সেই নেপাল, তিব্বত, চিন হিমালয়। ছবি- ফেসবুকের সৌজন্যে।
ঘন ঘন ভূমিধস হতে পারে নেপাল, তিব্বত, চিনের হিমালয়ে। আর প্রত্যেকটি ভূমিধসই হবে ভয়ঙ্কর। বিশাল এলাকা জুড়ে। সেটা সবচেয়ে বেশি হবে চিন-নেপাল সীমান্তে। যার ফলে, ওই এলাকায় ভূমিধসের ঘটনা অন্তত ৩০ থেকে ৭০ শতাংশ বেড়ে যাবে।
সেই একের পর এক ভয়ঙ্কর ভূমিধসের জেরে অনেক নীচে নেমে আসবে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলির বিশাল বিশাল হিমবাহ। বেশি তাপমাত্রায় তারা দ্রুত গলে যেতে শুরু করবে। তাতে ভেসে যাবে এলাকার হিমবাহের হ্রদগুলি। ভয়াবহ প্লাবনে হারিয়ে যেতে পারে হিমালয়ের এই এলাকাগুলির যাবতীয় জনপদ।
‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে বুধবার এই খবর দিয়েছেন গোয়ার ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর পোলার অ্যান্ড ওশ্ন রিসার্চ’ (এনসিপিওআর)-এর অধিকর্তা, আন্তর্জাতিক হিমবাহ বিশেষজ্ঞ এম রবিচন্দ্রন।
তিনি জানিয়েছেন, উষ্ণায়নের জন্য নেপাল, তিব্বত ও চিন হিমালয়ের জলবায়ু কী ভাবে দ্রুত বদলাচ্ছে, তা নিয়ে সম্প্রতি একটি উল্লেখযোগ্য গবেষণা হয়েছে। মেরিল্যান্ডের গ্রিনবেল্টে নাসার গর্ডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের সঙ্গে সেই গবেষণায় সহযোগী হয়েছে ওয়াশিংটনে ‘ন্যাশনাল ওশ্নিক অ্যান্ড অ্যাটমস্ফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নোয়া)’ ও ক্যালিফোর্নিয়ায় স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। সেই গবেষণা থেকে নেপাল, তিব্বত হিমালয়ের ভয়াবহ ভবিষ্যতের অশনি সংকেত মিলেছে।
উষ্ণায়ন থেকেই তুমুল বৃষ্টি, ঘন ঘন ভূমিধসের শঙ্কা
উষ্ণায়নের দরুন যেখানে ভূমিধসের আশঙ্কা বহু গুণ বেড়ে গিয়েছে, হিমালয়ের সেই অংশটিকে ভূবিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয়, ‘হাই মাউন্টেন এশিয়া’। যা পূর্ব দিকে নেপাল, তিব্বত থেকে পশ্চিমে হিন্দুকুশ ও তিয়ান শান পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত।
রবিচন্দ্রন জানাচ্ছেন, দ্রুত উষ্ণায়নের দরুন নেপাল, তিব্বত ও চিনের হিমালয়ে বর্ষার মরসুমটাই বদলে গিয়েছে। তা আগের চেয়ে অনেকটাই দীর্ঘায়িত হয়েছে। ইদানীং ওই সব এলাকায় যখন তখন বৃষ্টি হচ্ছে। আর যখনই হোক, তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। প্রায় রোজকার তুমুল বৃষ্টির জন্যই নেপাল, তিব্বত ও চিন হিমালয়ে ভয়ঙ্কর ভূমিধসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। টানা ৭ দিনের তুমুল বৃষ্টিতে গড়ে যতটা জল জমে ওই সব এলাকায়, দেখা গিয়েছে, তাতেই ভূমিধসের আশঙ্কা কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে।
‘এনসিপিওআর’-এর অধিকর্তার কথায়, ‘‘হামেশাই হবে বিশাল বিশাল ভূমিধস। তার ফলে, ওই এলাকার হিমালয়ের বড় বড় হিমবাহগুলি (গ্লেসিয়ার) নেমে আসবে কয়কেশো কিলোমিটার নীচে। যেখানে তাপমাত্রা অনেক বেশি। তাতে হিমবাহগুলি দ্রুত গলে যাবে। তাতে প্লাবিত হবে হিমবাহগুলির হ্রদও (গ্লেসিয়াল লেক)। ভেসে যাবে এলাকার যাবতীয় জনপদ।’’
সেই আশঙ্কাটা সবচেয়ে বেশি জুন থেকে সেপ্টেম্বরে, বর্ষার মরসুমে। তার ফলে, সংলগ্ন শহর, জনপদগুলি তো ভেসে যাবেই, ধ্বংস হয়ে যাবে পানীয় জল সরবরাহ, নিকাশি ও যোগাযোগব্যবস্থা। গত বছরের গ্রীষ্মে বন্যা ও ভূমিধসে ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশে ভূমি-হারা হয়েছিলেন ৭০ লক্ষেরও বেশি মানুষ।
আরও পড়ুন- ১৮.৩ ডিগ্রি! এত গরমে আর কখনও তেতে ওঠেনি আন্টার্কটিকা
আরও পড়ুন- হিমবাহই থাকবে না আর আগামী শতাব্দীতে! বলছে গবেষণা
গবেষকরা জানিয়েছেন, গবেষণায় সিদ্ধান্তে পৌঁছতে তাঁরা ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত নাসার ‘প্রেসিপিটেশন ডেটা’ এবং ১৯৮২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ‘নোয়া’র ‘ক্লাইমেট মডেল ডেটা’র সাহায্য নিয়েছেন।
দ্রুত হিমবাহ গলছে হিমালয়ে: দেখুন ভিডিয়ো
দ্রুত বরফ গলছে হিন্দুকুশ হিমালয়ে
হিমবাহ দ্রুত গলে যাওয়ায় যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে নেপাল, তিব্বত হিমালয়ে। ছবি- টুইটারের সৌজন্যে।
গত বছর আন্তর্জাতিক পর্বত গবেষণা সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড মাউন্টেন ডেভেলপমেন্ট’ (আইসিআইএমওডি)-এর একটি রিপোর্টে জানানো হয়েছিল, খুব দ্রুত বরফ গলে যাচ্ছে হিন্দুকুশ হিমালয়ের পাহাড়, পর্বতে। দ্রুত গলে যাচ্ছে সেখানকার বড় বড় হিমবাহগুলি (গ্লেসিয়ার)। গলছে এভারেস্ট, কারাকোরামের মতো পৃথিবীর দু’টি সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গও। আন্টার্কটিকা ও আর্কটিকের (সুমেরু ও কুমেরু) পর হিন্দুকুশ হিমালয়কেই বলা হয় পৃথিবীর ‘তৃতীয় মেরু’।
বলা হয়েছিল, হিমালয়ে সেটাই এত দ্রুত হারে হচ্ছে যে আর ৮০ বছরের মধ্যেই তার এক-তৃতীয়াংশ বরফ পুরোপুরি গলে যাবে। আর বিশ্ব উষ্ণায়নের তাপমাত্রার বাড়-বৃদ্ধি যদি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে আটকে রাখা যায়, তা হলেও অর্ধেক বরফই গলে যাবে হিন্দুকুশ পর্বতমালার। উষ্ণায়নের তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লেই গলে যাবে দুই-তৃতীয়াংশ বরফ।
আর ৪০ বছরেই ভেসে যাবে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেকংয়ের অববাহিকা
তার ফলে, ওই অঞ্চলে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেকং-সহ প্রধান যে ১০টি নদী রয়েছে, পুরোপুরি ভেসে যাবে তাদের অববাহিকাগুলি। আর ৪০ বছরের মধ্যেই। তার ফলে, বিপন্ন হয়ে পড়বেন ভারত, পাকিস্তান, চিন, আফগানিস্তান, নেপাল, ভূটান-সহ ৮টি দেশের প্রায় ২০০ কোটি মানুষ। তার পর সেই হিমবাহগুলির বরফ শেষ হয়ে গিয়ে সেগুলি রুখুসুখু পাথর হয়ে যাবে। ফলে, সেই সব উৎস থেকে বেরিয়ে আসা নদীগুলি পুরোপুরি শুকিয়ে যাবে।
ভয়ঙ্কর বিপদে পড়বে ভারত-সহ ৮টি দেশ!
উষ্ণায়নের খুব বড় প্রভাব পড়েছে হিন্দুকুশ হিমালয়ে। প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটারের (২ হাজার ১৭৫ মাইল) ওই সুবিশাল পার্বত্য এলাকার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে মোট ৮টি দেশ। ভারত, পাকিস্তান, চিন, নেপাল, ভূটান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও মায়ানমারের বড় একটি অংশ। যেখানে গঙ্গা, সিন্ধু, ব্রহ্মপুত্র, মেকং, আমু দরিয়া, তারিম, ইরাওয়াড়ি, সালউইন, ইয়েলো ও ইয়াংঝের মতো রয়েছে ১০টি প্রধান নদী।
আইসিআইএমওডি-র ডেপুটি ডিরেক্টর একলব্য শর্মার কথায়, ‘‘আমরা হিসেব কষে দেখেছি, উষ্ণায়নের ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা যদি আরও ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে, তা হলে শুধুই হিন্দুকুশ হিমালয়ের তাপমাত্রা বাড়বে ০.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর তাতে উত্তর-পশ্চিম হিমালয় আর কারকোরাম পর্বতমালার তাপমাত্রা বাড়বে ০.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।’’
আইসিআইএমওডি-র হালের রিপোর্ট জানাচ্ছে, হিন্দুকুশ হিমালয়ে হিমবাহ থেকে জন্মানো হ্রদের সংখ্যা এখনও পর্যন্ত ৮ হাজার ৭৯০টি। তার মধ্যে বরফ দ্রুত গলে যাওয়ার ফলে ২০৩টি হ্রদই ভয়াল বন্যা সৃষ্টি করতে পারে।
পৃথিবীর তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি বাড়লে গলে যাবে দুই-তৃতীয়াংশ বরফ!
গোয়ার ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর পোলার অ্যান্ড ওশ্ন রিসার্চ’ (এনসিপিওআর)’-এর অধিকর্তা বিশিষ্ট হিমবাহ বিশেষজ্ঞ এম রবিচন্দ্রন জানাচ্ছেন, ১৯৭০ সাল থেকে উষ্ণায়নের খুব বড় প্রভাব পড়েছে হিন্দুকুশ হিমালয়ে। তার ফলে, সর্বোচ্চ শৃঙ্গগুলি-সহ গোটা হিন্দুকুশ হিমালয়ের বরফ যে ভাবে গলছে, যে হারে গলছে, তাতে উষ্ণায়নের তাপমাত্রাকে যদি শতাব্দীর শেষে পৌঁছে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ২.৭ ডিগ্রি ফারনেহাইটের মধ্যে ধরে রাখা সম্ভব হয়, তা হলেও তা হলেও হিমালয়ের বরফ গলার রথের চাকায় রশি পরানো যাবে না। আর ৮০ বছর পর হিমালয়ের এক-তৃতীয়াংশ বরফের পুরোটাই গলে যাবে। আর সেই তাপমাত্রার বাড়-বৃদ্ধি যদি হয় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৩.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট, তা হলে গলে যাবে হিমালয়ের অর্ধেক বরফ। ৪ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৭ থেকে ৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট বাড়লে গলে যাবে দুই-তৃতীয়াংশ বরফ।
হিমবাহ দ্রুত গলে যাওয়ায় যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে ‘হাই মাউন্টেন এশিয়া’য়। ছবি- টুইটারের সৌজন্যে।
রবিচন্দ্রনের কথায়, ‘‘শুধু হিন্দুকুশের পাহাড়, পর্বতেই থাকেন প্রায় ২৪ কোটি মানুষ। আর ওই অঞ্চলের ১০টি প্রধান নদীর জলের উপর নির্ভর করে আছেন প্রায় ২০০ কোটি মানুষ। জড়িয়ে রয়েছে ভারত, চিন, পাকিস্তান, আফগানিস্তান-সহ ৮টি দেশের অর্থনীতি, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, কৃষিকাজ, সেচ ও শস্য সংরক্ষণের অত্যন্ত জরুরি ক্ষেত্রগুলি।’’
২০৬০ সাল নাগাদ ভয়াল বন্যা হবে বার বার
রবিচন্দ্রন এও জানিয়েছেন, ১৯৭০ সাল থেকে গত ৫০ বছরে ইতিমধ্যেই হিন্দুকুশ হিমালয়ের ১৫ শতাংশ বরফ গলে জল হয়ে গিয়েছে। এর ফলে, ২০৬০ সাল নাগাদ পরিস্থিতিটা এমন হবে যখন বার বার ভয়াবহ বন্যা হবে ওই এলাকা ও সেখান থেকে বেরিয়ে আসা নদীগুলির অববাহিকা অঞ্চলে।
পরিসংখ্যান বলছে, ১৯০০ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত হিন্দুকুশ হিমালয়ের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে, সেখানকার বরফ দ্রুত গলতে শুরু করেছিল। তার পর ১৯৪০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত, ৩০ বছরে আবার ঠান্ডা হতে শুরু করে হিমালয়। পরে উষ্ণায়নের দৌলতে ১৯৭০ সাল থেকে ফের দ্রুত হারে বরফ গলতে শুরু করেছে হিন্দুকুশ হিমালয়ে।
ঠান্ডার রাত, দিনের সংখ্যা দ্রুত কমছে হিন্দুকুশ হিমালয়ে
একলব্য বলছেন, ‘‘আগের চেয়ে ঠান্ডার পরিমাণ অনেকটাই কমে গিয়েছে হিন্দুকুশ হিমালয়ে। হিসেব কষে দেখেছি প্রতি এক দশকে একটা ঠান্ডার রাত আর অর্ধেক ঠান্ডা দিন কমছে হিন্দুকুশ হিমালয়ে। অন্য দিকে ওই অঞ্চলে প্রতি এক দশকে গড়ে গরম রাতের সংখ্যা বেড়েছে ১.৭টি। আর গরম দিন বেড়েছে ১.২টি।’’
বদলে যাবে জীববৈচিত্র্যও!
একলব্য এও জানিয়েছেন, হিমালয়ের বরফ দ্রুত গলে যাওয়ার ফলে আর ৪০ বছরের মধ্যে বার বার ভয়াল বন্যা হবে ঠিকই। তবে সেই বন্যাও কমে যাবে জলের জোগান কমে যাওয়ায়, এই শতাব্দীর শেষে পৌঁছে। ২০৮০ সালের পর হিন্দুকুশ হিমালয়ের প্রধান নদীগুলির বেশির ভাগই যাবে শুকিয়ে। তাদের উৎস হিমবাহগুলি জলহীন শুকনো পাথরে পরিণত হবে বলে। তার ফলে, কৃষিকাজ, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, সেচ বেহাল হয়ে পড়বে। যা বিপন্ন করে তুলবে ভারত-সহ এই অঞ্চলের ৮টি দেশের অর্থনীতি। খুব ক্ষতি হবে জীববৈচিত্র্যেরও (বায়োডাইভার্সিটি)।
রবিচন্দ্রন অবশ্য এ কথা মানতে রাজি নন। তাঁর বক্তব্য, নদীর জল তার গতিপথে আরও অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। তার মধ্যে রয়েছে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ। তা ছাড়াও ওই নদীগুলি শুকিয়ে গেলে আশপাশের এলাকায় নদীর অন্যান্য উৎসেরও জন্ম হওয়াটা অসম্ভব নয়।
আরও একটি আশার কথাও শুনিয়েছেন রামচন্দ্রন। বলেছেন, ‘‘এও দেখা গিয়েছে, হিন্দুকুশ হিমালয়ে মরসুমও দীর্ঘায়িত হয়েছে গত ৫০ বছরে। এক দশকে কোনও মরসুমের আয়ু বেড়েছে সেখানে গড়ে ৪.২৫ দিন। এতে চাষবাসের জন্য বাড়তি সময় মিলবে।’’
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy