জ্বলছে আমাজন! ছবি: রয়টার্স
আমাদের জন্য কি আরও বড় বিপদ ডেকে আনতে চলেছে আমাজন? আরও ভয়ঙ্কর? আরও ভয়াবহ? নাসার অর্থানুকুল্যে সাম্প্রতিক একটি গবেষণা সেই আশঙ্কাকেই জোরালো করল।
প্রশ্ন উঠে গেল, আমাজন বৃষ্টি-অরণ্যে গত তিন সপ্তাহ ধরে যে ভয়ঙ্কর দাবানল চলছে, তা কি আরও ভয়াবহ ভাবে বিষিয়ে দিতে চলেছে আমাদের শ্বাসের বাতাস? সেই ভয়ঙ্কর দাবানল কি এ বার আশপাশের পরিবেশে উগরে দেবে মাটিতে মিশে থাকা বিষাক্ত কার্বন কণাও? যা বাতাসের অক্সিজেনে পুড়ে গিয়ে তৈরি করবে কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইডের মতো গ্রিনহাউস গ্যাস, আরও বেশি পরিমাণে। পৃথিবীর ‘জ্বর’ (উষ্ণায়ন) আরও বাড়িয়ে দেবে?
আমাজনই পৃথিবীর ‘ফুসফুস’
বিজ্ঞানীরা বলছেন, আমাজনের এই দাবানল এক অশনি সঙ্কেত! এক ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের ইঙ্গিতবাহী। যে আমাজন অরণ্যকে আমরা ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ বলে জানি, যা পৃথিবীর মোট অক্সিজেন-চাহিদার ২০ শতাংশ জোগায়, বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, সেই আমাজনই আগামী দিনে হয়ে উঠতে পারে আমাদের গভীর উদ্বেগের কারণ। আতঙ্কেরও!
আরও দেখুন- আমাজনের দাবানল সম্পর্কে এগুলো জানেন কি?
নাসার অর্থানুকুল্যে আমেরিকা ও কানাডার বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক গবেষণা, ‘আর্কটিক-বোরিয়াল ভালনারাবিলিটি এক্সপেরিমেন্ট (অ্যাবাভ)’ জানাচ্ছে, বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য বোরিয়ালের মতো বৃষ্টি-অরণ্য বা চিরহরিৎ অরণ্যগুলিতে দাবানলের ঘটনা আগের চেয়ে অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। ওই অরণ্যগুলিতে ঘন ঘন দাবানল হচ্ছে। বেড়েছে সেই দাবানলের প্রাবল্য। বেড়েছে ভয়াবহতাও।
গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার’-এর গত ১৬ অগস্ট সংখ্যায়। নাসার বিজ্ঞানীরা গবেষণাটি চালিয়েছেন উত্তর-পশ্চিম কানাডার বোরিয়াল বৃষ্টি-অরণ্যের উপর। তবে তাঁদের বক্তব্য, এই পর্যবেক্ষণ আমাজনের মতো অন্য বৃষ্টি-অরণ্যগুলির ক্ষেত্রেও সঠিক প্রমাণিত হতে পারে।
দাবানলে মাটির নীচের কার্বনও উঠে এসে মিশছে বাতাসে!
গবেষকরা দেখেছেন, দাবানলের সংখ্যা ও প্রাবল্য অনেকটাই বেড়ে যাওয়ার ফলে গাছের পাতা, কাণ্ড, ডালপালা পুড়ে গিয়ে কার্বন মনোক্সাইড ও কার্বন ডাই-অক্সাইডের মতো গ্রিনহাউস গ্যাসগুলি তো আরও বেশি পরিমাণে বাতাসে জমা করছেই, মাটির নীচে থাকা কার্বনও পুড়ে গিয়ে বাতাসের কাঁধে গ্রিনহাউস গ্যাসের বোঝাটা অসম্ভব ভারী করে তুলছে। উত্তরোত্তর। যা পৃথিবীর ‘জ্বর’ আরও দ্রুত, আরও বেশি হারে বাড়ানোর রাস্তাটাকে খুলে দিচ্ছে।
কী দেখেছেন বোরিয়াল অরণ্যে? জানাচ্ছেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী জ্যান্থে ওয়াকার। দেখুন ভিডিয়ো
বোরিয়ালে এর আগের কোনও দাবানলেই মাটির নীচে থাকা কার্বন কিন্তু উপরে উঠে এসে এই ভাবে পরিবেশকে এতটা বিষিয়ে দেয়নি। কিন্তু এই গবেষণা দেখাল, ২০১৪-র দাবানলে বোরিয়াল অরণ্যের যে অংশটি পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল, তার অন্তত ১২ শতাংশেই মাটির নীচে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে লুকিয়ে থাকা কার্বন মাটির উপরে উঠে এসে পুড়ে গিয়ে বাতাসে বিষের বোঝা ভারী করেছে।
মাটির নীচের ৮৮ লক্ষ টন কার্বন মিশেছে বাতাসে!
অন্যতম গবেষক, আরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাটমস্ফেরিক সায়েন্স বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, অনাবাসী ভারতীয় বিজ্ঞানী কুমার রঙ্গনাথন ‘আনন্দবাজার ডিজিটালে’র পাঠানো প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘‘আমরা হিসাব কষে দেখেছি, বোরিয়ালের শুধু ওই ১২ শতাংশ অরণ্য পুড়ে যাওয়ার ফলেই ৮৮ লক্ষ টন কার্বন বাতাসে মিশেছে। অথচ তার আগে যত দাবানল হয়েছে বোরিয়ালে, সেই সবক’টির ফলে মাটির নীচে লুকনো মোট ১০ কোটি ৪০ লক্ষ টন কার্বন উপরে উঠে এসে পরিবেশে মিশেছিল! তা হলে বুঝুন, দাবানলের ঘটনা ও প্রাবল্য বেড়ে যাওয়ার ফলে কী ভয়ঙ্কর অবস্থা হয়েছে বোরিয়াল অরণ্যের ওই অংশে। শুধু ২০১৪ সালেই!’’
আরও পড়ুন- পুড়ছে জঙ্গল, চটছেন প্রেসিডেন্ট
আরও দেখুন- এক সঙ্গে ন’হাজারেরও বেশি দাবানল! বিধ্বংসী আগুনে ছাই হচ্ছে আমাজন অরণ্য
গবেষকরা দেখেছেন, আগে দাবানল হলে বোরিয়ালে এই ঘটনা এতটা বেশি পরিমাণে ঘটত না। ঘন ঘন দাবানলের ফলে বৃষ্টি-অরণ্যগুলি আগের চেয়ে অনেক বেশি শুকনো হয়ে গিয়েছে। সেই অরণ্যে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমছে। যার জেরে দাবানলের সংখ্যা ও প্রাবল্য দুই-ই বাড়ছে উল্লেখযোগ্য ভাবে। আর উত্তরোত্তর শুকনো হয়ে পড়া এলাকাগুলিতে মাটির নীচে লুকিয়ে থাকা কার্বনের উপরে আসার ঘটনা ও পরিমাণ বেড়েই চলেছে।
কানাডার বোরিয়াল বৃষ্টি-অরণ্যে ২০১৪ সালে যে ভয়াবহ দাবানল হয়েছিল, মূলত তার উপরেই গবেষণা চালিয়েছিলেন নাসার বিজ্ঞানীরা। যে এলাকা জুড়ে ওই দাবানল হয়েছিল, সেখানকার ২০০টি জায়গা থেকে মাটি নিয়ে নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল।
আর ‘লিগ্যাসি’ থাকছে না ‘লিগ্যাসি কার্বনে’র!
গবেষকরা দেখেছেন, বোরিয়ালের যে এলাকার অরণ্য কম করে ৭০ বছরেরও বেশি পুরনো আর অরণ্যের যে এলাকাগুলিতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি, সেখানকার মাটিতে একটি পুরু আস্তরণ থাকে জৈব পদার্থের। যা ভিতরে থাকা কার্বনকে সযত্নে বাঁচিয়ে রাখে। আগলে রাখে। তাকে মাটির উপরের পরিবেশের সঙ্গে সহজে মিশতে দেয় না। এই মাটিতে ‘লুকিয়ে থাকা’ কার্বনকেই বলা হয়, ‘লিগ্যাসি কার্বন’। যার পরিমাণ ঠিক কতটা হতে পারে, আমরা এখনও পর্যন্ত তা নিখুঁত ভাবে বলতে পারি না।
বোরিয়াল অরণ্যে আগে যত বার দাবানল হয়েছে, তাতে কোনও দিনই মাটির নীচে থাকা কার্বন এই পরিমাণে পুড়ে যায়নি। কিন্তু বোরিয়াল অরণ্যের যে অংশটি তুলনায় নবীন আর যে এলাকাগুলিতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও যৎসামান্য, দেখা গিয়েছে, সেই সব অঞ্চলের মাটিতে সেই জৈব পদার্থের আস্তরণটি ততটা পুরু নয়। ফলে, সেই আস্তরণটি ভিতরে থাকা কার্বনকে লুকিয়ে রাখতে পারেনি। দাবানলে সেই কার্বন পুড়ে গিয়ে বাতাসে কার্বন মনোক্সাইড ও কার্বন ডাই-অক্সাইডের মতো গ্রিনহাউস গ্যাসগুলির পরিমাণ অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে।
আমাজনে এখন শুধুই পোড়া গাছের কঙ্কাল! ছবি: এএফপি
অন্যতম মূল গবেষক আরিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইকোসিস্টেম সায়েন্স অ্যান্ড সোসাইটির অধ্যাপক মিশেল ম্যাক তাঁর গবেষণাপত্রে লিখেছেন, ‘‘এই কার্বন জমা থাকে গাছের নীচে। ট্রি রিং (যার সংখ্যা গুনে গাছের বয়স মাপা হয়)-এর মধ্যে। কত দিন ধরে সেই কার্বন জমা রয়েছে মাটির নীচে, আর কবে থেকে তা ক্ষয়ে যেতে শুরু করেছে, তা বুঝতে আমরা সেই ট্রি রিংগুলিকেও পরীক্ষা করে দেখেছি।’’
বৃষ্টি হলে বুড়ো গাছ, না হলে তরতাজা গাছও দাবানলে উগরে দিচ্ছে বিষ!
কলকাতার এক বিশিষ্ট পরিবেশবিজ্ঞানী বলছেন, “গবেষকরা তিনটি বিষয় লক্ষ্য করেছেন। এক, বৃষ্টি-অরণ্যের যে এলাকাগুলিতে বেশি বৃষ্টি হয়, আর যেখানে ৬০ বছরের কম বয়সের গাছের সংখ্যা বেশি, সেখানে লিগ্যাসি কার্বনের পরিমাণ বেশি। দুই, যেখানে গাছেদের বয়স বেশি আর যে এলাকা প্রায় শুকনো, সেখানে মাটিতে লুকিয়ে থাকা কার্বন দাবানলের ফলে প্রায় পুরোটাই পুড়ে গিয়ে বাতাসে মিশেছে। তিন, তবে অল্পবয়সী গাছ যদি শুকনো এলাকায় থাকে, তা হলে সেখানেও লিগ্যাসি কার্বন মিশে গিয়েছে পরিবেশে।’’
একই হাল হতে পারে আমাজনেরও, হুঁশিয়ারি বিজ্ঞানীদের
দাবানল ও তার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নিয়ে কাজ করেন এমন পরিবেশবিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘‘একই অবস্থা হতে পারে আমাজনেরও। ইতিমধ্যেই দেখা গিয়েছে, ২০১৭-র অগস্ট থেকে ২০১৮-র এপ্রিল পর্যন্ত যত দাবানল হয়েছে আমাজনে, গত বছরের অগস্ট থেকে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত তা ২০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। শুধু এই জুনেই দাবানলের সংখ্যা বেড়েছে গত বছরের জুনের ঘটনার তুলনায় ৮০ শতাংশ। তার কারণ, আমাজন বৃষ্টি-অরণ্যে ব্যাপক ভাবে গাছ কাটা শুরু হয়েছে। এবং তা হয়েছে গত জানুয়ারিতে ব্রাজিলে নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকেই।’’
যথেচ্ছ বৃক্ষচ্ছেদনেই বিপদ ঘনাচ্ছে
পরিবেশবিজ্ঞানীদের বক্তব্য, গাছ কাটার ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমছে। অরণ্য অনেক বেশি শুকনো হয়ে যাচ্ছে। ফলে, দাবানলের সংখ্যা ও প্রাবল্য বাড়ছে। বাড়ছে ভয়াবহতা। বনাঞ্চল ও সেখানকার মাটির ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বাড়ছে। যার ফলে মাটির নীচে লুকিয়ে থাকা কার্বন উপরে উঠে এসে অক্সিজেনে পুড়ে গিয়ে বাতাসে বিষের বোঝা ভারী করে তোলার আশঙ্কাকে জোরালো করে তুলেছে। আশঙ্কাকে বাস্তব করে তুলছে। আমাজনের মতো অন্য বৃষ্টি-অরণ্যগুলিরও একই ভবিষ্যতকে সুনিশ্চিত করে তুলেছে।
ঘটনা বলছে, গত জানুয়ারিতে জাইর বোলসোনারো ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকেই আমাজনের বৃষ্টি-অরণ্যে গাছ কাটার উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রেসিডেন্ট বোলসোনারোর জনমুখী কর্মসূচির দৌলতে আমাজনের গাছ কেটে চাষবাসের জমি বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। কৃষি রাজস্ব-বৃদ্ধির লক্ষ্যে ওই সরকারি প্রয়াসের শরিক হয়েছে ব্রাজিলের কয়েকটি অ-সরকারি সংস্থাও (এনজিও)।
জুনে ব্রাজিলে বৃক্ষচ্ছেদন বেড়েছে ৮০ শতাংশ!
রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, গত জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট বোলসোনারোর সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে গত সাত মাসে (জুলাই পর্যন্ত) আমাজনে গাছ কাটার ঘটনা গত বছরে ওই সময়ের তুলনায় ৩৯ শতাংশ বেড়েছে। আর সেটা এই জুনে বেড়েছে ৮০ শতাংশ, আগের বছরের জুনের তুলনায়।
এই যথেচ্ছ বৃক্ষচ্ছেদনই সমূহ সর্বনাশ ডেকে আনছে আমাজনের। আর যে হেতু আমাজনই ‘পৃথিবীর ফুসফুস’, তাই এর ফলে, ভয়ঙ্কর বিপদ ঘনিয়ে আসছে পৃথিবীরও।
আমাজন কি শুধুই ব্রাজিলের?
যদিও রোম পোড়ার সময় যেমন সঙ্গীতের মূর্ছনায় মগ্ন ছিলেন সম্রাট নিরো, তেমনই ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘‘আমাজন তো আমাদের। আমাজনকে নিয়ে আপনারা এত ভাবছেন কেন?’’
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
ভিডিয়ো সৌজন্যে: নাসা
(এই খবরটির সঙ্গে যে মূল ছবিটি আগে প্রকাশিত হয়েছিল, তা আমাজনের নয়। অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য দুঃখিত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy