-ফাইল ছবি
মাউন্ট এভারেস্টে এখনও অবিকৃত ভাবেই পাওয়া যায় হারিয়ে যাওয়া পর্বতারোহী জর্জ ম্যালোরির ‘আইস শু’। হদিশ মেলে পাহাড়ের খাঁজে আটকে থাকা মৃত পর্বতারোহীর পচন না-ধরা দেহ। এ বার পৃথিবীর দক্ষিণ মেরুতে পুরু বরফের চাদরে মোড়া অ্যান্টার্কটিকায় পাওয়া গেল এই সৌরমণ্ডল থেকে অনেক দূরের কোনও মৃত নক্ষত্রের শরীরের টুকরোটাকরা! অবিকৃত ভাবেই! যে নক্ষত্রটি ছিল আমাদের সূর্যের চেয়ে বহু গুণ ভারী। আর যার মৃত্যু হয়েছে, খুব বেশি হলে, বছরকুড়ির মধ্যেই।
গল্প নয়, নয় কোনও কল্পকাহিনীও। এই গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘ফিজিক্যাল রিভিউ লেটার্স’-এ। গত ১২ অগস্ট সংখ্যায়।
অ্যান্টার্কটিকার পুরু বরফের চাদরের নীচ থেকে তাঁরা পেয়েছেন অত্যন্ত তেজস্ক্রিয় লোহা। যা পৃথিবীতে পরমাণু অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া আর কোনও ভাবেই পাওয়া সম্ভব নয়।
যে লোহা পৃথিবীতে আছড়ে পড়েছে ২০ বছরের মধ্যে
‘আনন্দবাজার ডিজিটালে’র পাঠানো প্রশ্নের জবাবে ক্যানবেরার অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির গবেষক ডমিনিক কল জানিয়েছেন, তিনি ও তাঁর সহযোগী গবেষকরা অ্যান্টার্কটিকার কোহনেন স্টেশন থেকে ২০১৫ সালে প্রায় ১ হাজার ১০০ পাউন্ড ওজনের বরফ সংগ্রহ করেছিলেন। যেখান থেকে তাঁরা ওই বিশাল বরফখণ্ডটি সংগ্রহ করেছিলেন, অ্যান্টর্কটিকায় সেখানে বরফ জমা হয়েছে বছরকুড়ির মধ্যেই।
তার পর তাঁরা সেই বরফখণ্ডটি পাঠিয়েছিলেন জার্মানির এক গবেষণাগারে। তাকে গলানো ও পরিস্রুত করার জন্য। তার পর গবেষকরা সেই গলানো ও পরিস্রুত বরফখণ্ডটিকে রেখেছিলেন একটি মাস স্পেকট্রোমিটারের নীচে। তার মধ্যে কী কী রয়েছে, তা জানা ও বোঝার জন্য।
জার্মানির গবেষণাগারে হদিশ মিলল কীসের?
ডমিনিক কলের কথায়, ‘‘মাস স্পেকট্রোমিটারই আমাদের প্রথম জানায়, অ্যান্টার্কটিকা থেকে আনা সেই বরফখণ্ডের মধ্যে রয়েছে অত্যন্ত বিরল ও পৃথিবীতে একেবারেই অস্থায়ী তেজস্ক্রিয় লোহা। যে লোহার পরমাণুর নিউক্লিয়াসে রয়েছে ২৬টি প্রোটন ও ৩৪টি নিউট্রন। লোহার এই আইসোটোপটির নাম- ‘লোহা-৬০’।’’
ডমিনিক জানিয়েছেন, তাঁরা অ্যান্টার্কটিকা থেকে আনা সেই বরফখণ্ডটি থেকে লোহার পাঁচটি আইসোটোপ পেয়েছেন। প্রত্যেকটি আইসোটোপই অত্যন্ত তেজস্ক্রিয়। এতটাই যে, তাদের হদিশ পাওয়াটা হয় অনেকটাই খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার মতো।
কী ভাবে অ্যান্টার্কটিকা থেকে মিলল ওই অত্য়ন্ত তেজস্ক্রিয় লোহা? দেখুন ভিডিয়ো
সুপারনোভা এদের প্রধান জন্মদাতা
কলকাতার ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্স (আইসিএসপি)-র অধিকর্তা বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী সন্দীপ চক্রবর্তীর বক্তব্য, সাধারণত, এই ধরনের তেজস্ক্রিয় লোহা-সহ ভারী মৌলগুলির জন্ম হয় কোনও তারার মৃত্যুর সময়। যখন ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ বা সুপারনোভা হয়। তবে অসম্ভব তেজস্ক্রিয় পদার্থ বলে সেই লোহা হয় খুবই ক্ষণস্থায়ী। জন্ম হয় বটে তাদের, কিন্তু খুব সামান্য সময়ের মধ্যেই সেই তেজস্ক্রিয় লোহা অন্য পদার্থে ভেঙে যায়। তাই পৃথিবীতে এর হদিশ পাওয়া সত্যিই কষ্টসাধ্য।
আরও পড়ুন- অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলে ফের হবে মহাপ্লাবন! হুঁশিয়ারি বিজ্ঞানীদের
আরও পড়ুন- মহাকাশে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ, ৩ দিন ধরে দেখা গেল আলোর ছটা!
সন্দীপের বক্তব্য, ‘‘এই তেজস্ক্রিয় লোহা পৃথিবীতে যেটুকু রয়েছে, তা রয়েছে মহাসাগরগুলির একবারে নীচে। সমুদ্র-খাতে। যেগুলি সেখানে জমা হয়েছিল লক্ষ লক্ষ বছর আগে। আর রয়েছে চাঁদে। চাঁদের পিঠ বা লুনার সারফেসে। যেগুলি বহু বহু দিন আগে সৌরমণ্ডলের কোনও না কোনও প্রান্ত থেকে আছড়ে পড়েছিল চাঁদের পিঠে।’’
সুপারনোভা। শিল্পীর কল্পনায়
ডমিনিক জানাচ্ছেন, অ্যান্টার্কটিকার মতো জায়গায় এর আগে কখনওই এই ধরনের তেজস্ক্রিয় লোহার হদিশ মেলেনি। তা-ও আবার সেই অত্যন্ত তেজস্ক্রিয় লোহা উদ্ধার করা হয়েছে অ্যান্টার্কটিকার সেই কোহনেন স্টেশন এলাকা থেকে, যেখানে বরফের উপরের স্তরটি ২০ বছরের বেশি পুরনো নয়। যা প্রমাণ করল, এখনও এই ধরনের তেজস্ক্রিয় লোহা এসে আছড়ে পড়ছে পৃথিবীর বুকে।
তবে অন্য ভাবেও মিলতে পারে তেজস্ক্রিয় লোহা
পরমাণু অস্ত্রশস্ত্র বা ধূলিকণার উপর মহাজাগতিক ধুলোবালি (কসমিক ডাস্ট) এসে আছড়ে পড়লেও এই ধরনের অত্যন্ত তেজস্ক্রিয় লোহার জন্ম হতে পারে, জানাচ্ছেন সন্দীপ।
কিন্তু পরমাণু অস্ত্রশস্ত্র থেকে যে সেই তেজস্ক্রিয় লোহা অ্যান্টার্কটিকায় পৌঁছয়নি, তা নিয়ে অন্তত কোনও সংশয় নেই গবেষকদের। কারণ, অ্যান্টার্কটিকায় এখনও পর্যন্ত কোনও পরমাণু অস্ত্র আছড়ে পড়েনি।
গবেষকরা এ ব্যাপারেও নিশ্চিত হয়েছেন যে, পৃথিবীর ধূলিকণার উপর মহাজাগতিক ধুলোবালি এসে আছড়ে পড়ার ফলেও এই ধরনের অত্যন্ত তেজস্ক্রিয় লোহার জন্ম হয়নি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy