সৈয়দ মুজতবা আলী।
অনবদ্য ‘চাচা কাহিনী’ লিখেছিলেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী। বছর দুয়েক আগে। আনন্দবাজার পত্রিকায়। এক জমায়েতে তাঁর চাচা জানতে চেয়েছিলেন ভাইপোর পড়াশোনার খবর। বিদগ্ধ পণ্ডিতের ভাতিজা বলে কথা! সাধারণ জবাবে কি মান থাকে? তাই ভাতিজার জবাব ছিল, ‘তড়ড়ষড়মু’। জবাব শুনে হো হো করে হেসে উঠেছিলেন বিদগ্ধ কাকা। তার পরে ভরা মজলিসে অবাক হয়ে থাকা মুখগুলোকে স্বাভাবিক করতে কাকা ব্যাখ্যা করে জানিয়েছিলেন, তড়ড়ষড়মু মানে প্রাণিবিদ্যা!
সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার। সম্পর্কে তিনি সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাতিজা। মোয়াজ্জেম আলী তাঁর নিজস্ব চাচাকাহিনিতে শ্রদ্ধেয় কাকাকে নিয়ে অনেক কথা বলেছিলেন। সেই সব ঘটনা একই সঙ্গে সরস এবং পাণ্ডিত্যপূর্ণ। একবার একজন আড্ডায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। দর্শনপ্রার্থীর বাহন ছিল মার্সিডিজ়। তা দেখে আলী সাহেবের প্রশ্ন, গাড়ির নাম মার্সিডিজ় হল কেন, তা কি আরোহী জানেন? গাড়ির মালিক নিরুত্তর। আলী সাহেব জানান, যিনি প্রথম গাড়ি বানিয়েছিলেন তাঁর মেয়ের নাম মার্সিডিজ়।
মুজতবা আলীর পরিচয়ে দু’টি বিশেষণ অবধারিত, রসবোধ এবং প্রবল পাণ্ডিত্য। রসবোধের এমন প্রাবল্য হবে না কেন? রবীন্দ্রনাথ প্রথম দেখায় যে ছাত্রকে বলেছিলেন, ‘ওহে, তোমার মুখ থেকে তো কমলালেবুর গন্ধ বেরোচ্ছে!’ মুজতবা আলী শ্রীহট্ট তথা সিলেটের বাসিন্দা। আর সিলেট কমলালেবুর জন্য বিখ্যাত। সে কারণেই এমন সম্ভাষণ। রবীন্দ্রনাথ ও মুজতবা আলীর সংবাদ আরও রয়েছে। শান্তিনিকেতনে পড়তে এসেছেন মুজতবা আলী। ‘রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করলেন, কী পড়তে চাও? আমি বললুম, তা তো ঠিক জানিনে তবে কোনও একটা জিনিস খুব ভাল করে শিখতে চাই। তিনি বললেন, নানা জিনিস শিখতে আপত্তি কী? আমি বললুম, মনকে চারদিকে ছড়িয়ে দিলে কোনও জিনিস বোধ হয় ভাল করে শেখা যায় না। গুরুদেব আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, এ কথা কে বলেছে? আমার বয়স তখন সতেরো— থতমত খেয়ে বললুম, কনান ডয়েল। গুরুদেব বললেন, ইংরেজের পক্ষে এ বলা আশ্চর্য নয়। কাজেই ঠিক করলুম, অনেক কিছু শিখতে হবে। সম্ভব অসম্ভব বহু ব্যাপারে ঝাঁপিয়ে পড়লুম।’
এই সম্ভব-অসম্ভব বহু ব্যাপারে ঝাঁপিয়ে পড়ার ফলই বোধহয় মার্সিডিজ়ের নামকরণ, হটেনটট জাতির বৈশিষ্ট্য বা ওড়িয়া বর্ণপরিচয়ের পাঠকৌশল নিয়ে ভিয়েন বসানো। হটেনটট আফ্রিকার এক জনজাতি। তারা নাকি সহজে নতুন কোনও কিছু গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক। আলী সাহেবের লেখায় বেশ কয়েক বার পাওয়া যায় শব্দটি। এখন যদিও শব্দটিকে বর্ণবিদ্বেষমূলক বলে মনে করা হয়। কিংবা সেই ‘ঔড্র কায়দায়’ বর্ণপরিচয়, ‘ক’রে কমললোচন শ্রীহরি, খ’রে খগ আসনে মুরারি, গ’রে গরুড়...’ এর সঙ্গে যোগ করতে হবে দেশ-বিদেশের রসবতীতে তাঁর উঁকিঝুকি আর রসনা তৃপ্তির পরে সরস বর্ণনার কথা। হাঙ্গেরিয়ান গুলাশের কথা জানা ছিল। শব্দটা মিলেছিল এরিক মারিয়া রেমার্কের ‘দ্য ব্ল্যাক ওবেলিস্ক’ উপন্যাসে। আলী সাহেব জানালেন, এই হাঙ্গেরিয়ান গুলাশ আর কিছুই নয়, আমাদের বাংলার মাংসের ঝোল। ইতালির রিসোত্তো খেয়ে পাড়া মাত করায় বাহাদুরি নেই। তার সঙ্গে যে পোলাওয়ের তফাত নেই তেমন। কিংবা কায়রোর সেই চাক্তি চাক্তি মাংস, মধ্যিখানে ছেঁদা? ‘দাঁতের তলায় ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে কাটে বটে’ কিন্তু স্বাদে উমদা। তা যে আমাদের চির পরিচিত শিক কাবাব, সে তো আলী সাহেবের কাছ থেকেই শেখা। এ সবই সেই ‘অনেক কিছু শিখতে হবে’র সিদ্ধান্ত।
মুজতবা আলীর লেখায় যে বহুমুখী জিজ্ঞাসা, জ্ঞানস্পৃহার আভাস, তা বিশ্বভারতীর আবহাওয়ার দান, লিখেছিলেন হীরেন্দ্রনাথ দত্ত। বিশ্বভারতীর অধ্যাপক নিত্যানন্দ বিনোদ গোস্বামী রসিকতা করে অধ্যাপক শব্দটি উচ্চারণ করতেন ‘আড্ডাপক্ব’ বলে। তাঁর ব্যাখ্যায়, আড্ডায় পক্ব না হলে অধ্যাপনায় যোগ্যতা অর্জন করা যায় না। মুজতবা আলী সে বিষয়ে সুসিদ্ধ এবং প্রসিদ্ধ ছিলেন। অনর্গল তাঁর বাক্যস্রোত। কবিধামে নবাগতরাও তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী। ‘শান্তিনিকেতনের অন্যান্য দর্শনীয় বস্তুর সঙ্গে তিনিও একটি দর্শনীয় সামগ্রী হয়ে উঠেছিলেন।’ একবার একটি দলের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘শান্তিনিকেতনে এসেছ কী কী দেখতে? ক্ষিতিমোহনবাবুকে দেখেছ? ওরা বললে, দেখেছি। নন্দলাল বসুকে? হ্যাঁ, দেখেছি। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে? তাঁকেও দেখেছি।’ তার পরেই তাঁর উক্তি, ‘ওঃ বাঘ সিংহ সব দেখে, এখন বুঝি খট্টাশটাকে দেখতে এসেছ।’
নিজেকে নিয়ে এমন রসিকতা বহু বার করেছেন তিনি। একটি লেখায় নিজের বর্ণনা দিয়েছিলেন, ‘অত্যন্ত রোগা, সিড়িঙ্গে, গায়ের রং ছাতার কাপড়কেও লজ্জা দেবে এবং তোতলা, কথা বলার সময় মুখ দিয়ে থুতু ছোটে।’ যদিও ছিলেন কন্দর্পকান্তি। তবে মধ্য বয়সের ইন্দ্রলুপ্তময় মুজতবার ছবিই আমাদের বেশি পরিচিত। একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক মহম্মদ আবদুল ওয়ালী। একবার এই চিকিৎসক কলকাতার নামকরা কলেজের প্রাণিবিদ্যার এক অধ্যাপককে নিয়ে গিয়েছিলেন মুজতবা আলীর সঙ্গে পরিচয় করাতে। অধ্যাপককে দেখে মুজতবা আলীর জিজ্ঞাসা, ‘হঠাৎ এখানে এসে হাজির কেন?’ এমন জিজ্ঞাসায় অধ্যাপক একটু জড়সড়। ডাক্তার জানান, পরিচিত হওয়ার আগ্রহে এসেছেন। আলীসাহেব বললেন, ‘না! না! না! আসল মতলবটা হল এই চ্যাংড়া অধ্যাপকের রিসার্চ সেন্টারে জন্তু জানোয়ারের নিশ্চয় কিছু অভাব ঘটেছে। তাই আমাকে দেখতে এসেছে। পছন্দ হয় কি না?’
হীরেন্দ্রনাথ দত্তের মনে হয়েছে, শান্তিনিকেতনের বুধমণ্ডলীর মজলিসে আড্ডাপক্ব হয়েই মুজতবা আলী অনর্গল। কিন্তু তিনি নিজে কী মনে করতেন? প্রমাণ দাখিলে মহম্মদ আবদুল ওয়ালীর সাক্ষ্যই মানা যাক। তিনি লিখেছেন, প্রথম সাক্ষাতের সময়ে তিন দিন নানা বিষয়ে অবিরাম কথা বলেছিলেন আলীসাহেব। তার পরে নিজেই বললেন, ‘এই যে তোমার সাথে বকবক করলাম— এর জন্য আমি বিন্দুমাত্র দায়ী নই। এর পেছনে একটা ছোট্ট ইতিহাস আছে।’ সে ইতিহাস সটিক। পাড়ায় যিনি টিকে দেন, তাঁকে আলীসাহেবের মা বলেছিলেন ছুটির দিনে বাচ্চাদের টিকে দিতে। বাড়িতে মা ছুটির আগের দিন জানালেন, কালকে সকালে ছেলেমেয়েরা নারকেল মুড়ি খাবে।
পরের দিন আলীর ভাই-বোনেরা সকলে মিলে নারকেল মুড়ি খাচ্ছেন ঘরে বসে। মা দরজার একটি পাল্লার শিকল তুলে দিয়ে দোরগোড়ায় বসে। টিকাদার এলেন। তিনিও নারকেল মুড়ি পেলেন। নারকেল-মুড়ি খাওয়ার আনন্দে টিকাদারের উপস্থিতি গ্রাহ্যই করেননি মুজতবা আলী। খাওয়া শেষ হলে মা যখন জিজ্ঞেস করলেন টিকে দেওয়ার যন্ত্রপাতি এনেছেন? টিকাদার জানালেন, ল্যানসেটটা আনতে ভুলে গিয়েছেন। সুগৃহিণী মা বললেন, ‘বোস, আমি ব্যবস্থা করছি।’ কিছুক্ষণ পরে তিনি ‘হিজ় মাস্টার্স ভয়েস’-এর গ্রামোফোনের পিন নিয়ে হাজির। টিকেদারকে পরামর্শ দিলেন, ‘এই পিনগুলো স্পিরিটে পুড়িয়ে লিম্প দিয়ে চিরে চিরে টীকে দিয়ে দে।’ গল্প শেষ হল। মুজতবা আলী ডাক্তারকে বললেন, ‘বুঝলে ডাক্তার! ঐ যে আমাকে রেকর্ড-পিন দিয়ে টীকে দেওয়া হলো, সেই থেকে হিজ মাস্টার্স ভয়েসের ইয়োর্স ফেথফুল সার্ভেন্টের মত সারা জীবন বকেই চলেছি।’
সে বকা ‘ফালতো’ নয়। খুব সাধারণ ঘটনা থেকে রসসঞ্চার করতে পারতেন। একবার পুজোর ছুটিতে আলীসাহেবের সঙ্গে একদল ভক্ত কলকাতায় ফিরছেন। সঙ্গে সেই ব্যক্তিগত চিকিৎসক। স্টেশনে এসে জানা গেল, ট্রেন ৪৫ মিনিট দেরিতে চলছে। মুজতবা আলী প্রস্তাব দিলেন, রেস্তরাঁয় গিয়ে সময় কাটানো যাক। কিন্তু খেতে খেতেই হঠাৎ ট্রেনের বাঁশির শব্দ। দলের কেউ বলে উঠেছিলেন, ‘ওই বোধহয় ট্রেন এসেছে।’ খাওয়াদাওয়া ফেলে সকলে দ্রুত প্ল্যাটফর্মে। কিন্তু স্টেশনে তখন ঢুকেছে মালগাড়ি। মুজতবা আলী জিজ্ঞেস করলেন, ডাক্তারি পরিভাষায় একে কী বলে? ডাক্তার উত্তর দিতে পারেননি। রসিক মুজতবা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘একেই বলে ফলস লেবার পেন।’
কিংবা সেই বিয়েবাড়ির ঘটনা। মজলিস জমাতে মুজতবা আলীর জুড়ি ছিল না। যথারীতি এক বিয়েবাড়িতে তাঁকে ঘিরে আসর জমে উঠেছে। নতুন আত্মীয়স্বজন জামাইয়ের সঙ্গে শাশুড়ির পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। শ্যালক-শ্যালিকারা নতুন জামাইয়ের সঙ্গে মশকরা করছে। হঠাৎ জামাই শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করে বসল, ‘আপনি কিছুক্ষণ আগে জলে পড়ার কোনও শব্দ শুনতে পেয়েছেন কি?’ শাশুড়ি কিছু বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলেন। খোলসা করলেন জামাই, ‘অগ্নিসাক্ষী করে এই যে আপনি আপনার মেয়েকে জলে ফেলে দিলেন, তার কি কোনও আওয়াজ শুনতে পাননি?’
গুরুগম্ভীর বিষয়ও তাঁর উপস্থাপনায় হয়ে উঠত রসগ্রাহী। বিভিন্ন জাতি নিয়ে তাঁর সরস গল্প আছে বহু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো গম্ভীর বিষয়। প্রবল লড়াই চলছে তিন জাতির মধ্যে। জাতিগুলি হল, ফরাসি, জার্মান আর ইংরেজ। এক বৃদ্ধ শিখ মেজর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর খবরে একটু বিমর্ষ। তিনি প্রতিপক্ষ কারা জানতে চাইলেন। জানানো হল, ইংরেজ আর ফরাসিরা মিলে জার্মানির বিরুদ্ধে লড়ছে। সর্দারজি একটু আক্ষেপ করলেন, কোন দেশ হারলে বিশ্বের কী ক্ষতি হতে পারে, তা নিয়ে। তাঁর আশঙ্কা, ফরাসি হারলে দুনিয়া থেকে সৌন্দর্যের চর্চা উঠে যাবে। আর জার্মানি হারলেও খারাপ। কারণ বিশ্বের জ্ঞানবিজ্ঞান কলাকৌশল শেষ হয়ে যাবে। আর ইংরেজ হারলে? সর্দারজি চুপ। চাপাচাপিতে বললেন, ইংরেজ হারলে দুনিয়া থেকে বেইমানি লোপ পেয়ে যাবে।
আবার জাতিতত্ত্ব। আর একটি গল্প। চারটি জাতির পরিচয় এক একটি বাক্যে এঁকে ফেলেছিলেন। তাঁর লেখা থেকেই জানতে পারি, ইংরেজ, ফরাসি, জার্মান আর স্কচেরা কেমন! জাতিতত্ত্বের রস কেমন করে জারিয়েছিলেন? একবার চার জন মিলে চড়ুইভাতি করার পরিকল্পনা করল। ঠিক হল সকলে কিছু না কিছু আনবে। কথা মতো ইংরেজ আনল বেকন আর আন্ডা। ফরাসি নিয়ে এল এক বোতল শ্যাম্পেন। জার্মান নিয়ে এল ডজনখানেক সসেজ। কিন্তু স্কচ বন্ধু সঙ্গে নিয়ে এল ভাইকে। প্রচলিত যে, স্কচেরা নাকি ভীষণ কঞ্জুষ হয়!
এমন রসিক মানুষটি ছোটবেলায় কেমন ছিলেন? ডাকাবুকোই ছিলেন। দাদা মুর্তাজা আলী ভাইয়ের সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন একটি লেখায়। তখন মুজতবা আলীর বয়স চার বা পাঁচ বছর। ইনস্পেক্টর জেনারেল অব রেজিস্ট্রেশন মিস্টার জে হেজলেট চাড়াভাঙ্গা গ্রামে আলী সাহেবদের বাবার দফতর পরিদর্শনে আসেন। সেই সময়ে নির্জন এক গ্রামে ইংরেজ সাহেবের আসার খবরে বাসিন্দাদের মধ্যে বেশ উত্তেজনা। অফিসের চারপাশে মেলার ভিড়। সাহেব বারান্দায় বসে এক মনে কাগজপত্র দেখছিলেন। তাঁর বাঁ হাতের কবজিতে বাঁধা ঘড়িটি বেশ দামি। সকলের নজর এড়িয়ে ছোট্ট মুজতবা সাহেবের ঘড়িটি হাত দিয়ে পরখ করতে চেয়েছিলেন। হেজলেট ‘অমায়িক’ ব্যক্তি। তিনি হেসে ছেলেটির পরিচয় জানতে চাইলেন। বাবা কাছেই ছিলেন। পরিচয় দিলেন। তিনি একটু লজ্জিত ছেলের আচরণে। কিন্তু সাহেব পরিষ্কার জানালেন, ‘নেভার মাইন্ড, হি উইল বি আ জিনিয়াস।’
ছোট্ট মুজতবার এ রকম কীর্তি আরও রয়েছে। তখন সুনামগঞ্জের পাঠশালার ছাত্র। প্রথম বার্ষিক পরীক্ষায় তাঁকে একটি কঠিন শব্দের বানান জিজ্ঞেস করা হয়। মুজতবা জানান, তিনি বানান করতে পারবেন না। কিন্তু বোর্ডে লিখে দিতে পারবেন। শিক্ষক তো অবাক এমন চটজলদি জবাবে।
মুজতবা আলীর ডাকনাম ছিল ‘সিতারা’। কাছের মানুষেরা ডাকতেন ‘সীতু’ বলে। নিজের লেখার ভণিতায় এই নামটি ব্যবহারও করেছিলেন। সেই যে মজার ‘মার্জার নিধন কাব্য’। বিয়ের প্রথম রাতেই বিড়াল মারার জনপ্রিয় গল্পটির কাব্যরূপ। তবে ভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে। ওই কাব্যের ভণিতায় লিখেছিলেন, ‘দীন সীতু মিয়া ভনে, শুনে পুণ্যবান’। ‘সিতারা’ মানে তো নক্ষত্র। ছোটবেলাতেই তাঁর তারকা হওয়ার গুণ বেশ প্রকট ছিল।
পারিবারিক জীবনে কেমন ছিলেন মুজতবা আলী? তার একটি ছবি এঁকেছেন প্রকাশক সবিতেন্দ্রনাথ রায়। সেই কাহিনি ‘শ্রেষ্ঠ রম্যরচনা’ প্রকাশ নিয়ে। বইটির প্রকাশক সবিতেন্দ্রনাথ তথা ভানুবাবুদের প্রকাশনা সংস্থা। তা বইয়ের জন্য চুক্তি হল। আলী সাহেবের কথা মতো চুক্তির কিছু দিন পরে প্রকাশক দল বেঁধে গেলেন শান্তিনিকেতনে। আলী সাহেব তাঁদের সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। তার পরে স্ত্রীকে ডাকতে শুরু করলেন, ‘ও বৌ, এসে দ্যাখো, আমার কলকাতার পাবলিশাররা এসেছে।’ স্ত্রী তো এমন সম্বোধনে অতিথিদের সামনে সংকুচিত। একটু কুণ্ঠিত ভাবে বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না, উনি বৌ বৌ করে এমন ডাকেন, যাঁরা আসেন তাঁরা এবং আমি সবাই লজ্জায় পড়ি।’
ভানুবাবু আরও মজার ঘটনা লিখেছেন। দ্বিতীয় মজা মামলা নিয়ে। মুজতবা আলীর প্রথম প্রকাশকের সঙ্গে ঝামেলা। তা নিয়ে মামলা হয়। আইনজীবীর দরকার হয়ে পড়ে তাঁর। তিনি যান ব্যারিস্টার তাপসকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। মুজতবা আলী প্রথম সাক্ষাতেই বলেন, ‘ভাই, আমি এমন একজন কৌশুলী চাই, যে আমার এই মামলাটায় আমায় হারিয়ে দেবে।’ তাপসকুমার ছিলেন সাহিত্য অনুরাগী। ফলে তাঁর হাজির-জবাব, ‘আপনি ঠিক জায়গাতেই এসেছেন। আমি এখনও পর্যন্ত একটা মামলাতেও জিতিনি।’ এমন সরস সংঘর্ষে বন্ধুত্ব হওয়াটাই স্বাভাবিক। আলী সাহেব প্যারীবাবুর বাড়িতে এলে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসতেন ব্যারিস্টারের বাড়ি।
একদিন এ রকমই আড্ডা জমেছে ব্যারিস্টারের বাড়ি। সে দিনই অধ্যাপক-প্রাবন্ধিক তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী এমা সরস এক অভিযোগ করে গিয়েছেন। তারাপদ এবং বন্ধু স্নেহাংশু আচার্য একদিন তাঁদের বাসস্থানের দোতলায় গল্প করছিলেন। এমা চা-জলখাবার নিয়ে আসছিলেন। হঠাৎ তাঁর কানে এল, টেপ রেকর্ডারে চলছে খেমটা জাতীয় গান। যাতে প্রচুর আদি রসাত্মক শব্দ। গানের কান লাল করে দেওয়া শব্দ শুনে এমার হাত থেকে খাবারদাবার সব পড়ে গেল। তারাপদ এবং স্নেহাংশু ছুটে এলেন এমা পড়ে গিয়েছেন ভেবে। কিন্তু এমা রেগে গিয়ে প্রবল ভর্ৎসনা করলেন দু’জনকে। ভদ্রলোকের ছেলেরা এ সব শুনছে! ওঁরা যতই বলেন, এটা নির্দোষ আমোদ, এমা শুনতে নারাজ।
গল্পের শেষে সুতো ধরলেন আলী সাহেব। তিনি আইনজীবীকে বললেন, ‘ব্রাদার, তুমি একবার তোমার এখানে আমার আর দোদের (স্নেহাংশু আচার্য) লড়াই লাগাও। আমার কাছে কলাবাগানের যা স্টক আছে, আমি হলফ করে বলতে পারি, তোমার দোদেদা পয়লা ইনিংসেই উড়ে যাবেন।’ আলী সাহেবের চ্যালেঞ্জ নেওয়ার গল্প তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় আদালতের বার লাইব্রেরিতে করেছিলেন। দু’-চার দিন পরে তাপসবাবুর কাছে এক জজসাহেবের চিরকুট এল। তাপসবাবু গেলেন। তিনি যেতেই জজ সাহেব দুটো একশো টাকার নোট বাড়িয়ে দিলেন। তাপসবাবু অবাক। জজসাহেব জানালেন, তিনি শুনেছেন স্নেহাংশু আচার্য এবং আলী সাহেবের ‘কী সব তরজা’ হওয়ার কথা। তাই জজসাহেব নিজের এবং বন্ধুর জন্য দুটো সিট বুক করতে চাইছেন। তাপসবাবু জানান, ও সব আলী সাহেবের কীর্তি। তাঁর বাড়িতে এমন তরজার আসর বসানোর কোনও জো নেই। আলী সাহেবের রসবোধের সুতো যে কী ভাবে লোকজনকে জড়িয়ে ধরত, এটা তারই একটা উদাহরণ।
শুধু কি বিদগ্ধ শ্রোতাদের কাছেই মুজতবা আলী তাঁর রসের প্রবাহ অনর্গল করতেন? তা কিন্তু নয়। তাঁর অনন্য রসবোধ থেকে বঞ্চিত করতেন না ছাত্র-ছাত্রীদেরও। তাতে অবশ্য কখনও কখনও সেই রসের সঞ্চারে শিষ্য বা শিষ্যার গাল লাল হয়ে যেত। সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত লিখেছিলেন সেই লালিমা ছাত্রীর কথা। ঘটনাস্থল শান্তিনিকেতন। রঙ্গমঞ্চ কালোর চায়ের দোকান। সেখানে উপস্থিত এক ছাত্রী। তিনি জার্মান ভাষা নিয়ে সদ্য পাশ করেছেন। আলী সাহেবও তখন জার্মান পড়াতেন। বিশ্বভারতীর কোনও অধ্যাপক পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন মেয়েটির সঙ্গে। তার পরেই আলী সাহেবের করাঘাত, ‘ইস, আমি জার্মান পড়াতে এলুম আর সুন্দরী তুমি বেরিয়ে গেলে। আচ্ছা দেখি কী রকম জার্মান শিখেছ। একটা খিস্তি করো তো জার্মান ভাষায়। ভয় নেই, কেউ এখানে বুঝবে না।’ আলী সাহেব এ রকমই। শোনা যায়, জার্মান ভাষায় মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার সময়েও ছাত্রীদের এই রকমই কান লাল করা প্রশ্ন করতেন।
আলী সাহেবের কথা লিখতে গেলে তাঁর পাণ্ডিত্য, রসবোধ, বাগবৈদগ্ধ্যের কথাই আলোচিত হয় বেশির ভাগ সময়ে। মানুষ অবশ্য এতেই বেশি প্রভাবিত হন। মনেও রাখেন মজার মজার সব ঘটনা। কিন্তু হাসি-মজায় মাতিয়ে রাখা মানুষটি ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ়চেতা। যা ছাত্রজীবন থেকেই তাঁর সম্পদ। সেই গল্পও শোনা যেতে পারে। তখন তিনি নবম শ্রেণিতে পড়েন। স্কুলের সরস্বতী পুজোয় বন্ধুদের সঙ্গে গিয়েছিলেন প্রশাসনিক এক বড় কর্তার বাংলোয় ফুল পাড়তে। ধরা পড়ে যান। ফলে স্কুল থেকে বিতাড়ন। অন্য দুই ছাত্র ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিল। ফলে তারা স্কুলে ফিরতে পারে। এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় দাদা মুর্তাজা আলীর লেখায়। তিনি জানিয়েছেন, ওই বাংলো ছিল ডেপুটি কমিশনারের। নাম জে এ ডসন। তিনি দোষী ছেলেদের ডেকে পাঠান। ছেলেরা গেলে তাঁর চাপরাশি পড়ুয়াদের দু’-এক ঘা বেত মারে। সালটা ১৯২১। দেশ অসহযোগ আন্দোলনে উত্তাল। আলী ছিলেন নবম শ্রেণির ছাত্র এবং ক্লাসের ফার্স্ট বয়। মারের প্রতিবাদে ছাত্ররা ধর্মঘট করল। যে সকল সরকারি চাকুরের পরিবারের ছেলেরা ধর্মঘটে যোগ দিয়েছিল, তাদের অভিভাবকদের উপরে কর্তৃপক্ষ চাপ দিতে শুরু করলেন। আলী সাহেবের বাবা তখন ডিস্ট্রিক্ট সাব-রেজিস্ট্রার। অসমে অবশ্য পদটির নাম ছিল স্পেশ্যাল সাব রেজিস্ট্রার। ডেপুটি কমিশনার বাবাকে ডেকে অসন্তোষ প্রকাশ করলেন। বাবা মুজতবাকে স্কুলে ফিরে যেতে বললেও, তিনি রাজি হননি। রাজনৈতিক আবহ থেকে ছেলেকে সরাতে ঢাকার দক্ষিণে কাজী সাহেবের গেঞ্জি বোনার কলে পাঠালেন বাবা। অবশ্য এর কিছু দিন পরে মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়ার সুযোগ পান।
ছাত্রজীবনে হাতে লেখা পত্রিকা করেছিলেন দাদা মুর্তাজা আলীর সঙ্গে। নামটা সাংঘাতিক— ‘কুইনিন’! পত্রিকার আদর্শ, অপ্রিয় সত্যভাষণ। কিন্তু পত্রিকাটি বেশি দিন চালাতে পারেননি দুই ভাই। এই দৃঢ়চিত্ততার জন্য নানা সময়ে বিপাকেও পড়তে হয়েছে মুজতবা আলীকে। তখন তিনি বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) বগুড়া কলেজের অধ্যক্ষ। একবার এক সভায় বললেন, রবীন্দ্রনাথ ইকবালের চেয়ে অনেক বড় কবি। তা নিয়ে শুরু হল প্রবল বিতণ্ডা। মৌলবাদী ছাত্ররা প্রবল ক্ষিপ্ত। মারধর খাওয়ার আশঙ্কা। আলী সাহেবের মেজদা সৈয়দ মুর্তাজা আলি বগুড়া জেলার জেলাশাসক তখন। তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি। কিন্তু বগুড়া কলেজের অধ্যক্ষের পদ ছেড়ে দেন।
আর এক বারের ঘটনা শান্তিনিকেতনে। ৭ পৌষের উপাসনায় ছাতিমতলায় তিনি আচার্য হয়েছিলেন। পরে এসেছিলেন শেরওয়ানি চোস্ত এবং ফেজ। শান্তিনিকেতনের রক্ষণশীলদের কাছে সে জন্য তাঁকে কটূক্তি শুনতে হয়। যদিও তাঁর এই ভাবনাকে স্বাগত জানানোর মতো উদারচিত্ত লোকের অভাব ছিল না।
এমন রসিক মানুষটির শেষ জীবন কেটেছে ভীষণ কষ্টে। অমিতাভ চৌধুরী ১৯৯৩ সালে একটি লেখায় লিখছেন, ‘সৈয়দদাকে শেষ দেখি কলকাতায় তাঁর পার্ল রোডের বাড়িতে। সুশীলা আসার নামে শান্তিনিকেতনের এক প্রাক্তন ছাত্রী কিছু গুজরাতি আচার দিয়েছিলেন... ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে আচারের শিশি দিতে গিয়ে সৈয়দদার চেহারা আর পোশাক দেখে আমি অবাক। ছেঁড়া গেঞ্জি, নোংরা পাজামা এবং দিন তিনেক অন্তত দাড়ি কামানো হয়নি। সুপুরুষ মানুষের এই অবস্থা। আমার চোখে জল এসে যাচ্ছিল।’ এর পরে অনেক কথা হয় দু’জনের। আলী সাহেব তখন কাশছেন ঘন ঘন। ‘কিন্তু কথায় কোনও ছেদ নেই।’ আড্ডা দিতে দিতেই বলেছিলেন, ‘দর্পহারী মধুসূদন একে একে সব কেড়ে নিচ্ছেন আমার। হাতের কলম সরে না, লিখতে কষ্ট হয়, আর না লিখতেই যদি পারি, তবে বেঁচে কী লাভ?’
মাঝেমাঝে শারীরিক সঙ্কটের জন্য আক্ষেপ করতেন বটে। কিন্তু ভাঙা শরীরেও রসপ্রবাহের কোনও ঘাটতি ছিল না। তার সাক্ষী সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত। এক সময়ে কুকুর পুষেছিলেন। অ্যালসেশিয়ান। পোষ্যটিকে ‘মাস্টার’ বলে ডাকতেন। কেন? কারণ তার প্রভু তিন গেলাসের বেশি খেতে আরম্ভ করলেই মাস্টার ঘেউ ঘেউ করে চিৎকার করতে শুরু করত। মানে প্রভুর উপরে মাস্টারি করত। মুজতবা আলী বলতেন, ‘গত জন্মে এ ব্যাটা নিশ্চয় আমার চাচা ছিল।’
বাংলা রসসাহিত্যের সেরা দুই শিউলির শেষ জীবনটা মোটেও সুখের ছিল না। একজন মুজতবা আলী। অন্য জন শিবরাম চক্রবর্তী।
ঋণ: দেশ, ‘মজলিসী মুজতবা’, ‘কলেজ স্ট্রীটে সত্তর বছর’ (দ্বিতীয় খণ্ড) কিছু ক্ষেত্রে বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy