীপ পর্যন্ত জ্বালাতে পারতেন না। পরিবেশটা এমনই ছিল যে মনে হত, এ সব করলে সময় নষ্ট হয়। আমরা শুধু জানতাম, ঈশ্বর মানে সত্য। যা সুন্দর, তা-ই ঈশ্বর। সত্যাচরণ করতে হবে, তা হলেই পুজো হয়ে গেল। তবে সেই সুন্দরকে যে ঈশ্বর হিসেবে মনে ধরে রাখা যায়, সেই ভাবনা এসেছে অনেক পরে। আমাকে ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছেন যে মানুষটি, তাঁকে সঙ্গীতের জগতে সকলে গজলের সম্রাজ্ঞী বলেই জানেন। গোটা বিশ্ব তাঁকে চেনে বেগম আখতার নামে। আমার কাছে অবশ্য তিনি শুধুই আম্মি। তাঁর কাছে সঙ্গীতের তালিম পেয়েছি। আর পেয়েছি জীবনে এগিয়ে চলার শিক্ষা।
আলাদা করে তো গান শেখাতে বসতেন না কখনও আম্মি। ওঁর সঙ্গে থাকতে থাকতে সঙ্গীত ঢুকে যেত জীবনযাত্রায়। আমাদের কখনও গানের খাতা ছিল না। খাতা দেখেও যে ভাল গান গাওয়া যায়, তাতে আম্মি বিশ্বাসই করতেন না। বলতেন খাতা দেখে গান করলে সে গান কণ্ঠ থেকে বেরোতে পারে, কিন্তু অন্তর থেকে নয়। গান যদি অন্তর থেকে না-ই বেরোয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের অংশ না হয়ে ওঠে— তবে সে গান আপন হয় নাকি? এমন শিক্ষা কি শুধু সঙ্গীতে আবদ্ধ থাকে? ধারণাটাই তো বদলে দেয় জীবন। দিয়েছেও!
চেনা পথের বাইরে চলো...
খাতায় লেখা নিয়ম মেনে চলার মানুষ ছিলেন না আম্মি নিজেও। যেমন, আম্মির ঈশ্বরে বিশ্বাস ছিল যথেষ্ট। কিন্তু ধর্ম-জাতপাত নিয়ে কোনও ভেদ-বিচার ছিল না। ঈশ্বরকে পার্থিব ভাগাভাগির মধ্যে কখনও ঢোকাতে রাজি ছিলেন না তিনি। এই হিন্দু ব্রাহ্মণ বাড়ির মেয়ে তো দিব্যি আদরে-আহ্লাদে তাঁর বাড়িতে বছরের পর বছর থেকেছে। আম্মির বাড়িতে বড় কোনও ধর্মীয় উৎসব হলেও তো আমাকেই রান্না করতে বলতেন। নিজের পরিচিত সকলকে আবার ঘুরে ঘুরে দাওয়াত দিয়ে আসতেন। বলতেন, ‘‘চলে এসো আমাদের বাড়িতে। আমার মেয়ে খুব ভাল রান্না করে।’’
এক বার তো সে কী কাণ্ড। মিলাদ-উন-নবী উপলক্ষে আম্মির লখনউয়ের বাড়িতে অনেক লোক। আমাকে বলেছিলেন সে দিনের ফিরনিটা তৈরি করতে। সারা দিন ধরে আমিও সযত্ন রান্না করেছি। তার পরে বিকেলে সেজেগুজে পাড়ার মহিলাদের সঙ্গে ধর্মীয় গল্প শুনতে বসেছি। সে সব শেষে প্রসাদটাও (ফিরনি) আমাকেই আনতে বললেন আম্মি। এ বার একটু বাধা এল। মৌলবি সাহেব বললেন, ‘‘ও কেন? বাড়ির আর কোনও মেয়ে নেই? ও তো মুসলমান নয়।’’ আমার নাম তো আরবি শব্দ নয়। সে জন্য তিনি ধরেই নিয়েছেন যে, আমি মুসলমান হতে পারি না। কিন্তু আম্মিরও জেদ। তিনি বললেন, ‘‘মৌলবি সাহেব, আমার মেয়ে সচ্চা মুসলমান।’’ সঙ্গে যুক্তি দিলেন, এই মেয়েটি মিথ্যা বলে না, অন্যের জিনিসে নজর দেয় না, কারও ক্ষতি করে না। ও যদি সচ্চা মুসলমান না হয়, তবে আর কে ভাল মুসলমান? এখানে অন্তত আর কোনও সচ্চা মুসলমান নেই, যে এই কাজ করার জন্য উপযুক্ত হবে। নিজের মতো করেই বিশ্বাস তৈরি করে নিয়েছিলেন আম্মি। তাঁর কাছে ধর্ম ছিল সত্য এবং নিষ্ঠা। আর পাঁচ জনে বই পড়ে যাকে ধর্ম বলেন, আম্মি তাতে বিশ্বাসী ছিলেন না।
সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন জি এস পাঠক
আম্মির কাছে আসলে সৎ হওয়া ছিল প্রথম দাবি। যে মানুষ সত্যের কাছাকাছি থাকে না, সে সঙ্গীতের কাছেও পৌঁছতে পারে না— এমনই ছিল বিশ্বাস। আমাদেরও তেমনই শেখাতেন। আর মনে করতেন, যাঁর যাঁর ঈশ্বর, তাঁর অন্তরে থাকে। কারও কাছে সঙ্গীতও ঈশ্বর হতে পারে। অন্তর থেকে যাকে মনে করছেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানটি দেবেন, তিনিই তো ঈশ্বর। আমি তাঁর কাছে দিন কাটাতে কাটাতে এ ভাবেই ঈশ্বরে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছি।
কথায় কথায় আরও একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। এক বার বেশ দূরের একটা জায়গা থেকে এক মাজারের অনেকে এলেন আম্মির কাছে। পরামর্শ নিতে। আম্মি তিন তিন বার হজ করেছিলেন। তাই এ রকম অনেকেই আসতেন ওঁর কাছে। এই দলটি এসে জানাল, মাজার-চত্বরে কয়েক জন হিন্দু এসে থাকতে শুরু করেছেন। সেখানে তাঁরা শিবের পুজো করছেন। এর একটা বিহিত করা প্রয়োজন। তাই আম্মির কাছে এসেছেন তাঁরা। আম্মি তাঁদের সকলকে খাওয়ালেন, যত্ন করলেন। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে কোনও কথা বললেন না। শেষে তাঁরা যখন চলে যাচ্ছেন, তখন আবার নিজেরাই সে কথা তুললেন। তাঁরা খুব মানতেন বেগম আখতারকে। জিজ্ঞেস করলেন, পুজো বন্ধ হবে তো? এ বার আম্মি বললেন, ‘‘আমি এ বিষয়ে কী করতে পারি? ঈশ্বরের জায়গায় ঈশ্বরকেই তো স্মরণ করা হচ্ছে। কোনও খারাপ কাজ তো হচ্ছে না যে, আমি বন্ধ করব!’’
এই আম্মিই একদিন আমাকে বলেছিলেন— বেটা, যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস না করো, তা হলে কিন্তু মরেই যাবে। গান গাওয়া আর হবে না। আমি তো আগে এ রকম শুনিনি। আঁতকে উঠলাম। আম্মি বললেন, ‘‘দ্যাখো, এই সমাজে এক জন মেয়ে নিজের মতো গান গাইবে, কাজ করবে, ইচ্ছে মতো কথা বলবে— এ সব সহজ নয়। তার জন্য তাকত লাগে। তুমি যদি ঈশ্বরে বিশ্বাসী হয়ে যাও, দেখবে অনেক সহজ হয়ে যাবে সব কাজ।’’ আম্মি বোঝাতে চেয়েছিলেন— নিজের অন্তরের শক্তিকেই তিনি ঈশ্বর বলে মানেন। সেই শক্তিকে স্মরণ করা দরকার। তাতে বিশ্বাস রাখা প্রয়োজন। নিজের শক্তিকে নিজে বিশ্বাস না করলে জীবনে এগোনো যায় না। আমি যে সে দিন সবটা বিশ্বাস করেছিলাম, তেমন নয়। সত্যি বলতে, বয়স তখন আমার বেশি নয়। এত কিছু উপলব্ধি করার মতো মন তৈরি হয়নি। তবে আম্মি আমাকে যা যা বলতেন, তা শুনতাম। কিছু করতে বললে, করতামও। কারণ, সবটাই ওঁর সঙ্গীত শিক্ষার অঙ্গ ছিল। উনি বললেন, ‘‘তুমি যদি আমার জীবনটা বুঝতে পারো, তবে আমার গানটাও বুঝবে। এ কী কাণ্ড, সকলেই দেখছি, আমার নকল করছে। আমার নকল করার তো কোনও মানে নেই।’’ উর্দুতে বলতেন, ‘‘অগর হমে নকল করোগি, তো ইসসে অচ্ছা উয়ো লোগ হমারা রেকর্ড না খরিদ লে।’’ কারণ আম্মি বিশ্বাস করতেন, এখনকার দিনে কেউ টাকা খরচ করে নকল জিনিস কেনে না। অর্থাৎ ওঁর বক্তব্য— গুরুকে নকল করে বড় হওয়া যায় না। কেউ যদি আমার গান শোনেন, তাঁরা আমার জন্য শুনবেন। আমি বেগম আখতারের মতো গান গাই বলে শুনবেন না। বেগম আখতারের গান শুনতে হলে, তাঁর রেকর্ড কিনে নেবেন।
আম্মির অন্দরমহল...
আম্মি নিজেই আমার আগের গুরু ঠুংরির সম্রাজ্ঞী সিদ্ধেশ্বরীদেবীর কাছ থেকে আমাকে নিয়ে এসেছিলেন। সে একটা বড় গল্প। আজ থাক।
একদিন কথায় কথায় আম্মি বলেছিলেন, ‘‘আমি তোমাকে নিয়ে এসেছি কেন জানো? কারণ, আমার মনে হয়েছিল তুমি নিজের পরিচয় তৈরি করতে পারবে।’’ এই কথা শুনে আমি তো অবাক। অনেক বড় বয়সে আমি লখনউয়ে আম্মির কাছে গান শিখতে গিয়েছি। তার আগে অনেক গুরুর কাছে শিক্ষা লাভ করেছি। কিন্তু সব সময়েই জানতাম, গুরুর মতো অবিকল গাইতে পারলে, তবেই ভাল হবে আমার গান। আর আম্মি কিনা বলছেন, তাঁর মতো করে না গাইতে! এই বিস্ময় চাপতে পারিনি। প্রকাশ করে ফেলেছিলাম। আমার ভাবনাটা শুধরে দিলেন তিনিই। মনে করিয়ে দিলেন, আমার আগের গুরু নিজের ক্ষেত্রে সেরা। তাঁর কাছে কিছু শিখতে পারা ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু সঙ্গীত শেখা মানে গায়কি নকল করা নয়। নিজের পায়ে দাঁড়াতে গেলে অন্যেরটা নকল করলে চলে না। গুরুর থেকে পাওয়া শিক্ষা নিজের মতো করে তুলে ধরতে হবে বিশ্বের দরবারে। তা হলেই নিজের জায়গা তৈরি হবে। সঙ্গে বললেন, তাঁর ছাত্রী সে কাজ করার মতো যোগ্য হয়ে উঠলে, তবেই তিনি বেঁচে থাকবেন। না হলে তাঁর মৃত্যু ঘটবে! আমি বললাম— আপনি কেন মরবেন? শুধু মরার কথা! তার কোনও উত্তর আসত না। আমি বলতাম— আপনি সব সময়ে বেঁচে থাকবেন। আর আম্মি বলতেন, ‘‘আমাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব তোমার উপরে।’’
মাঝেমাঝেই জিজ্ঞেস করতাম, আম্মি, আপনাকে কী দেব? শুনেই বলতেন, ‘‘আমাকে আবার কী দিবি? আমার আবার কী দরকার?’’ কিন্তু আমার তো ইচ্ছে করত ওঁকে ভাল কিছু দিতে। কখনও কোনও কিছুই দেওয়ার সুযোগ পেতাম না। শেষে হয়তো নিজের মতো করেই হঠাৎ সাধারণ কিছু একটা কিনে ফেলতাম। তা দেখেও যে কী খুশি হতেন! সকলকে বলতেন, ‘‘দ্যাখো, আমার মেয়ে কী দারুণ জিনিস দিয়েছে!’’ একটা শাড়ি দিলেও যে কী হইহই করতেন। কিন্তু ওইটুকুই। তার পরে দেখা যেত, সেই জিনিসটার চেয়ে আরও অনেক বেশি দামি কিছু একটা উপহার তিনি আমার জন্য কিনে আনলেন। কখনও কারও থেকে কিছু পাওয়ার আশা করতেন না। শুধু যত্ন করে সকালের চা করে দিলে ওঁর মন ভাল হয়ে যেত। তাতে কখনও ‘না’ বলতেন না।
যে দিন আম্মি চিরতরে চলে যাবেন, তার দিন কয়েক আগে আমার দিল্লির বাড়িতে এসেছিলেন। আমাকে সে সময়েই বললেন, ‘‘বেটা, আমাকে বাঁচিয়ে রেখো। এটাই তোমার গুরুদক্ষিণা।’’ আম্মি প্রথম বার আমার থেকে কিছু চাইলেন। কিন্তু কী কঠিন সেই দাবি। তাঁকে বাঁচিয়ে রাখব কিনা আমি! তিনি তো নিজের গুণেই পরিপূর্ণ। কে না জানে তাঁকে!
এর অনেক বছর আগেই আম্মির জীবনী রেকর্ড করেছিলেন ‘মিলাপ’ পত্রিকার এক সাংবাদিক। আম্মির ছোটবেলা থেকে লড়াই করে বড় হওয়া-সহ তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের নানা অধ্যায় আমি তখনই ভাল করে শুনেছিলাম। তবে সেই রেকর্ডটা আমার কাছেই রয়ে গিয়েছিল। বলেছিলেন, যদি কেউ তাঁকে নিয়ে কিছু লিখতে চান, তা যেন তাঁর মৃত্যুর পরেই লেখা হয়। বেঁচে থাকতে থাকতে নিজের বিষয়ে আর কিছু শুনতে চাননি তিনি। তবে ১৯৭৪ সালে আম্মির মৃত্যুর পরে অনেক চেষ্টা করেও আর সেই সাংবাদিকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। তাই আম্মির দেওয়া সেই সাক্ষাৎকারের রেকর্ড আমার জিম্মাতেই থেকে গিয়েছে। সেই সাক্ষাৎকারের জন্যই বুঝতে পেরেছি, আম্মি কেন এত মানুষের মধ্যেও একা বোধ করতেন। কেন আমাদেরও একা থাকার মতো মনের জোর রাখতে বলতেন। কেন এত আনমনা থাকতেন অমন নামী এক সঙ্গীতশিল্পী।
মঞ্চে মগ্ন বেগম
আম্মি আসলে ছোটবেলা থেকে জেনেছেন, কোনও কিছুই সহজে পাওয়া যায় না। সব কিছুর জন্যই কোনও মূল্য দিতে হয়। ভাবতে পারেন, এক জন মহিলার সাত-সাত বার গর্ভপাত হয়ে গিয়েছে। তার পরেও কি কেউ মন থেকে ভাল থাকতে পারে? এ কি সহজ কথা? লোকে বলত, আব্বার (ইশতাক আহমেদ আব্বাসি) সঙ্গে নাকি আম্মির ভাল সম্পর্ক ছিল না। তা কিন্তু ঠিক নয়। আমি থেকেছি ওঁদের সঙ্গে টানা ন’টা বছর। ওঁদের সন্তান ছিল না। আমাকে দু’জনেই সস্নেহ আগলে রেখেছিলেন। আম্মির মন খারাপ থাকত বলে অনেকে ভাবতেন, ওঁরা সুখে নেই। আসলে তা নয়। নিজেদের মতো করে থাকতেন ওঁরা। অনেকে বলতেন, আব্বা গান করতে দেননি আম্মিকে। তা-ও ঠিক নয়। আম্মি নিজেই বিয়ের পরে গান ছেড়ে দিয়েছিলেন। চেয়েছিলেন মন দিয়ে সংসার করতে। যে মানুষটা ন’বছর বয়স থেকে গান গেয়ে উপার্জন করেছেন, তিনি তো কখনও ছুটি চাইতেই পারেন। ভেবেছিলেন অনেক সন্তান হবে। সাজিয়ে-গুছিয়ে তাদের বড় করবেন। তাদের জন্য রান্নাবান্না করবেন। কিন্তু বারবার আঘাত পেয়ে, ভাল থাকার আশায় শেষে ফিরেছিলেন আবার গানেই। অনেক ছোটবেলা থেকে গান গেয়েছেন তো। একটু অন্য রকম জীবন চেয়েছিলেন। পাননি। সেই সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময়ে আম্মির কথা শুনে যে সবটা বুঝতে পেরেছিলাম, তেমন নয়। তবে সেই সাক্ষাৎকার আমাকে সাহায্য করেছে ধীরে ধীরে আম্মিকে বুঝতে। যত বয়স বেড়েছে, অভিজ্ঞতা বেড়েছে, আমিও নতুন করে আম্মিকে চিনেছি। আম্মি কী ভাবে নিজের জীবন দিয়ে ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে শিখেছিলেন, সে কথা বুঝেছি। আম্মি চলে গিয়েছেন চল্লিশ বছরের উপরে। কিন্তু আজও হঠাৎ তাঁর কোনও একটা কথা মনে পড়লে বুঝি, কত গভীর ছিল তাঁর ভাবনা। জীবনের মানে বদলে বদলে যায় এ ভাবেই।
সবের মাঝে একা…
এক বার আম্মি বলেছিলেন— ‘‘অগর জিন্দগি মে কামিয়াব হোনা হ্যায় তো তনহাই কে সাথ দোস্তি কর লো!’’ অর্থাৎ জীবনে কৃতকার্য হতে চাইলে একাকিত্বের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নিতে হবে। একলা থাকার যদি অভ্যেস করে নাও, তা হলে একটা পুরো ব্রহ্মাণ্ড তোমার সামনে খুলে যাবে। সব কাজে এগিয়ে যেতে পারবে। দুনিয়ায় কেউ কারও জন্য তো সারা জীবন থাকতে পারে না। একা তো চলতেই হবে। আম্মির মৃত্যুর পরেও পদে পদে ওঁর নির্দেশগুলোই মনে পড়েছে। একা চলার সময়ে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে তাঁর সব কথাই।
কত কী যে সহ্য করতে হয়েছে আম্মিকে! অনেকে বলেন, আম্মির মা মুশতারি বেগম নাকি তওয়াইফ ছিলেন। আম্মিও নাকি তা-ই ছিলেন। এ কথা মোটেও ঠিক নয়। আম্মির মা মুশতারি ‘বাই’ ছিলেন না। তিনি ছিলেন ফয়জ়াবাদ হাইকোর্টের মুনসেফের মেয়ে। মুশতারি বেগমকে আইন মেনে বিয়ে করেছিলেন এক সৈয়দ ঘরানার ব্যারিস্টার অসগর হুসেন। তবে মুশতারি ছিলেন তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। সেটা বিয়ের সময়ে মুশতারির বাবাকে জানাননি অসগর হুসেন। মুসলমানেরা চার বার বিয়ে করতে পারেন ঠিকই, তবে তার জন্য আগের পক্ষের স্ত্রীর অনুমতি লাগে। এ ক্ষেত্রে তেমন কিছুই হয়নি। তাই স্বামীর বাড়িতে ঠাঁই হয়নি তাঁর। বিয়ের রাতে মুশতারিকে তাঁর স্বামী জানান, প্রথম পক্ষের স্ত্রীর অনুমতি নেওয়া হয়নি। ফলে সে বাড়িতে তাঁকে তখনই নিয়ে যেতে পারবেন না। আসলে লোকে সব সময়ে কোনও গল্প চায়। তাই গল্প বানাতেও থাকে। আমি বলছি না তওয়াইফ হওয়া খারাপ। তাঁরা খুব শিক্ষিত মানুষ। অনেকে ভাবেন তাঁরা দেহব্যবসা করেন। কিন্তু তাঁদের মতো উচ্চ মার্গের সঙ্গীতশিল্পী কমই হয়। অনেকেই জানেন না, তওয়াইফ হওয়ার জন্যও বংশ পরিচয় লাগে! যে কেউ চাইলেই তওয়াইফ হয়ে যেতে পারেন না। তবে আম্মিকে নিয়ে মিথ্যে রটনাই হয়েছে। সেই কাজটা ঠিক নয়।
অসগর হুসেন আম্মির মাকে বলেছিলেন, অনুমতি পেলে বাড়ি নিয়ে যাবেন। তবে সে দিন কখনও আসেনি। ওঁর মা থেকে যান ফয়জ়াবাদেই। বাবা লখনউয়ে ফিরে যান। এর পরেই মুশতারি বেগম জন্ম দেন দুই যমজ বোন জ়োহরা আর বিব্বী (আখতারি) সৈয়দের। ছোটবেলাতেই জ়োহরা মারা যায়। শোনা যায়, ওঁদের বাবার বাড়ি থেকে বিষ দিয়ে দেওয়া হয়েছিল দুই বোনকে মারতে চেয়ে। কোনও মতে বিব্বী বেঁচে যান। এর পরে আম্মি আর আম্মির মা বেঁচে থাকার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। মারাত্মক দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে তাঁদের। সেই লড়াইয়ের সূত্রেই আম্মির গান গাওয়া শুরু। গানের জন্যই বারবার বদলেছে তাঁর নামও।
প্রথমে যখন গান করতে শুরু করলেন আম্মি, তখন ‘আখতারি বাই ফয়জ়াবাদি’ নামটা নিলেন। নিলেন বলাও ঠিক নয়। তখন যিনি আম্মির গুরু ছিলেন, তিনি সেই নামটা নিতে বলেছিলেন আম্মিকে। কারণ তখনকার দিনে গানের জগতে ‘বাই’ নাম থাকাটা খুব সম্মানের ছিল। তিনি মনে করেছিলেন, সেই নামে পরিচয় বাড়লে আরও ভাল ভাল কাজ পাবেন বিব্বী। সেই নাম নিয়েই আম্মির প্রথম কলকাতায় আসা। তখন তো কলকাতায় গানের খুব রমরমা। এখানে এসে রিপন স্ট্রিট চত্বরের একটি বাড়িতে থাকতেন আম্মি আর ওঁর মা। এখান থেকেই গানে নাম করলেন। প্রথম রেকর্ডও এই শহরেই। পরে মুম্বইও গিয়েছিলেন। তবে চলচ্চিত্র জগৎ বিশেষ পছন্দ হয়নি আম্মির। শুধু দু’জন বন্ধু ছিলেন ওই জগতের। মদনমোহন আর কইফি আজ়মি। বহু দিন পর্যন্ত তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল আম্মির।
আম্মি যখন বিয়ে করলেন, তত দিনে ‘মল্লিকা-এ-গজ়ল’ হিসেবে যথেষ্ট পরিচিতি হয়েছে তাঁর। আব্বা, ইশতাক আহমেদ আব্বাসি ছিলেন কাকোরির নবাব পরিবারের ছেলে। বিলেতফেরত ব্যারিস্টার ছিলেন তিনিও। এ বার বেগম ইশতাক আহমেদ আব্বাসি নাম হল আম্মির। এটি তাঁর তৃতীয় নাম। গোটা আট বছর যখন তিনি গানের মধ্যে ছিলেন না, এই নামই ছিল তাঁর পরিচয়। এই সময়ের নানা ঝড়-ঝাপটার পরে যখন তিনি সঙ্গীতে ফিরলেন, তখন নতুন করে তাঁর পরিচয় ছড়াল বেগম আখতার নামে। তাঁর এই নামটা দিয়েছিলেন তখনকার রেডিয়োর প্রোগ্রাম এগজ়িকিউটিভ এল কে মলহোত্র। কিছু দিনের মধ্যে এই নামটাই ছড়িয়ে পড়ল দিকে দিকে— রেডিয়োর এই নতুন কণ্ঠ ঘিরে। দেশ-বিদেশে নাম ছড়াল তাঁর। এখনও ভাবলে অবাক লাগে, কী করে এমন এক জন মানুষ, নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার ভার দিলেন আমার কাঁধে! তিনি তো নিজ গুণেই জীবিত। তবে গুরুর দেওয়া দায়িত্ব পালন করে চলেছি আমি। বছর বছর তাঁর স্মরণে সঙ্গীতের আসর আয়োজন করি। নামী গায়কেরা তাতে অংশগ্রহণ করেন উৎসাহের সঙ্গে।
আম্মির স্মরণে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আসার নিমন্ত্রণ নিয়েই এক বার পৌঁছে গিয়েছিলাম পণ্ডিত রবিশঙ্করের কাছে। কথায় কথায় তিনি বলেছিলেন, নামী সঙ্গীতজ্ঞের পরিবারের সন্তান না হলে গানে নাম করা যায় না বলেই মনে করেন অনেকে। অথচ তিনি এবং আম্মি কেউ পেশাদার গায়কের পরিবারের নন। ডাক্তার-ব্যারিস্টারের এই দুই সন্তান কী ভাবে সঙ্গীতের দুনিয়ায় নিজেদের স্থান অর্জন করে নিয়েছেন, তা ভাবলেই নাকি আনন্দ হত তাঁর। এই উদাহরণটা আমাকে প্রেরণা দিয়েছে বরাবর। আমাদের মতো যাঁরা পেশাদার সঙ্গীতকারদের সন্তান নন, তাঁরা এমন মানুষদের দেখেই সাহস পান এগিয়ে চলার!
অনুলিখন: সুচন্দ্রা ঘটক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy