বিজ্ঞানে সেরার সেরা শিরোপা কী? নোবেল প্রাইজ়। আলফ্রেড নোবেলের নামাঙ্কিত এ পুরস্কারের অস্তিত্বই থাকত না, যদি না সে দিন সকালে নিউজ়পেপার স্ট্যান্ডের দিকে চোখ যেত আলফ্রেড-এর। ১৮৮৮ সালের ১২ জুন। সকালে সংবাদপত্রে বড় বড় হরফে নিজের নাম দেখে চমকে উঠলেন আলফ্রেড নোবেল। ছাপা হয়েছে তাঁরই মৃত্যুসংবাদ! শিরোনামে লেখা “মৃত্যু নিয়ে ব্যবসা করা ব্যবসায়ীর মৃত্যু।’’ পত্রিকা ভুল করে আলফ্রেডের ভাইয়ের মৃত্যুকে তাঁর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু আলফ্রেড বার্নহার্ড নোবেল বুঝতে পারলেন, তিনি মারা গেলে পৃথিবী তাঁকে কী ভাবে মনে রাখতে চলেছে। মৃত্যু ব্যবসায়ী! ঠিক করলেন, নিজের ভাবমূর্তি বদলাতেই হবে। ফলত মানবদরদি আলফ্রেডের ছায়ায় হারিয়ে গেলেন বিজ্ঞানী আলফ্রেড, ব্যবসায়ী আলফ্রেড। কী-ই না করেছেন তিনি একা হাতে! ৩৫৫টি আবিষ্কারের পেটেন্ট, লিখেছেন উপন্যাস, কবিতা, নাটক। সাধে কি ভিক্টর হুগো তাঁকে ‘ইউরোপের সবচেয়ে ধনী ভ্যাগাবন্ড’ বলেছিলেন?
১৮৩৩ সালের ২১ অক্টোবর। সুইডেনের স্টকহলমে আলফ্রেডের জন্ম। সেন্ট পিটসবার্গে বিজ্ঞানপাঠ শেষ করে আলফ্রেড গেলেন আমেরিকা, ফ্রান্স আর জার্মানিতে উচ্চশিক্ষার জন্য। প্যারিসে তাঁর সঙ্গে বিজ্ঞানী আস্কানিয়ো সোবেরোর আলাপ হল। তিনি নাইট্রোগ্লিসারিন আবিষ্কার করেছিলেন। আলফ্রেড নাইট্রোগ্লিসারিনের বিজ্ঞানটা ভাল করে বুঝে নিলেন তাঁর থেকে।
১৮৫২-তে রাশিয়ায় ফিরে যোগ দিলেন পারিবারিক অস্ত্রব্যবসায়। একই সঙ্গে নাইট্রোগ্লিসারিন নিয়ে পরীক্ষা চলতে লাগল। ১৮৬৩-তে আলফ্রেড নাইট্রোগ্লিসারিনের সঙ্গে বারুদ মিশিয়ে বানালেন ব্লাস্টিং অয়েল আর বিস্ফোরণের জন্য বানালেন ফিউজ়যুক্ত ব্লাস্টিং ক্যাপ। ক্যাপের জন্য ব্যবহার করলেন মার্কারি ফালমিনেট। দুটোরই পেটেন্ট নিলেন। কিন্তু কপাল খারাপ। যুদ্ধ শেষে সব ব্যাঙ্ক ফেল করল একসঙ্গে। আবার দেউলিয়া হয়ে নোবেল পরিবার ফিরে এল স্টকহলমে। আলফ্রেড আর ভাই এমিল নাইট্রোগ্লিসারিনের পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আর তাতেই ঘটল বিপদ। বিস্ফোরণে এমিল মারা গেলেন। বাবা ইমানুয়েল দুঃখ সইতে পারলেন না। ভগ্ন হৃদয়ে তাঁরও মৃত্যু ঘটল। পারিবারিক ব্যবসা নিজের কাঁধে তুলে নিলেন আলফ্রেড। বয়স মাত্র ৩১। চার দিকে ব্লাস্টিং অয়েলের চাহিদা বাড়ছিল হুহু করে। জার্মানি আর স্কটল্যান্ডেও কারখানা খুললেন তিনি। কিন্তু সবচেয়ে মুশকিল ছিল সুরক্ষার ব্যাপারটা। গরম কিছুর সংস্পর্শে এলে বা ধাক্কা লাগলেই নাইট্রোগ্লিসারিনে বিস্ফোরণ ঘটে শ্রমিকদের আকছার মৃত্যু ঘটত। সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটল ১৮৬৬-তে জার্মানির ক্রুমেলে। আর এই দুর্ঘটনা তাঁর জীবন বদলে দিল চিরতরে।
ক্রুমেলে গিয়ে সেখানের মাটিতে এক অদ্ভুত ধরনের সছিদ্র বালি দেখতে পেলেন তিনি। এর স্থানীয় নাম কাইসেলগুর। আলফ্রেডের মাথায় আচমকা এক বুদ্ধি এল। আদি প্রাণী ডায়াটমের দেহাবশেষ এই বালি দিয়ে পুট্টি বানিয়ে তার মধ্যে নাইট্রোগ্লিসারিন ভরে দিলেই কাজ হাসিল। সে জিনিস ধাক্কা খেলে এমনকি গরম করলেও বিস্ফোরণ হবে না। একমাত্র আলফ্রেডের ব্লাস্টিং ক্যাপ দিয়ে ডিটোনেট করলেই সুনিয়ন্ত্রিত ভাবে ফাটবে সেটা। এটাই তো এত দিন চাইছিলেন নোবেল! অন্য দিকে নিউম্যাটিক ড্রিলের আবিষ্কারে বড় বড় পাথরে ছিদ্র করা সম্ভব হচ্ছিল। আলফ্রেডের আবিষ্কারে এ বার তা ফাটিয়ে চৌচির করার কৌশলও আয়ত্ত হল। ১৮৬৭ সালে এই নতুন বিস্ফোরকের পেটেন্ট নিলেন আলফ্রেড। গ্রিক শব্দ ‘ডুনামিস’ মানে প্রবল শক্তি। সেখান থেকেই এই নতুন আবিষ্কারের নাম দিলেন ডাইনামাইট। বাকিটা ইতিহাস।
তাঁর ব্যবসা বেড়ে চলল। ২০টি দেশের ৯০টির বেশি কারখানার মালিক হলেন তিনি। সুইডেনের সবচেয়ে বড় অস্ত্র-কোম্পানি এবি বফর্স-কে কিনে নিলেন আলফ্রেড। স্থাপন করলেন একের পর এক গবেষণাগার। ব্যক্তিগত জীবনে কেমন ছিলেন তিনি? বন্ধুরা জানিয়েছেন, খুব লাজুক, একলা আর চুপচাপ ছিলেন। শরীর অশক্ত। ভুগতেন মাইগ্রেন আর হার্টের ব্যামোয়। বহু বার ব্যবসার সঙ্গীরা তাঁকে ঠকিয়েছে। ভুল বুঝিয়ে উকিল টাকা নিয়েছে।
১৮৮৭-তে আবিষ্কার করলেন সম্পূর্ণ ধোঁয়াহীন ব্যালিস্টাইট। এই আবিষ্কার এত দিনের বারুদের ধোঁয়া থেকে অস্ত্রদের মুক্তি দিল। তিনি প্রথমে ফ্রান্সকে ব্যালেস্টাইট বিক্রি করতে চাইলেও ফরাসি সরকার বিশেষ গা করেনি। ফলে তিনি ইতালিতে বিক্রি করে দিলেন। ব্যস! ফরাসি সরকার তাঁর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতা ও গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ এনে ব্যবসা, গবেষণাগার, কারখানা সব কেড়ে তো নিলই, এমনকি তাঁকে জেলে ঢোকানোর হুমকিও দিল। বেচারা আলফ্রেড ১৮৯১ থেকে ইতালির সানরেমোতে গিয়ে থাকতে শুরু করেন। হৃদ্যন্ত্রের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে লাগল। “ভাগ্যের কী অদ্ভুত পরিহাস, যে নাইট্রোগ্লিসারিন আমাকে এত কিছু দিল, এখন নিজের হৃদ্যন্ত্র সারাতে সেটাই আমাকে খেতে হবে। ওরা নামটা শুধু বদলে ট্রাইনাইট্রিন করে দিয়েছে, যাতে সাধারণ মানুষ ভয় না পায়”— এক চিঠিতে লিখছেন আলফ্রেড। সানরেমোতেই ১৮৯৬ সালের ১০ ডিসেম্বর মারা যান তিনি।
মারা যাওয়ার ঠিক এক বছর আগে একটা উইল করেছিলেন আলফ্রেড। আর সেই উইলের জন্যেই তিনি আজ বিশ্ববিখ্যাত। মৃত্যুর পর দেখা যায় উইলে আত্মীয়দের জন্য প্রায় কিছুই রেখে যাননি। বরং উইলে একটি ফাউন্ডেশন গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন। নোবেল ফাউন্ডেশন। তার কাজ হবে প্রতি বছর পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসাবিদ্যা, সাহিত্য আর শান্তির জন্য সেই বিষয়ের সেরা মানুষটাকে পুরস্কৃত করা। প্রথম দুটো পুরস্কারের ভার নেবে রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স, তৃতীয়টির রয়্যাল ক্যারোলাইনা ইনস্টিটিউট আর সাহিত্যের জন্য পুরস্কারের ভার পাবে রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি। শুরুতেই গোল বাধল। সুইডেন জানাল আলফ্রেড আদৌ সেই দেশের নাগরিক ছিলেন না। তারা এই দায়িত্ব নেবে না। একই ভাবে দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে দিল রাশিয়া, ফ্রান্স আর ইতালি। আলফ্রেড কোন দেশের নাগরিক, তা নিয়ে সবাই ধন্দে। তিনি নিজেও বলে গিয়েছেন, “আমি ঘরে বসে কাজ পছন্দ করি। আর সারা পৃথিবী আমার ঘর।” এহেন মানুষ কোনও দেশের নাগরিকত্ব নেবেন না, সেটাই স্বাভাবিক। ফরাসি কোর্টে মামলা উঠল। সে দেশেই আলফ্রেডের গোটা ভূসম্পত্তি। তর্ক-বিতর্কে আদালত সরগরম। শেষে দেখা গেল, ফরাসি আইনে আছে— যে দেশে কোনও মানুষ তাঁর নিজের ঘোড়ার গাড়ি রাখেন, সেটাই তাঁর দেশ। মারা যাওয়ার কিছু দিন আগে আলফ্রেড তাঁর ঘোড়ার গাড়িটা সুইডেনে নিয়ে গিয়েছিলেন। ফলে আইনের এই সূক্ষ্ম প্যাঁচে মৃত্যুর পরে তিনি সুইডেনের নাগরিক হয়ে গেলেন। তাঁর গোটা সম্পত্তি বিক্রি করে ৩১ মিলিয়ন ক্রোনার হল। মানে, আজকের দিনে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও কিছু বেশি। কিন্তু তার পরেও পুরস্কার চালু করা গেল না।
অশান্তি শুরু হল নোবেল শান্তি পুরস্কার নিয়ে। এর দায়িত্ব আলফ্রেড দিয়েছিলেন নরওয়ের নোবেল কমিটিকে। তখন নরওয়ে সুইডেনের অধীন। সুইডেন কিছুতেই মানবে না। এ দিকে উইল অমান্য করাও মুশকিল। অগত্যা সুইডেনের রাজা বুঝলেন, অনেক দিন ধরেই আলফ্রেড নরওয়ের স্বাধীনতার জন্য বলে আসছিলেন। তাই এমন একটা পুরস্কারের দায়িত্ব তাঁদের হাতে দিলেন যে, সেটা না মানলে পুরস্কারের কারণই বৃথা হয়ে যাবে। কী আর করা! ১৯০০ সালের ২৯ জুন রাজা দ্বিতীয় অস্কার ও তাঁর মন্ত্রিসভা নোবেল ফাউন্ডেশনকে মান্যতা দিল। ১৯০১ সালে প্রথম বারের জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হল। ১৯৬৯ সাল থেকে অর্থনীতির জন্য পুরস্কারটা আলফ্রেডের স্মৃতির উদ্দেশ্যে দেয় সুইডেনের সোয়ারিয়েস রিক্সব্যাঙ্ক বা সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অব সুইডেন। নোবেলের সমমানের পুরস্কার এটি।
বেঁচে থাকতে আলফ্রেড বলতেন “আমার মাথায় হাজার হাজার আইডিয়া কাজ করছে। এর একটা কাজ করলেই আমি খুশি।’’ মৃত্যু ব্যবসায়ী থেকে নিজেকে বিশ্বের এক পরম কল্যাণময় চরিত্র করে তুললেন তিনি। শুধু একটি আইডিয়ার জোরে।
বিজ্ঞানী, ধান্যগবেষণাকেন্দ্র, চুঁচুড়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy