গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সূর্যকে চেনার নেশায় মঙ্গলবার ভয়ঙ্কর দুর্গম একটি পাহাড়ের মাথায় চড়বেন দুই বাঙালি। ‘কোর্দিয়েরা দে লোস্ আন্দেস’-এ। ভারতীয় সময় রাত দশটায়। উঠবেন সাত হাজার ফুটেরও বেশি উচ্চতায়। তাপমাত্রা যেখানে শূন্যের পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচে।
চার পাশে বরফে মোড়া দুর্গম পাহাড়। অতল খাদ। এক দিকে গভীরতম প্রশান্ত মহাসাগর। পড়ন্ত বিকেলে একটু পরেই নেমে আসবে ব্ল্যাক হোলের মতো অন্ধকার। সেই হাড়জমানো ঠান্ডায় তখন আন্দিজের মাথায় চড়ে সূর্যের দিকে চেয়ে থাকবেন দুই বাঙালি। দীপঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও দিব্যেন্দু নন্দী।
মুখ পুরোপুরি ঢাকা পড়লে সূর্যের রং, ঢং কেমন হতে পারে, অঙ্কের রং, তুলি দিয়ে তার দু’-দু’টো ছবি আঁকা হয়েছে কম্পিউটারে। বানানো হয়েছে দু’-দু’টি মডেল। সেগুলি ঠিক না বেঠিক, এ বার মিলিয়ে দেখা হবে পৃথিবীর দীর্ঘতম পর্বতমালা আন্দিজের মাথায় চড়ে।
তথ্য ঋণ: সঞ্জীব সেন, অধিকর্তা, পজিশনাল অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টার, সল্ট লেক
‘ছবি’ বা মডেলদু’টি মিলে গেলেই কেল্লা ফতে! সূর্যের মনের গোপন কথা জেনে-বুঝে ফেলার কাজটা সহজ হয়ে যাবে। জানা যাবে, কী ভাবে কখন, কতটা বেশি পরিমাণে হামলা চালাতে পারে সূর্য আমাদের গ্রহের উপর বা সৌরমণ্ডলে। আগামী ১২ বছরে সেই সৌর হামলা কখন, কতটা ধেয়ে আসতে পারে পৃথিবীর দিকে, আগেভাগে তা আঁচ করা যাবে। ওই ভয়ঙ্কর হামলায় যাতে জিপিএস-সহ যাবতীয় টেলিযোগাযোগ ও বিদ্যুৎ পরিবহন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে না পড়ে, আগাম তার ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। করা যাবে উপগ্রহগুলির গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশকে রক্ষার পদক্ষেপও। মহাকাশের আবহাওয়াকে (স্পেস ওয়েদার) নিরাপদ রাখার যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া যাবে আরও আগে।
এক জন বেরিয়ে পড়েছেন বেঙ্গালুরু থেকে, অন্য জন ছেড়েছেন কলকাতা...
আন্দিজের মাথায় চড়তে দীপঙ্কর ও দিব্যেন্দু দু’জনেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন গত শনিবার, ২৯ জুন। দীপঙ্কর বেঙ্গালুরু থেকে দিল্লি ও মাদ্রিদ হয়ে চিলির স্যান্টিয়াগো ছুঁয়ে সীমান্তবর্তী আর্জেন্টিনার মেন্ডোজা বিমানবন্দরে নেমেছেন ভারতীয় সময় সোমবার রাতে। তার পর বাসে চেপে পৌঁছেছেন সান জুয়ান প্রদেশে। সেখান থেকে ফের বাসে চেপে আন্দিজে। চার ঘণ্টার জার্নি।
পাহাড়-চূড়ায় বেঙ্গালুরুর অধ্যাপক দীপঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
আর দিব্যেন্দু কলকাতা থেকে উড়ে গিয়েছেন বুয়েনস আইরেসে। রাতটা সেখানে কাটিয়ে মঙ্গলবার ভোরে উড়ে গিয়েছেন সান জুয়ানে। তার পর বাসে চেপে আন্দিজে।
আরও পড়ুন- মুঠো মুঠো সোনা, প্ল্যাটিনাম ছড়িয়ে পড়ছে মহাকাশে! ঘটকালি করছে ব্ল্যাক হোল
আরও পড়ুন- চাঁদে যাবেন বলে টাকা জমিয়েছিলেন রিতু, মই চেয়েছিলেন বনিতা
দীপঙ্কর বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের (আইআইএ) অধ্যাপক। দিব্যেন্দু অধ্যাপক মোহনপুরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইসার-কলকাতা)-এর। ভারত থেকে দুই বাঙালির সঙ্গী হয়েছেন আরও তিন জন। নৈনিতাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রমেশ চন্দ্র ও পুণের ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার অফ অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের (আয়ুকা) অধ্যাপক দুর্গেশ ত্রিপাঠী। রয়েছেন দীপঙ্করের ছাত্র ঋতেশ পটেলও।
বিকেল ২টা ৩৮। আর্জেন্টিনা থেকে হোয়াটসঅ্যাপে তাঁর অবস্থান (নীল বৃত্ত) জানালেন দীপঙ্কর। বললেন, এগচ্ছেন কোন দিকে (লাল চিহ্ন)
সূর্যের ‘মন’ বুঝতে কেন আন্দিজের মাথায় চড়তে হল দীপঙ্কর, দিব্যেন্দুকে?
কারণ, সূর্যের ‘মনের সব গোপন কথা’ই ঢাকা-চাপা থাকে সূর্যের বায়ুমণ্ডলে। যার নাম- ‘করোনা’। ঘুটঘুটে অন্ধকারে উল্টো দিক থেকে আসা গাড়ির খুব জোরালো হেডলাইটে যেমন আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে যায়, হেডলাইটের জন্য যেমন আমরা গাড়িটাকে দেখতে পাই না, ঠিক তেমনই সূর্যের পিঠ (সোলার সারফেস বা ফোটোস্ফিয়ার) থেকে ঠিকরে বেরনো জোরালো আলোয় আমরা কখনওই দেখতে পাই না তার বায়ুমণ্ডল বা করোনাকে।
সান জুয়ান বিমানবন্দরে কলকাতার অধ্যাপক দিব্যেন্দু নন্দী
সেই সুযোগটা তখনই আসে, যখন চাঁদ, পৃথিবী আর সূর্য একটি সরলরেখায় এসে পড়ে আর সূর্যের পিঠটা পুরোপুরি ঢাকা পড়ে যায় চাঁদে। তখনই হয় পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ। চাঁদে সূর্যের মুখ পুরোপুরি ঢেকে গেলেই অন্ধকার চাকতির (আদতে চাঁদ) চার পাশে দেখা দেয় আলোর রেখা। হিরের মালার মতো। সেটাই সূর্যের করোনা।
ফলে, সূর্যের পূর্ণগ্রাস গ্রহণ হলেই তার করোনাকে দেখতে পাই আমরা। যা অন্য সময়ে আমাদের ‘ধরা-ছোঁয়া’র বাইরেই থেকে যায়। তাই পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের অপেক্ষায় কার্যত চাতক পাখির মতো বসে থাকেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। যেমন অপেক্ষায় রয়েছেন দীপঙ্কর, দিব্যেন্দু-সহ পাঁচ সদস্যের ভারতীয় দল, আন্দিজে।
আর পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ এ বার যে পথে হবে সেই পথটা গিয়েছে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর থেকে মূলত চিলি ও আর্জেন্টিনার মধ্যে দিয়ে। যার গুরুত্বপূর্ণ অংশটি পড়বে আন্দিজ পর্বতমালায়।
করোনাকে দেখা কেন এত জরুরি বিজ্ঞানীদের কাছে?
সূর্যের যে রহস্যের জট এখনও পর্যন্ত খোলা যায়নি, কারণটা লুকিয়ে রয়েছে তারই মধ্যে। রহস্যটা হল সূর্যের অন্তর, অন্দর, তার পিঠ আর করোনার তাপমাত্রার অবাক করা ভিন্নতা। ফারাক। আমরা জানি, সূর্যের অন্দরে রয়েছে বিশাল একটি পরমাণু চুল্লি। যেখান থেকে জন্ম হচ্ছে অসম্ভব শক্তিশালী বিকিরণের। তার ফলে তৈরি হচ্ছে ভয়ঙ্কর তাপমাত্রা। কয়েক কোটি ডিগ্রি কেলভিন। যদিও সেই তাপমাত্রাটা থাকে সূর্যের কেন্দ্র থেকে তার পিঠের কিছুটা নীচের অংশ পর্যন্ত। যে দূরত্বটা সাত লক্ষ কিলোমিটার। আর সূর্যের পিঠ থেকে তার করোনার শেষ প্রান্তের দূরত্বটা তার দেড় গুণ। মানে, আরও ১০/১১ লক্ষ কিলোমিটার।
সূর্য-‘সন্ধানে’ পুণের অধ্যাপক দুর্গেশ ত্রিপাঠী
কিন্তু সূর্যের পিঠে পৌঁছেই তার অন্দরের সেই ভয়ঙ্কর তাপমাত্রাটা ঝপ্ করে নেমে মাত্র ৬ হাজার ডিগ্রি কেলভিন হয়ে যায়। আবার পিঠ থেকে করোনায় পৌঁছে সেই তাপমাত্রাটাই হয়ে যায় দশ লক্ষ ডিগ্রি কেলভিন।
বিজ্ঞানীদের খটাকাটা এইখানেই...
সুর্যের কেন্দ্রে যে পরমাণু চুল্লিটি রয়েছে তার তো অনেক কাছে রয়েছে সূর্যের পিঠ। তা হলে সেখানে তাপমাত্রা ঝপ্ করে নেমে গিয়ে কেন তা প্রায় দশ লক্ষ গুণ বেড়ে যা করোনায়? কী রহস্য লুকিয়ে রয়েছে সূর্যের মনে?
দীপঙ্কর বলছেন, ‘‘তার কারণ, সূর্যের অন্দরে তৈরি হওয়া চৌম্বক ক্ষেত্রগুলি। সেগুলিই সূর্যের পিঠ বা তার কিছুটা নীচ থেকে তৈরি হয়ে উঠে আসে উপরে। সূর্যের বায়ুমণ্ডল বা করোনায়। ওই চৌম্বক ক্ষেত্রগুলিই করোনাকে অতটা তাতিয়ে তোলে।’’
পূর্ণগ্রাস গ্রহণের সময় যেমন দেখতে হবে সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্রগুলি? দিব্যেন্দুর পূর্বাভাস
দিব্যেন্দু জানাচ্ছেন, কোথাও সেই চৌম্বক ক্ষেত্রগুলি উপরের দিকে উঠে আবার নেমে আসে নীচে। এগুলিকে বলা হয় ‘ক্লোজ্ড লুপ’। যা সোলার স্টর্ম বা সৌরঝড় অথবা করোনাল মাস ইজেকশানের (সিএমই) মতো ভয়ঙ্কর ঘটনাগুলির জন্ম দেয়। যা পৃথিবীর দিকে এলে ভয়ঙ্কর। আবার কোনও কোনও শক্তিশালী চৌম্বক চৌম্বক ক্ষেত্র উপরে উঠে করোনার শেষ প্রান্ত ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে গোটা সৌরমণ্ডলে। চলে যায় সৌরমণ্ডলের শেষ প্রান্তে। এগুলিকে বলা হয় ‘ওপ্ন লুপ’। ওই চৌম্বক ক্ষেত্রগুলি সূর্যের করোনা ছাড়িয়ে সৌরমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়লে তাদের আমরা বলি সোলার উইন্ড বা সৌরবায়ু। এগুলি পৃথিবীর দিকে ধেয়ে এলে মহাকাশের আবহাওয়া, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিদ্যুৎ পরিবহন ব্যবস্থার পক্ষে তা ভয়াবহ হয়ে ওঠে। চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে বিভিন্ন কক্ষপথে থাকা উপগ্রহগুলির স্পর্শকাতর যন্ত্রাংশগুলির পক্ষেও। এমনই একটি ঘটনা ঘটেছিল ১৮৫৭ সালে।
কী কী মডেল বানিয়েছেন দিব্যেন্দু?
দু’-দু’টি মডেল। একটির নাম- ‘সোলার সারফেস ফ্লাক্স ট্রান্সপোর্ট মডেল’। অন্যটি, ‘পোটেনশিয়াল ফিল্ড সোর্স সারফেস মডেল’।
পূর্ণগ্রাস গ্রহণের সময় যেমন দেখতে হবে সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্রগুলি? দিব্যেন্দুর পূর্বাভাস
সূর্যের পিঠ থেকে চৌম্বক ক্ষেত্রগুলি কী ভাবে তৈরি হয়, তার পূর্বাভাস দিতে পারে দিব্যেন্দুর প্রথম মডেলটি। আর সেই চৌম্বক ক্ষেত্রগুলি কী ভাবে উপরে উঠে করোনাকে অতটা তাতিয়ে তোলে, তার পূর্বাভাস দিতেই দ্বিতীয় মডেটি বানিয়েছেন দিব্যেন্দু। পৃথিবী থেকে ওই দু’টি মডেল পরখ করে দেখার সুযোগ এনে দিয়েছে এই পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ।
দিব্যেন্দুকে ওই দু’টি মডেল বানাতে সাহায্য করেছেন আইসার-কলকাতার তিন গবেষক ছাত্রছাত্রী- প্রান্তিকা ভৌমিক, সৌম্যরঞ্জন দাশ এবং আথিরা বি এস। সঙ্গী হয়েছেন অধ্যাপক নির্মল ঘোষও। আর গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন আইসার-কলকাতার অধিকর্তা সৌরভ পাল।
দিব্যেন্দুর মডেল নিয়ে কতটা আশাবাদী বিজ্ঞানীরা?
দুর্গেশ ও দীপঙ্কর দু’জনেই বলছেন, ‘‘এই মডেল যদি সঠিক প্রমাণিত হয় এ বার সূর্যগ্রহণে, তা হলে তা আগামী দিনে অনেক সম্ভাবনার দরজা খুলে দেবে। হয়তো আগামী বছরের শেষাশেষিই সূর্য-‘সন্ধানে’ রওনা হবে ইসরোর ‘আদিত্য-এল-ওয়ান’ মহাকাশযান। তাতে যে করোনাগ্রাফ রয়েছে, তার পাঠানো তথ্য ও ছবিগুলিকে থ্রি-ডাইমেনশনাল করে তুলতে দিব্যেন্দুর মডেল একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে।’’
দীপঙ্কর ও দিব্যেন্দুর জন্য রইল একরাশ শুভেচ্ছা। ‘আদিত্য-এল-ওয়ান’ মহাকাশে পাড়ি জমানোর আগে দিব্যেন্দুর মডেল সূর্যের মনের গোপন কথা পড়ে দিতে পারলে সৌরপদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় পথ দেখাতে পারবে ভারত। আমরা তাকিয়ে রইলাম দিব্যেন্দু, দীপঙ্কর-সহ পাঁচ ভারতীয় অভিযাত্রীর দিকে। গৌরবান্বিত হওয়ার জন্য।
ছবি সৌজন্যে: অধ্যাপক দিব্যেন্দু নন্দী, দীপঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও দুর্গেশ ত্রিপাঠী, আইসার-কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy